রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা। কিন্তু তাঁরা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দখল-দূষণের হাত থেকে সেই পরিবেশ রক্ষার কাজ তো করছেনই না, উল্টো নিজেরাই পরিবেশ ধ্বংসের কাজে লিপ্ত রয়েছেন। বন, পাহাড়, নদীর রক্ষকেরাই কীভাবে ভক্ষকে পরিণত হয়েছে, তা নিয়ে লিখেছেন কল্লোল মোস্তফা
তুরাগ নদের অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের একটি রিট আবেদনের (রিট পিটিশন নম্বর ১৩৯৮৯/২০১৬) পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে হাইকোর্ট বাংলাদেশের নদী রক্ষায় এক ঐতিহাসিক রায় দেন। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ থেকে দেওয়া এই রায়ে তুরাগসহ বাংলাদেশের সব নদ-নদীকে ব্যক্তি আইনি সত্তা বা জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হয়।
এ ছাড়া এ রায়ে আরও কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়া হয়। যার অন্যতম ছিল—পাবলিক ট্রাস্ট মতবাদকে দেশের আইনের অংশ হিসেবে গণ্য করা। হাইকোর্টের এ রায়ে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ক, ২১, ৩১, ৩২ অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, সকল উন্মুক্ত জলাভূমি, সমুদ্র, নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, ঝিল, সমুদ্রসৈকত, নদীর পাড়, পাহাড়-পর্বত, টিলা, বন, বাতাস ইত্যাদি সবকিছুকে পাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তি উল্লেখ করে এগুলোর কোনো একটির অধিকার থেকে নাগরিকদের বঞ্চিত করা সংবিধান পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেন।
আদালতের রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্র হচ্ছে পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, সমুদ্র, সমুদ্রসৈকত, নদ-নদী, নদীর পাড়, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, ঝিল এবং সব উন্মুক্ত জলাভূমি, পাহাড়-পর্বত, বন এবং বন্য প্রাণীর রক্ষক বা ট্রাস্টি।
এখানে জনগণ হলো আমানতকারী এবং রাষ্ট্র হলো আমানতগ্রহীতা। রাষ্ট্র কোনো অবস্থায়ই জনগণের আমানত খেয়ানত করতে পারবে না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা ধ্বংস করা যাবে না।
এ বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্ব সম্পর্কে রায়ে বলা হয়, ‘সকল সরকারি কর্মকর্তা এবং কর্মচারীগণকে মনে রাখতে হবে যে তারা জনগণ কর্তৃক নিয়োগকৃত। আর জনগণ এ নিয়োগ তাকে দিয়েছে সরকারের সহায়তার মাধ্যমে। সুতরাং সকল সরকারি কর্মকর্তা এবং কর্মচারী জনগণের সম্পদের দেখভাল করতে বাধ্য এবং এর কোনো ব্যত্যয় ঘটলে জনগণের নিকট কৈফিয়ত দিতে বাধ্য।’ (হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের রিট পিটিশন নম্বর ১৩৯৮৯/২০১৬–এর বিপরীতে হাইকোর্টের রায়, জানুয়ারি ২০১৯, পৃষ্ঠা ২৫৭-২৬০, ২৭৮-২৭৯)
খেয়াল করার বিষয়, আদালতের রায়ে পাবলিক ট্রাস্ট মতবাদের আওতায় পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের দায়িত্ব শুধু পরিবেশ অধিদপ্তরের ওপর ন্যস্ত করা হয়নি, গোটা রাষ্ট্র এবং সরকারের সব কর্মকর্তা–কর্মচারীকেই এ জন্য দায়বদ্ধ করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র, সরকার এবং সরকারের কর্মকর্তা–কর্মচারীগণ কি জনগণের আমানত এই পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করছেন? চলুন, কিছু ঘটনা খতিয়ে দেখি।
■ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেরাই জলাভূমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করছে, যা আবার বেসরকারি আবাসনপ্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
■ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা সিডিএ একদিকে চট্টগ্রামে পাহাড় কেটে আবাসিক এলাকাসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে, অন্যদিকে নিজেও পাহাড় কেটেছে।
■ পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অবহেলার কারণে দেশের নদ-নদীগুলো ব্যাপক দখল ও দূষণের শিকার হচ্ছে।
বন বিভাগের কাজ হলো দেশের প্রাকৃতিক বনভূমির গাছপালা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা। কিন্তু বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আগ্রাসন থেকে বন বিভাগ দেশের প্রাকৃতিক বনগুলোকে রক্ষা তো করতে পারছেই না, উল্টো নিজেরাই এমন সব প্রকল্প গ্রহণ করছে, যা বনের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনে বন বিভাগ কর্তৃক সাফারি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনার কথা বলা যেতে পারে।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুসারে, সংরক্ষিত বনে স্থাপনা নির্মাণ তো দূরে থাক, বিনা অনুমতিতে মানুষের বনে প্রবেশ পর্যন্ত নিষেধ। সেই বনে বন বিভাগ পাহাড় ও গাছ কেটে ৫ হাজার ৬৩১ একর জায়গাজুড়ে সাফারি পার্ক নির্মাণ করছে।
