আলতাফ পারভেজের বিশ্লেষণ

চাকমাদের নিয়ে ভারতে আবার টানাপোড়েন কেন

ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে বিশেষ পরিস্থিতিতে চাকমা জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষ ভারতে পুনর্বাসিত হয়েছিলেন। গত দুই দশকে অরুণাচল ও মিজোরামে হঠাৎ চাকমাবিরোধী মনোভাব বেগবান হয়ে উঠেছে। তাঁদের অন্য প্রদেশে স্থানান্তরেরও দাবি উঠেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষুদ্র জাতির মানুষ কীভাবে ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনার শিকার হচ্ছেন, তা নিয়ে লিখেছেন আলতাফ পারভেজ

এশিয়ার প্রধান দুই শক্তি চীন-ভারতের কাজিয়ার বড় এক বিষয় অরুণাচল। বিরতিহীনভাবে সেই বিতর্ক চলছে। এই অরুণাচলেই ৬০ বছর আগে উদ্বাস্তু চাকমারা বড় সংখ্যায় আশ্রয় পান।

পুরোনো জনপদ ছেড়ে নিরুপায় চাকমাদের ওই ‘অভিযাত্রা’য় তখনকার চীন-ভারত দ্বন্দ্ব গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান ছিল। সম্প্রতি একই চাকমাদের নিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জনপদে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। অনেকেই এর মধ্যে শুধু ভোটের রাজনীতি দেখছেন। তবে এ রকম পর্যবেক্ষণের আড়ালে ঢাকা পড়ছে দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধকালীন রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কর্মসূচির অপর এক মানবিক বিপর্যয়ের দিক।

যুদ্ধের পর অরুণাচলে যেভাবে এলেন চাকমারা

অরুণাচল ভারতে প্রদেশের স্বীকৃতি পায় ১৯৮৭ সালে। এর আগে এটা ছিল নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি (এনইএফএ)। এরও আগে ছিল আসামের অংশ। যে বছর বঙ্গভঙ্গ রদ হলো, সে বছরই আসাম কেটে এনইএফএ হলো। ১৯৪৭–এর ‘দেশভাগ’ শেষে এনইএফএ ভারতের একক জিম্মায় যায়। চাকমাদের সেখানে যাওয়া এই অধ্যায়ের ঘটনা। পার্বত্য চট্টগ্রাম তখন পাকিস্তানভুক্ত।

১৯৪৭-এর শুরুতে পুরোনো ভারতবর্ষের আরও বহু এলাকার মতো পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়েও বিতর্ক ছিল—এই জনপদ ইসলামাবাদ বা নয়াদিল্লি কার অধীনে যাওয়া উচিত। শেষ পর্যন্ত ‘সামগ্রিক ভূখণ্ড বিনিময়’ শেষে অমুসলমানপ্রধান হয়েও এই এলাকা পাকিস্তানভুক্ত হয়। তবে তাতে দেশভাগকালীন বিতর্কের রেশ মিইয়ে যায়নি। ফল হিসেবে পাকিস্তানের শাসকদের সঙ্গে পার্বত্যবাসীর আস্থা-বিশ্বাসের টানাপোড়েন ছিল।

এ রকম পটভূমিতেই ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে কাপ্তাইয়ে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র বানায় সরকার। তাতে রাঙামাটিকেন্দ্রিক অনেক জমিজমা ডুবে যায়। প্রধানত চাকমা সম্প্রদায়ের অনেক মানুষকে এলাকা ছেড়ে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়তে হয় তখন। নতুন করে বসতি গড়তে তাঁদের কারও কারও নজর পড়ে সে সময় এনইএফএর দিকে।

