মতামত

সাংবাদিকতা মানে ‘কুমিরভরা পুকুরে সাঁতার কাটা’

বাংলাদেশে সাংবাদিকতার কপাল সব সময়ই মন্দ। যে গণতন্ত্র আর সার্বিক মানবিক স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ আর এর আগের আন্দোলনগুলো হলো, কথা বলা ও মতপ্রকাশের অধিকার ছিল তার ভিত্তি। আর এর প্রাণই ছিল সাংবাদিকতা চর্চার অবাধ স্বাধীনতা।

মুক্ত সাংবাদিকতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পৃথিবীব্যাপী মানবাধিকার রক্ষার মূল ভিত্তি। এটা কথার কথা নয়। ১৯৫৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারিতে সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে আলোচনার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদে কী বলেছিলেন, আমরা একটু ফিরে দেখি।

স্পিকারের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আপনারা বলে থাকেন যে বাক্‌স্বাধীনতা মানেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। আপনি কি জানেন যে সম্পাদকদের ডেকে বলা হয়, আপনারা এটা ছাপাতে পারবেন না, আপনারা ওটা ছাপাতে পারবেন না। স্যার, তাঁরা সত্য কথা পর্যন্ত লিখতে পারেন না এবং আমি সেটা প্রমাণ করে দিতে পারি।...নির্দেশটা যায় সচিবালয় থেকে...। সরকারের তরফ থেকে একজন ইন্সপেক্টর গিয়ে নির্দেশনা দেন যে আপনি একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে লিখতে পারবেন না।’

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২০টি ধারার মধ্যে ১৪টিই অজামিনযোগ্য। শাস্তি এক, চার ও সাত বছর থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্ত। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ১ হাজার ২৯৫টি মামলার তথ্য সংগ্রহ করে দেখেছে, বিরোধী দলের রাজনীতিবিদদের পর এই আইনে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয়েছেন সাংবাদিকেরা।

এর পর সংবিধানে কী অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে, তার একটা স্পষ্ট প্রস্তাব দেন, ‘এটা পরিষ্কারভাবে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকবে, তাঁরা তাঁদের ইচ্ছামতো বক্তব্য লিপিবদ্ধ করতে পারবেন এবং জনমত গড়ে তুলতে পারবেন।’

আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিধিতে সাংবাদিকতা চর্চায় স্বাধীনতার পরম প্রতিশ্রুতি তাই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এক অন্তর্গত বাস্তবতা। অথচ সত্য হলো, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সাংবাদিকতা চর্চার ক্ষেত্র রাষ্ট্রের তরফ থেকে ক্রমাগত সংকুচিত করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর অধিকাংশ সংবাদপত্রের প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই বছরের ১৫ আগস্টে সপরিবার বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর দেড় দশক ধরে চলে সামরিক শাসন। সামরিক শাসনে যেখানে গণতন্ত্রই নেই, সেখানে মুক্ত সাংবাদিকতার প্রশ্নই বা ওঠে কোথায়! স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের আমলের শেষ দিকে ছোট ছোট বিষদাঁতওয়ালা কিছু পত্রিকা তাঁকে নাস্তানাবুদ করে ফেলে। কোনো কারণ না দেখিয়ে পত্রিকার নিবন্ধন বাতিল করার একটি নিবর্তনমূলক আইন তিনি সেগুলোর ওপর অহরহ প্রয়োগ করেন।

এরশাদ সরকারের পতনের আন্দোলনে সাংবাদিকেরা সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর সরকার পতন আন্দোলনের শেষের দিনগুলোতে সাংবাদিকেরা তাতে একাত্মতা জানিয়ে পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাঁর পতনের পর অতি অল্প সময়ের স্বস্তি আসে সাহাবুদ্দীন আহমদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়। সাংবাদিকদের দাবি মেনে তিনি পত্রিকার নিবন্ধন বাতিলের সেই নিবর্তনমূলক আইনটি রদ করে দেন।

এক অর্থে বাংলাদেশে মুক্ত সাংবাদিকতা চর্চার সেটাই সূচনা। আমরা ভেবেছিলাম পুনরুদ্ধার করা গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংবাদিকতার সুবাতাসও বইতে শুরু করেছে। কিন্তু যে দেশে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা এবং রাষ্ট্রপ্রধানের হত্যাকারীদের বাঁচানোর মতো আইনও প্রণীত হতে পারে, সে দেশে সবই সম্ভব। আমাদের পুনরুদ্ধার করা গণতন্ত্রের ৩৩ বছরে সাংবাদিকতার সঙ্গে রাষ্ট্রের আচরণ কলঙ্কজনক।

এই সময়ের মধ্যে সাংবাদিকেরা নানাভাবে হেনস্তা, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। নিষিদ্ধ হয়েছে অনেকগুলো পত্রিকা ও টেলিভিশন। ধারাবাহিকভাবে এসব ঘটনার প্রবণতা অভিন্ন। যাঁরাই নির্যাতন বা নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছেন, হয় তাঁদের সাংবাদিকতা বিদ্যমান সরকারকে সমালোচনার মুখে ফেলেছে, অথবা সরকারগুলো মনে করেছে তাঁরা বিরোধী পক্ষের।

বিএনপি সরকার বন্ধ করেছিল অসম্ভব জনপ্রিয় একুশে টেলিভিশন, সরকারবিরোধী বলে পরিচিত পত্রিকা আমার দেশ বন্ধ করে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকারের মনোভাবে এ ক্ষেত্রে পরম ঐক্য লক্ষ করা যায়।

এ তো গেল বন্ধ করার কথা। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা আর সরকারে সমালোচনামূলক মতামত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দলীয় কর্মীদের দিয়ে হামলা ও মামলা করে এবং একের পর এক নিবর্তনমূলক আইন প্রয়োগ ও প্রণয়ন করে অসম্ভব আতঙ্কজনক পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমগুলোকে নিগ্রহ করার আইন প্রয়োগের কোনো বাছবিচার দেখা যায়নি। ২০২১ সালের মে মাসে প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে স্বাধীন দেশে ব্যবহার করা হয়েছিল উপনিবেশ আমলে কলোনির প্রজাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য প্রণীত অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট।

সাংবাদিকতাকে ধরাশায়ী করার জন্য এই সরকারের শাসনামলে প্রণয়ন করা হয়েছে সবচেয়ে বিপজ্জনক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। ডিজিটাল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ওটিটি নীতিমালা, ডেটা সুরক্ষা বিধি এবং গণমাধ্যমকর্মী আইনও সামনে আসছে, যার অনেকগুলোর নিবর্তনমূলক ধারা সম্পর্কে এরই মধ্যে সংবাদ ও মানবাধিকারকর্মীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২০টি ধারার মধ্যে ১৪টিই অজামিনযোগ্য। শাস্তি এক, চার ও সাত বছর থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্ত। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ১ হাজার ২৯৫টি মামলার তথ্য সংগ্রহ করে দেখেছে, বিরোধী দলের রাজনীতিবিদদের পর এই আইনে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয়েছেন সাংবাদিকেরা। এই আইনের বেশ কিছু অজামিনযোগ্য ধারায় সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। নানা কায়দায় কারাভোগের সময় অনিশ্চিত ও দীর্ঘ করে তুলে তাঁদের আচ্ছামতো শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। কারাগারে আটক অবস্থায় মারা যান লেখক মুশতাক আহমেদ। গত মার্চের শেষে একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্য তৈরি কার্ডকে কেন্দ্র করে অসত্য অজুহাতে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং সাভার প্রতিনিধি শামসুজ্জামানকে এই আইনে চরমভাবে হেনস্তা করা হলো।

২০১৮ সালে পাস করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদসহ বিভিন্ন সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠন এ আইনটির যৌক্তিকতা নিয়ে সরবে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে এবং এর বেশ কয়েকটি ধারা বাতিল ও সংশোধনের দাবি তোলেন। আইনমন্ত্রী নানা সময়ে আইনটিতে সংশোধনী আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে এই আইনের প্রায় পাঁচ বছর হতে চলেছে, বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষও হতে চলেছে, আইনমন্ত্রী তাঁর প্রতিশ্রুতি রাখেননি। কিছুদিন আগে তিনি আবার সেই পুরোনো প্রতিশ্রুতিরই পুনরাবৃত্তি করেছেন।

আইনমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষাপট হলো সরকারের কাছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের পাঠানো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে কিছু সুপারিশ। সুপারিশে তারা এই আইনের দুটি ধারা বাতিল এবং আটটি ধারা সংশোধনের কথা বলেছে। এই ধারাগুলোর মধ্যে তারা তিনটি বিপজ্জনক উপাদান দেখতে পেয়েছে: ১. ভিন্নমত প্রকাশের বৈধ মাধ্যমগুলোকে অপরাধ বলে গণ্য করার সংজ্ঞা এবং সে জন্য কঠোর শাস্তির বিধান; ২. ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সিকে ব্যাপক পরিধির ক্ষমতা দেওয়া; ৩. জামিন–অযোগ্য ধারায় বিচারের আগেই দীর্ঘ বন্দিত্ব।

এই আইন যে সাংবাদিকদের হেনস্তা ও আতঙ্কিত করে তোলার জন্য অহরহ প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা একটা সত্য। কিন্তু বিষয়টির এখানেই শেষ নয়। এই আইনের ধারাগুলো এমনভাবে লেখা হয়েছে, যা সাংবাদিকতাকেই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রুদ্ধ করে ফেলেছে।

শাস্তির বাইরেও এই আইনের কিছু ধারায় খবরের জন্য মোবাইলে তথ্য নথির ছবি তোলাকে অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সিকে সন্দেহের বশেও সংবাদমাধ্যমের অফিসে ঢুকে সার্ভারের যন্ত্রপাতি জব্দ করার সর্বময় এখতিয়ার দিয়েছে। এই যুগে এর সরল অর্থ হচ্ছে সংবাদমাধ্যমটির প্রকাশ ও প্রচার দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ করে দেওয়া। সত্য হলো প্রকৃত সাংবাদিকতা বলতে যা বোঝায়, এই আইনটি জারি রেখে তার চর্চা করা অসম্ভব। এসব কারণে অনেক মানবাধিকার সংগঠন এর সম্পূর্ণ বিলোপ চাইছে।

২০২২ সালে গণমাধ্যমসংক্রান্ত বিভিন্ন আইন নিয়ে সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মতো দেশে সাংবাদিকতা হচ্ছে পুকুরের মধ্যে অনেকগুলো কুমির ছেড়ে বলা হলো এপার থেকে ওপারে সাঁতার কেটে যাও।’ এর চেয়ে সত্য আর কিছু হতে পারে না।

বঙ্গবন্ধু সেদিন গণপরিষদে যে প্রস্তাব রেখেছিলেন, তার প্রতিফলন দেখা যাবে আমাদের সংবিধানে। সংবিধানের ৩৯ (১)-এর (খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ ‘সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা’ ইংরেজি সংবিধানের ‘ফ্রিডম অব দ্য প্রেস’-এর হুবহু তরজমা নয়। সাংবিধানিক বিচারে ইংরেজির ওপরে থাকা বাংলা সংবিধানের ‘সংবাদক্ষেত্র’ শব্দটিতে একটু বেশি কিছু আছে।

সংবিধানের অন্যতম অনুবাদক প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাছে বর্তমান নিবন্ধকার এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, এই অনুবাদটি নিয়ামাল বাসিরের করা। তিনি অনুবাদে এই শব্দটি ব্যবহার করার পর সবাই চমৎকৃত হয়েছিলেন। কারণ, খবরের উপাদান আহরণ করা থেকে পরিবেশন করা পর্যন্ত সাংবাদিকতার বিস্তৃত পরিসর ‘সংবাদক্ষেত্র’ শব্দটির মধ্যে নিহিত রয়েছে।

সংবিধান আমাদের মুক্ত সাংবাদিকতার যে বিস্তৃত অধিকার দিয়ে রেখেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমাদের কাছ থেকে তা হরণ করেছে।

  • সাজ্জাদ শরিফ প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক ও কবি