প্রকল্পের আওতায় বনের মধ্যে রেস্টহাউস, পাকা সড়ক, হেলিপ্যাড, কাচের তৈরি লিফট ও সিঁড়ি বা স্কাইওয়াক নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ ছাড়া সাফারি পার্কে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের বন্য প্রাণী আমদানি করে রাখা হবে। (বনমন্ত্রীর এলাকায় সংরক্ষিত বন কেটে হবে সাফারি পার্ক, ‘আত্মঘাতী’ প্রকল্প বলছেন পরিবেশবিদেরা, ১১ অক্টোবর ২০২৩)
এভাবে বিদেশি বন্য প্রাণী আমদানি ও বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করে মানুষের উপস্থিতি বাড়ানো সংরক্ষিত বনের জন্য ক্ষতিকর বলে পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে এই সাফারি পার্ক নির্মাণে বিরোধিতা করা হলেও নভেম্বর ২০২৩–এ ৩৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সাফারি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা একনেকে অনুমোদনও পেয়ে গেছে। (‘লাঠিটিলা বনেই হবে সাফারি পার্ক’, প্রথম আলো, ১০ নভেম্বর ২০২৩)
রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১৪ মাসে দেশজুড়ে উন্নয়নের নামে প্রায় ১১ লাখ ৪৬ হাজার ৪৬৫টি গাছ কেটেছে সরকারের ২৫টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সংরক্ষিত বনেই গাছ কাটা হয়েছে ৭ লাখ ৬ হাজার ৩২১টি।
এ সময় সবচেয়ে বেশি গাছ কাটা হয়েছে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় সংরক্ষিত বনে, এখানে প্রায় পাঁচ লাখ গাছে উন্নয়নের কোপ পড়েছে। আর এই এক বছরে সবচেয়ে বেশি গাছ কেটেছে বন বিভাগ—৪ লাখ ১৭ হাজার ৭৭৩টি।
আরডিআরসির প্রতিবেদনে আরও যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান গাছ কাটায় জড়িতে বলে উঠে এসেছে, সেগুলো হলো বিদ্যুৎ বিভাগ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, মৌলভীবাজার রেল কর্তৃপক্ষ, কুষ্টিয়া পৌরসভা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, লোহাগাড়া উপজেলা প্রশাসন, নড়াইল জেলা পরিষদ, খুলনা সিটি করপোরেশন, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন, হবিগঞ্জ পৌরসভা, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), সিলেট সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং সৈয়দপুর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। (‘সাড়ে ১১ লাখ গাছ “হত্যা” সরকারি সংস্থার কোপে’, সমকাল, ৫ জুন ২০২৪)
পরিবেশের ভারসাম্য, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রাকৃতিক জলাধার রক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। ঢাকায় এসব জলাভূমি রক্ষার দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের। আর ঢাকার বাইরে জলাভূমি রক্ষার দায়িত্ব হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তর, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভূমি অফিসের।
কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও আবাসনপ্রতিষ্ঠানের আগ্রাসন থেকে জলাভূমি রক্ষার দায়িত্ব পালন করছে না। বরং বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেরাই জলাভূমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করছে, যা আবার বেসরকারি আবাসনপ্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
এ বিষয়ে সমকাল–এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, কীভাবে খোদ রাজধানী ঢাকাতেই সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একের পর এক জলাধার ভরাটের ঘটনা ঘটেছে। যেমন ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপে প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত ঢাকার গৈদারটেক ও কল্যাণপুরের ১২ একর জলাভূমি ভরাট করেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। আধুনিক পদ্ধতিতে বীজ আলু উৎপাদনের লক্ষ্যে ‘সেন্ট্রাল টিস্যু কালচার অ্যান্ড সিড হেলথ ল্যাবরেটরি’ নির্মাণের জন্য এই জলাধার ভরাট করা হয়।
আগারগাঁওয়ে পুকুর ভরাট করে ভবন নির্মাণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। কুড়িলে রেলওয়ের জলাধার ভরাট করে অবকাঠামো তৈরির সুযোগ দেওয়া হয় মিলেনিয়াম হোল্ডিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে।
হাতিরঝিলের কারওয়ান বাজার অংশ ভরাট করেছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ। রাজধানীর আশকোনায় বিশাল আয়তনের জলাশয় ভরাট করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। বাসাবো, নন্দীপাড়া, খিলগাঁও, রামচন্দ্রপুর, কাটাসুর, সেগুনবাগিচা, ধোলাইখাল, বেগুনবাড়ি, রূপনগর, বাউনিয়াবাদসহ ১০টি খালে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা সড়ক, সেতু ও বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে। নাসিরাবাদ ইউনিয়ন হিসেবে পরিচিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসিসি) ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের জলাভূমির মধ্য দিয়ে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণ করেছে ডিএসিসি। এরপর বেসরকারি আবাসনপ্রতিষ্ঠানগুলো পুরো এলাকার বিভিন্ন জলাভূমি একে একে ভরাট করতে শুরু করে। (‘জলাধার ভরাটের দৌড়ে এগিয়ে সরকারি সংস্থা’, সমকাল, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা সিডিএ একদিকে চট্টগ্রামে পাহাড় কেটে আবাসিক এলাকাসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে, অন্যদিকে নিজেও পাহাড় কেটেছে। সিডিএ মাত্র ৬ কিমি দৈর্ঘ্যের ফৌজদারহাট-বায়েজিদ বোস্তামী সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে ১৫টি পাহাড় কেটেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর এ সময় সিডিএকে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করে দায় সেরেছে। সিডিএর পাহাড় কাটার পর ওই সড়কের আশপাশে ভূমিদস্যুরাও পাহাড় কাটা শুরু করে। (‘পাহাড় নিঃশেষ, বিপন্ন চট্টগ্রামের পরিবেশ’, প্রথম আলো, ৩০ জানুয়ারি ২০২০)
সিডিএ ছাড়াও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম ওয়াসা, গণপূর্ত অধিদপ্তর, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ রেলওয়ে ও মেট্রোপলিটন পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় পাহাড় কাটার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নগরের ফয়’স লেকের পেছনে ‘লেকসিটি আবাসন প্রকল্পের’ মাটি ভরাট করার জন্য পাহাড় কেটেছে। (‘আইনি মোড়কে সর্বনাশা সিডিএ’, দেশ রূপান্তর, ২৪ আগস্ট ২০২৩; ‘চট্টগ্রামে পাহাড় কাটছে সিটি করপোরেশন!’, প্রথম আলো, ২৪ জানুয়ারি ২০১৪)
পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অবহেলার কারণে দেশের নদ-নদীগুলো ব্যাপক দখল ও দূষণের শিকার হচ্ছে। শুধু তা–ই নয়, রাষ্ট্রমালিকানাধীন কারখানাগুলো থেকেও বায়ু এবং পানিদূষণ ঘটছে। যেমন যমুনা সার কারখানা থেকে অ্যামোনিয়া বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে এর আশপাশের এলাকা।
১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কারখানাটি গ্যাস সংকটের কারণে সারা বছর চলতে পারে না কিন্তু যখন চলে তখন কারখানা থেকে নির্গত অ্যামোনিয়ার দূষণে আশপাশের পাঁচ গ্রামের বিপুলসংখ্যক মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। শুরু থেকেই এটি পাশের যমুনা ও এর শাখানদ–নদীসহ জলাশয়গুলো দূষণ করে আসছে। প্রতিষ্ঠার পর ৩৩ বছর পার হলেও এই গুরুতর সমস্যার সমাধান করা হয়নি। ফলে নদীতে মাছ কমে গেছে, জমিতে ফসল উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে এবং স্থানীয় মানুষ চক্ষুরোগ, চর্মরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। (‘যমুনা সার কারখানা, না “দূষণের কারখানা”’, ডেইলি স্টার বাংলা, ৯ জানুয়ারি ২০২৩)
রাষ্ট্রমালিকানাধীন বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রর কারণে থেকে বড়পুকুরিয়া ও আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে বায়ু ও পানিদূষণ ঘটেছে। অনেক বাড়িঘরে ফাটল ধরেছে, কুয়া, নলকূপ ও পুকুরের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে এবং বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। (‘বাড়িঘরে ফাটল, ঝুঁকি নিয়ে বাস’, প্রথম আলো, ৬ মে ২০১৯; ‘বড়পুকুরিয়ায় ক্ষতিপূরণের দাবিতে দুই গ্রামের মানুষের মানববন্ধন’, প্রথম আলো, ১৮ অক্টোবর ২০২১)
কাজেই দেখা যাচ্ছে, যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা, তাঁরা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দখল-দূষণের হাত থেকে সেই পরিবেশ রক্ষার কাজ তো করছেনই না, উল্টো নিজেরাই পরিবেশ ধ্বংসের কাজে লিপ্ত রয়েছেন। তাঁরা সংরক্ষিত বনকে পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত করছেন, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে প্রকৃতিবিরোধী নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করছেন, গাছ কাটছেন, পাহাড় কাটছেন, জলাধার ভরাট করে ভবন নির্মাণ করছেন, দূষণকারী কয়লা ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছেন, নদীদূষণ করছেন।
কিন্তু এসব প্রাণপ্রকৃতি-পরিবেশবিরোধী কার্যক্রমের জন্য যারা দায়ী, তাদের ‘দায়মুক্তি’ দেওয়া হচ্ছে। কারণ, তাদের জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা কার্যত নেই। এভাবে জনগণের যে আমানত রক্ষা সরকারি প্রতিষ্ঠান ও তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাগত দায়িত্ব, সেই দায়িত্ব তাঁরা পালন করছেন না, উল্টো আমানতের খিয়ানত করে বাংলাদেশের জনগণের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছেন।
●কল্লোল মোস্তফা লেখক-গবেষক