ঠিক কাছাকাছি সময়ে ১৯৬২ সালে এনইএফএ এলাকায় চীন-ভারত যুদ্ধ হয়ে গেছে এক দফা। নয়াদিল্লির সরকার এ সময় এনইএফএতে ‘নতুন বসতি’র ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। বিবদমান এলাকায় চীনা নয় এমন নাগরিকের উপস্থিতি তাদের জন্য একধরনের প্রতিরক্ষাব্যূহের ভূমিকা পালন করছিল। চীন-অরুণাচল-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ‘বিজয়নগর’ ও তার আশপাশে এ রকম একটা ‘স্কিম’ নেওয়া হয় তখন।

চাকমা উদ্বাস্তুরা তখন হাঁটতে হাঁটতেই রেডিওতে শুনছিলেন তাঁদের ওদিকে পুনর্বাসিত হতে বাধা নেই। বাস্তবেও তখন তাঁদের দীর্ঘ সময় শরণার্থী হয়ে থাকতে হয়নি। কয়েক দিন হেঁটে লুসাই পাহাড় পাড়ি দেওয়ার পর স্থানীয় জনজীবনে এবং ভোটের প্রক্রিয়াতেও শরিক হতে বেশি দিন লাগেনি তাঁদের।

প্রতি পরিবারকে পাঁচ একর জঙ্গল-জমি দেওয়া হয়। ১৯৭৮ সাল থেকে সেসব জমি পাঁচ বছর মেয়াদে লিজ আকারে নবায়নও হতো। এসব পরিবারের হাতে কিছু অর্থকড়িও দেওয়া হয় শুরুতে। কেউ কেউ বনে নিরাপত্তার প্রয়োজনে বন্দুকের লাইসেন্সও পান। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের ইতিবাচক মনোভাব সত্ত্বেও নাগরিকত্বের প্রশ্নটি বরাবরই ঝুলে ছিল। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং এনইএফএ অরুণাচল হয়ে গেছে।

গত শতাব্দীর শেষ দুই দশকে এসে অরুণাচল ও মিজোরামে হঠাৎ চাকমাবিরোধী মনোভাব বেগবান হয়ে উঠতে শুরু করে। এই শতাব্দীতে এসে ২০১৭ সালে এ নিয়ে দাঙ্গাও হয় এক দফা। স্থানীয় অনেক নেতা মাঝেমধ্যেই সদম্ভে বলেন, এখানকার চাকমারা ‘অবৈধ অভিবাসী’। তার মধ্যেই এবার ভোটের মৌসুমে শোনা গেল অরুণাচল থেকে চাকমাদের আসামে স্থানান্তর করা হবে। এ প্রচারণায় অরুণাচলের চাকমা সমাজে শুরু হয়েছে উদ্বেগ। এবারের নতুন বছরের বিজু উৎসবেও ছিল ওই উদ্বেগের ছায়া।

চাকমারা অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, আমরা কি প্রজন্মের পর প্রজন্ম উদ্বাস্তুই থাকব? কী দোষে এই দুর্গতি? চাকমাদের পাশাপাশি কিছু সংখ্যায় হাজং জনগোষ্ঠীও স্থানান্তরের কথা প্রচারিত হচ্ছে অরুণাচলজুড়ে। এঁরাও সেখানে থিতু হন ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯-এর মধ্যে। তাঁরা থাকেন তিরাপ জেলায়—একেবারে মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি।

অরুণাচলে আন্তজাতি টানাপোড়েন যেভাবে শুরু

অরুণাচলের পত্রপত্রিকার ভাষ্যমতে, সেখানে চাকমা ও হাজং জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ। তবে এঁদের কতজন বা এঁদের পূর্বপুরুষদের কতজন উদ্বাস্তু হয়ে সেখানে যান, সেই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেকে এটা পাঁচ হাজার বলে দাবি করেছেন। কারও কারও মতে সংখ্যাটা আরও বেশি।

২০১৫-১৬ সালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছিলেন, এখন তাঁরা সংখ্যায় ৬৫ হাজার ৮৭৫। ১৯৮৬ সালে এ বিষয়ে রাজ্য সরকার যে ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশ করে, তাতে বলা হয়েছিল, শুরুতে ২ হাজার ৭৪৮টি পরিবারের ১৪ হাজার ৮৮৮ জনকে এখানে থাকতে দেওয়া হয়।

আদিতে পুনর্বাসিত ব্যক্তিদের সংখ্যা যা–ই হোক—১৯৬৪ থেকে পরবর্তী চার-পাঁচ বছরজুড়ে মিজোরাম হয়ে এঁরা অরুণাচলে যান বলে কথিত রয়েছে। তখন এসব মানুষ থিতু হয়েছিলেন রোহিত, নামশাল, চাঙলাঙ, তিরাপ, লংদিুং এবং পাপুম পারে জেলায়। এ রকম প্রতিটি জেলা আজকের আপার আসাম ও মিয়ানমারসংলগ্ন অরুণাচলে পড়েছে।

তবে এসব অঞ্চলের এখনকার চাকমা বা হাজংদের ৯০ শতাংশ নতুন জন্ম নেওয়া মানুষ। প্রথম প্রজন্মের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের মতো কেবল বেঁচে আছেন। এখানকার চাকমা সমাজের অনেকেরই স্থানীয় নানা ধরনের সনদও আছে। ভোটার আছেন প্রায় ৭ হাজার ৭০০ জন। (দ্য অরুণাচল টাইমস, ২৮ এপ্রিল)

চাকমাদের ঘিরে সৃষ্ট টানাপোড়েন অরুণাচল ছাড়িয়ে মিজোরাম ও আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। মিজোরামে এমনও হয়েছে যে অন্যান্য ট্রাইবের তরুণ-তরুণীদের মতো সমযোগ্যতার পরও অনেক চাকমা পড়ালেখা বা চাকরিতে বঞ্চনার শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে। কোথাও কোথাও বিভিন্ন সময় ভোটেও বাধা পান তাঁরা। ইতিহাসের কৌতুক হলো নিজেরা আসামভুক্ত থাকার সময় ওই রকম আন্তজাতি বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন মিজোরা। এখন তাঁদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলছেন রাজ্যের চাকমারা।

কিন্তু গত শতাব্দীর শেষ দশকে এঁদের নিয়ে প্রথম আপত্তি তোলে ‘নিখিল অরুণাচল প্রদেশ ছাত্র ইউনিয়ন’ বা ‘আপসু’। তাদের দাবি দুটি—চাকমাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হলেও অরুণাচলে থাকতে দেওয়া যাবে না এবং প্রদেশ থেকে সরিয়ে নিতে হবে। ১৯৯৪ সালে ‘আপসু’ চাকমাদের ‘কুইট অরুণাচল’ নোটিশ দেয়। পরের বছর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে।

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য ১৯৯৬ সালে এক রায়ে চাকমাদের জোর করে স্থানান্তরের বিরুদ্ধে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২০১৫ সালেও আরেকবার উচ্চ আদালত বলেন, আপসুর ভূমিকা প্রতিরোধ করা রাজ্য সরকারের দায়িত্ব। অর্থাৎ ভারতীয় উচ্চ আদালত এ পর্যন্ত অন্তত দুবার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চাকমাদের নাগরিকত্ব ও সুরক্ষার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। যদিও সংশ্লিষ্ট রাজ্য সেসব রায় বাস্তবায়ন করেনি।

বরং এ নিয়ে রাজনীতি চলছে দশকের পর দশক। বিশেষ করে আসামে বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে ‘বিদেশি খেদাও’ আন্দোলনের রাজনৈতিক সফলতায় অরুণাচলে-মিজোরামে স্থানীয় একদল রাজনীতিবিদ একই পথে জনপ্রিয়তা পেতে চাকমাদের টার্গেট করেছেন। ইতিমধ্যে অরুণাচলে অনেক চাকমা পরিবারকে রেশন দেওয়ার পুরোনো সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ রকম প্রবণতা তাঁদের মধ্যে ভীতি বাড়িয়েছে।

উত্তেজনা যখন মিজোরাম ও আসামেও

চাকমাদের ঘিরে সৃষ্ট টানাপোড়েন অরুণাচল ছাড়িয়ে মিজোরাম ও আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। মিজোরামে এমনও হয়েছে যে অন্যান্য ট্রাইবের তরুণ-তরুণীদের মতো সমযোগ্যতার পরও অনেক চাকমা পড়ালেখা বা চাকরিতে বঞ্চনার শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে প্রশাসনিক উচ্চ পদে তাঁদের নিয়োগ অতি বিরল। কোথাও কোথাও বিভিন্ন সময় ভোটেও বাধা পান তাঁরা।

ইতিহাসের কৌতুক হলো নিজেরা আসামভুক্ত থাকার সময় ওই রকম আন্তজাতি বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন মিজোরা। এখন তাঁদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলছেন রাজ্যের চাকমারা। ২০১৭ সালে নিজ সমাজের বঞ্চনার অভিযোগের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে রাজ্যের একমাত্র চাকমা মন্ত্রী পদত্যাগও করেছিলেন। তাঁরা তখন রাজ্য ভেঙে তাঁদের এলাকাটা ‘কেন্দ্রশাসিত’ করার দাবি তোলে। এই দাবি আদায়ে সফল হওয়ার কৌশল হিসেবে চাকমারা নিজ এলাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠই বিজেপির সমর্থক বনে গেছেন।

মিজোরামে লোকসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশ চাকমা। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি কমলানগরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা চাকমা এলাকাটি গত প্রায় ৫০ বছর হলো ‘স্বশাসিত এলাকা’ হিসেবে আছে। মিজোরা অবশ্য এখন এই মর্যাদা প্রত্যাহার চান।

আসামের ‘আসু’ এবং অরুণাচলের ‘আপসু’র মতো মিজোরামেও বড় জাতির শিক্ষার্থীদের শক্তিশালী সংগঠন ‘মিজো জিরলাই পল’ (মিজো ছাত্র সমিতি) চাকমাবিরোধী আন্দোলন করে চলেছে দীর্ঘকাল। এরা খুবই প্রভাবশালী। চাকমাদের প্রতিপক্ষ জ্ঞান করে তারা বলছে, ১৯৫০–এর পর থেকে যেসব চাকমা এদিকে এসেছেন, তাঁদের যেতে হবে। মিজোদের সঙ্গে চাকমাদের এ রকম টানাপোড়েনের ছাপ পড়ছে আশপাশের অন্যান্য জনপদেও। বাংলাদেশে বসেও সেটা টের পাওয়া সম্ভব।

আসামেও শ পাঁচেক চাকমা পরিবার আছে। এখানে তারা শিডিউল ট্রাইবের মর্যাদা পায় (অরুণাচলে যা নয়)। তবে আসামের চাকমাদের খুবই দরিদ্র অবস্থা। এরপরও এবারের লোকসভা নির্বাচনে হঠাৎ এই রাজ্যে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে এ জাতি।

অরুণাচল থেকে এই জাতিসত্তার আরও মানুষ এনে নতুন নাগরিকত্ব আইনের আওতায় তাঁদের এখানে পুনর্বাসিত করা হবে—এ রকম খবরে আসাম বেশ তোলপাড় এখন। অসমিয়া মানুষ এবং দল হিসেবে কংগ্রেসের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। এই বিতর্কের শুরু কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজুর এক মন্তব্য থেকে।

কিরেন অরুণাচল থেকে লোকসভার সদস্য। এবারের নির্বাচনী প্রচারকালে তিনি বলেছেন, যেহেতু অরুণাচল ‘ট্রাইবাল এলাকা’ হিসেবে ‘সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে’র আওতার বাইরে পড়েছে, সে কারণে এই রাজ্যের চাকমা ও হাজংয়ের আসামে পুনর্বাসিত করা হবে। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আসামের মুখ্যমন্ত্রীর কথা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। এই মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা দেখে এখন বিজেপির এই দুই নেতাই অস্বীকার করছেন বিষয়টি। তবে স্বভাবত অসমিয়ারা এতে উত্তেজিত এবং আসাম-অরুণাচল-মিজোরামজুড়ে চাকমা প্রশ্ন আবার বড় আকারে বিতর্ক তুলেছে।

কিরেন উত্তর-পূর্ব ভারতে বিজেপির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। তিনি এ–ও বলতে চাইছেন, নাগরিকত্ব সংশোধন আইন জারির পর চাকমাদের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের অতীত নির্দেশনা আর কার্যকর নেই। অর্থাৎ তাঁদের অরুণাচল ছাড়তে হবে। মানবাধিকারকর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন, এই মানুষেরা যাবেন কোথায়? কেনই–বা যাবে? কেনই–বা তাঁদের ডেকে নিয়ে অরুণাচলে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল?

যেভাবে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো মুশকিলে

ভারতে কোনো রাজ্যই তার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতার কারণে এখন অপর রাজ্যের অভিবাসী গ্রহণ করার অবস্থায় নেই। ফলে অরুণাচলের চাকমাদের আসামে স্থানান্তরও অতি দুরূহ এক প্রস্তাব। কিন্তু এরপরও এই বিতর্ক তৈরি করা হলো কেন?

হয়তো ভোটের আগে স্থানীয় লোকজনকে খুশি করতে। তবে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়, যেসব কারণে ১৯৬২ সালের পর অরুণাচল সীমান্তে চাকমা-হাজংদের পুনর্বাসিত হতে ‘কর্তৃপক্ষ’ সদয় ছিল, সে রকম বাস্তবতা এখন নতুন উদ্যমে হাজির দেখা যাচ্ছে চীন-ভারত সীমান্তের দুই দিকেই।

২০২০ সালে লাদাখে চীন-ভারত সংঘাতের পরই উভয় দেশ তাদের সব জনমানবশূন্য সীমান্ত এলাকায় কৃত্রিম ‘গ্রামাঞ্চল’ পত্তন করার উদ্যোগ নেয়। অমিত শাহ এ বছরের ২৫ জানুয়ারি রীতিমতো জনসভায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন অরুণাচল, সিকিম, হিমাচল, লাদাখ ও উত্তরাখন্ডে আগামী ১০ বছরের মধ্যে তিন হাজার ‘গ্রাম’ গড়ে তোলা হবে। বাস্তবে ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারি থেকে এই কর্মসূচি চালুও হয়ে গেছে।

চীনও সীমান্তে তার দখলে থাকা এলাকায় ‘শাওকং’ নামের ‘বর্ডার ডিফেন্স ভিলেজ’ তথা সীমান্ত গ্রাম বানাচ্ছে। ভারতও অনুরূপ কর্মসূচি নিয়ে এগোচ্ছে। ভারতীয় অংশে ১৯টি জেলাজুড়ে প্রায় ৩ হাজার ৪০০ কিলোমিটার সীমান্তে বাস্তবায়ন শুরু হওয়া এই কেন্দ্রীয় কর্মসূচির দাপ্তরিক নাম ভিভিপি বা ‘ভাইব্রেন্ট ভিলেজ প্রোগ্রাম’। কেবল অরুণাচলে হবে এ রকম ৪৫৫টি নতুন গ্রাম।

স্বাভাবিকভাবেই এসব গ্রামে বহু জায়গা থেকে বহু নতুন মানুষের বসতি হবে। যেভাবে নেহরুর আমলে হয়েছিল অরুণাচলের সীমান্ত এলাকায়। উভয় দেশ এভাবে এসব এলাকায় যার যার ভৌগোলিক ও জনমিতিক দাবি পোক্ত করতে চায়।

প্রশ্ন হলো চাকমাদের তাহলে ৬০ বছর পর শুধু শুধু উৎকণ্ঠায় ফেলা কেন? ক্ষুদ্র জাতিগুলো দক্ষিণ এশিয়ায় আর কতকাল বড়দের ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনার ভার বইবে?

  • আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক