মতামত

ছাত্রলীগ নেত্রীর অভিযোগ ভীতিকর, এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই

সত্য অথবা মিথ্যা যা-ই হোক, ইডেনের মতো রাজধানীর একটি স্বনামধন্য কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ ধরনের অভিযোগ খুবই অনভিপ্রেত
ছবি : প্রথম আলো

ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের এক নেত্রী ভয়ংকর অভিযোগ করেছেন। সম্প্রতি ইডেন কলেজে আন্তসংঘর্ষের পর ছাত্রলীগের এক নেত্রী অভিযোগ করেছেন, হলে থাকা টার্গেটকৃত ছাত্রীদের নির্ধারিত ব্যক্তির সঙ্গে জোরপূর্বক যৌনতায় লিপ্ত হতে বাধ্য করছেন ছাত্রলীগের নেত্রীরা। এ ধরনের কাজে রাজি না হলে ওই ছাত্রীদের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। সঙ্গে অর্থও আদায় করা হয়। ছাত্রলীগের ওই নেত্রী আরও অভিযোগ করেছেন, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কক্ষে ডেকে নিয়ে আপত্তিকর ছবি তুলে রাখতেন নেত্রীরা। পরে এসব ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে নির্ধারিত ব্যক্তিদের সঙ্গে একান্তে দেখা করতে পাঠাতেন। এর সঙ্গে নানা ধরনের ভয়ভীতিও দেখানো হতো এবং ওই নেত্রীরা রীতিমতো ব্যবসা শুরু করে দিয়েছিলেন বলে তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।

ছাত্রলীগ নেত্রীর অভিযোগ ভীতিকর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ঘিরে এ ধরনের অভিযোগ ভয় এবং আশঙ্কারও। এই অভিযোগ ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের কুৎসিত দিক তুলে ধরে। দুই দিক থেকেই অভিযোগটি অত্যন্ত ভয়ংকর। অভিযোগটি সত্য হলে আমরা বাক্‌হারা। আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমাদের গন্তব্য কি কেবলই পতনের খাদের দিকে? আর মিথ্যা হলেও চরম নৈতিক অধঃপতনের উদাহরণ হয়ে থাকবে এই অভিযোগ। দলীয় কোন্দলের কারণে দলের নেত্রীদের বিরুদ্ধে এ ধরনের মিথ্যা অভিযোগ অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ।

সত্য অথবা মিথ্যা যা-ই হোক, ইডেনের মতো রাজধানীর একটি স্বনামধন্য কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ ধরনের অভিযোগ খুবই অনভিপ্রেত। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, ছাত্রলীগের মতো একটি পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বারবারই যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই ছাত্রলীগ যৌন নির্যাতনের অভিযোগ থেকে বের হতে পারছে না। রাজপথের সোনালি ঐতিহ্য পেছনে ফেলে যৌন নির্যাতকের দলে পরিণত হবে শেষ পর্যন্ত? অধিকার আদায়, আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের সারিতে থাকা দলটির নাম মুখে নিলেই এখন যৌন নির্যাতন, চাঁদাবাজি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হলে জুলুম বা খাদিজাকে কোপানোর দৃশ্য চোখে ভেসে উঠে।

কেবল শিক্ষার্থীরাই নন, অন্য আরও অনেকে যুক্ত থাকতে পারেন এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে। কলেজের অধ্যক্ষ, হল সুপারসহ দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এই অভিযোগ নিশ্চয়ই হুট করে উত্থাপিত হয়নি। অনেক দিন ধরেই এ অনৈতিক কাজ চলে থাকতে পারে। কলেজের অধ্যক্ষসহ দায়িত্বশীল শিক্ষকেরা কোথায় ছিলেন এত দিন? কেন তাঁরা ব্যবস্থা নেননি।

কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে নির্যাতিত হয়েছিলেন এক ছাত্রী। ওই ছাত্রী বন্ধুকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানে বেড়াতে গিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের নির্যাতনের মুখে পড়েন। তাঁকে মারধর ও বিবস্ত্র করে ছবি তোলে ছাত্রলীগের কর্মীরা। সঙ্গে থাকা বন্ধুটিকেও মারধর করে বেঁধে রাখা হয়। লক্ষ করে দেখুন, ইডেন ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় মিল রয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে ছাত্রীদের বিবস্ত্র করে ছবি তোলার অভিযোগ রয়েছে। এরপর ওই সব ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে নির্যাতন বা নিজেদের কার্যসিদ্ধি করা হয়েছে।

হাল আমলে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের ফিরিস্তি বেশ লম্বা। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন এক নববধূ। উচ্চ স্বরে গান ছেড়ে ওই নববধূকে একটি গাড়ির ভেতর ধর্ষণ করেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। এটা ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। ওই ঘটনায় ছাত্রলীগের কর্মীদের আটক করা হয়।

এই সিলেটেই এমসি কলেজের স্নাতক পরীক্ষার্থী খাদিজাকে কুপিয়ে আহত করেছিল শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা বদরুল ২০১৬ সালের অক্টোবরে। ২০১৬ সালের নভেম্বরে চুয়াডাঙা সরকারি কলেজের এক পরিচারিকার ঘরে ঢুকে মদ্যপ অবস্থায় ধর্ষণ করতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার হন কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ২০১৮ সালে ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হন ভিকারুনন্নেসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থী। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭ মার্চের জনসভা থেকে ফেরার পথে বাংলামোটরে দিনের বেলায় ওই শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করেন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা।

গত এক দশকে এ রকম অনেক ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যাবে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের হিসাব অনুসারে, ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে ৩০৯ জন নারী, শিক্ষার্থী, শিশু—ধর্ষণ, নির্যাতন, শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন বা উত্ত্যক্ত হয়েছেন। গত ১০ বছরে ছাত্রলীগ থেকে ৩৫০ জনের মতো নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে যৌন নির্যাতন বা এ জাতীয় অভিযোগে বহিষ্কৃত হয়েছেন ১১৩ জন। এই হচ্ছে ছাত্রলীগের নারী নির্যাতনের বিবরণ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনা ও অভিযুক্ত সংখ্যার হেরফের হতে পারে। একজন এই হিসাবে আস্থা না-ও রাখতে পারেন। তবে এই অভিযোগগুলো মোটেও মিথ্যা নয়। এগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় আমরা জানতে পেরেছি। বরং বাস্তবে নির্যাতনের অভিযোগ ও ঘটনা আরও অনেক বেশি। অনেক ঘটনাই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। নির্যাতিত ব্যক্তিরা আরও নির্যাতনের ভয় ও শঙ্কার কারণে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না।

তবে নির্যাতিত ব্যক্তিরা মুখ বুজে সয়ে গেলেও অনেক সময় ভয়ংকর সব ঘটনা ফাঁস হয়ে যায় নিজেদের আন্তকলহের কারণে। ইডেন কলেজেও ঠিক এটাই হয়েছে। হল নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগি নিয়ে কোন্দলের কারণে ভয়াবহ থলের বিড়াল বেরিয়ে এসেছে। ইডেনের সাম্প্রতিক এই অভিযোগ ছাত্রলীগ ও ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায়। এই ঘটনা দীর্ঘদিন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে তাড়িয়ে বেড়াবে। যেমন এখনো ভূত হয়ে ছাত্রলীগকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জসিম উদ্দিন মানিক। তৎকালীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন মানিক ক্যাম্পাসে ধর্ষণের উৎসবে মেতে উঠেছিলেন। এ নিয়ে তখন ক্যাম্পাসে ফিসফাস করে কথা হলেও প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি। কিন্তু একপর্যায়ে এই ঘটনা প্রকাশিত হলে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ওই সময় বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আখেরে কোনো লাভ হয়নি। বরং কলঙ্কের বোঝা কাঁধে নিয়ে একসঙ্গে সবাই ডুবেছে। ইডেনেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি লক্ষ করা যাচ্ছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং অভিযোগকারীকেই সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ভয়ভীতি দেখিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহার করাও অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু এই অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। ইডেনের ঘটনায় গণতদন্ত কমিশন গঠন করা দরকার। এর সঙ্গে কারা জড়িত, তা খোঁজে বের করা জরুরি।

কেবল শিক্ষার্থীরাই নন, অন্য আরও অনেকে যুক্ত থাকতে পারেন এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে। কলেজের অধ্যক্ষ, হল সুপারসহ দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এই অভিযোগ নিশ্চয়ই হুট করে উত্থাপিত হয়নি। অনেক দিন ধরেই এ অনৈতিক কাজ চলে থাকতে পারে। কলেজের অধ্যক্ষসহ দায়িত্বশীল শিক্ষকেরা কোথায় ছিলেন এত দিন? কেন তাঁরা ব্যবস্থা নেননি।

অভিভাবকেরা সন্তানদের পাঠিয়েছিলেন পড়াশোনা করতে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ। ছাত্রলীগের পাশাপাশি কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ধরনের গর্হিত অপরাধকে কোনোভাবেই বরদাশত করা যাবে না।

পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বোঝাই যাচ্ছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ একেবারেই নতুন নয়। শুরুতেই দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আজ ইডেনে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।

  •  ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক