যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে দুর্দমনীয় গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন। হোয়াইট হাউসে তাঁর ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব যৌক্তিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্রদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এটি প্রায় নিশ্চিত, ২০২৪ সালের নির্বাচনে জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘পুনর্মিলন’ দেখা যাবে। এ কারণে দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার বিষয়ে ইউরোপকে প্রস্তুতি নিতে হবে।
সন্দেহ নেই, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের গত মেয়াদ ইউরোপের জন্য বেদনাদায়ক ছিল। ইরান চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার মতো ট্রাম্পের অনেক পদক্ষেপ ইউরোপের দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে নীতিগত বিভাজন বাড়িয়েছে। ট্রাম্পই প্রথম আমেরিকান প্রেসিডেন্ট, যিনি ইউরোপকে পরিবারভুক্ত বলে বিবেচনা করেননি। ইউরোপের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতাদের চেয়ে তিনি সি চিন পিং ও ভ্লাদিমির পুতিনের মতো কর্তৃত্ববাদীদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলেন বলে মনে হচ্ছিল।
ইউরোপের প্রতি ট্রাম্পের বিদ্বেষী মনোভাব এখনো বদলায়নি। তিনি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এলে গতবারের চেয়ে এই দফায় ইউরোপের স্বার্থবিরোধী আরও বড় ধরনের নীতি গ্রহণ করতে পারেন। ট্রাম্পের গত মেয়াদে নেওয়া অনেক নীতি ও সিদ্ধান্ত অভ্যন্তরীণভাবে ত্রুটিপূর্ণ ও অকার্যকর বলে অনেকের কাছে সাব্যস্ত হয়েছে। তাঁর নীতি মেনে নিতে না পেরে একের পর এক শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ট্রাম্প যদি দ্বিতীয় দফায় গদিতে বসেন, তাহলে অভ্যন্তরীণ বিরুদ্ধতা আগের মতো থাকবে না। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ আরও সুসংহত ও সুনির্ধারিত হতে পারে।
এর আগের দফায় ট্রাম্পকে নিয়ে যেমন রিপাবলিকান শিবিরে মতবিরোধ ছিল, এবার তা যেহেতু থাকবে না, সেহেতু ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ নীতি পালন করবে। এর সঙ্গে একটি পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট যুক্ত হবে, যা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। ইউরোপ ইতিমধ্যে দুটি যুদ্ধের কারণে ধাক্কার শিকার হয়েছে। এরই মধ্যে একটি যুদ্ধ এই মহাদেশেই চলছে।
ট্রাম্প বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ২০২০ সালে যে জায়গায় রেখে গিয়েছিলেন, দ্বিতীয় মেয়াদে এসে সেখান থেকে ফের শুরু করবেন। জাতিসংঘসহ ইতিমধ্যে দুর্বল হয়ে পড়া বহুপক্ষীয় ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করতে থাকবেন। গণতান্ত্রিক শৈত্যপ্রবাহ তখন যুক্তরাষ্ট্রের সীমানায় আটকে থাকবে না। এই হিম হাওয়া ইউরোপ থেকে শুরু করে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে।
না ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার শেষ দেখা যাচ্ছে; না মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল–হামাস যুদ্ধের শেষ দেখা যাচ্ছে। পুতিন ও নেতানিয়াহু যেসব কারণে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করছেন, তার মধ্যে ট্রাম্পের সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তন একটি বড় কারণ হয়ে থাকতে পারে। ধারণা করি, ইউরোপের কৌশলগত পরিস্থিতি এখন যতটা ভয়াবহ অবস্থায় আছে, আগামী নভেম্বরের পর তা আরও ভয়ংকর দিকে যেতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ ইউরোপে কী প্রভাব ফেলবে? জবাবে বলা যায়, অর্থনীতি ও মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে ইউরোপের দেশগুলোর মতপার্থক্য তীব্রতর হবে। বাইডেনের মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস আইন পাস কিংবা গাজায় ইসরায়েলকে অবাধে হামলা চালাতে দেওয়ার মধ্যে ট্রান্স আটলান্টিক সম্পর্ক মসৃণ রাখা সহজ ছিল না। তবে ট্রাম্প এলে এসব বিষয় নিয়ে ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে গভীর চিড় ধরবে।
সম্ভবত ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থার একেবারে উল্টো অবস্থানে চলে যাবেন ট্রাম্প। ওয়াশিংটনের ‘শান্তি’বিষয়ক প্রস্তাব মেনে না নিলে রাতারাতি কিয়েভের পতন ঘটানো হবে বলে ট্রাম্প অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন। ইউক্রেনের সঙ্গে চুক্তি থাকুক বা না থাকুক, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সহায়তা দেবে, তা মনে করা কঠিন। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ছেড়ে এলে মস্কোর সাহস অনেক গুণ বেড়ে যাবে এবং ক্রেমলিনের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাভিলাষ ইউক্রেনের সীমানা ছাড়িয়ে যেতে চাইবে। পুতিনের যদি মনে হয় ট্রাম্প তাঁকে থামাতে আঙুল তুলবেন না, তাহলে তিনি ন্যাটোকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারেন।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ আমেরিকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকেও খর্ব করবে এবং সম্ভবত মারাত্মকভাবেই তা করবে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চারটি মারাত্মক ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ামাত্রই এই মামলাগুলোর ইস্যুতে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করবেন।
ট্রাম্প বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ২০২০ সালে যে জায়গায় রেখে গিয়েছিলেন, দ্বিতীয় মেয়াদে এসে সেখান থেকে ফের শুরু করবেন। জাতিসংঘসহ ইতিমধ্যে দুর্বল হয়ে পড়া বহুপক্ষীয় ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করতে থাকবেন। গণতান্ত্রিক শৈত্যপ্রবাহ তখন যুক্তরাষ্ট্রের সীমানায় আটকে থাকবে না। এই হিম হাওয়া ইউরোপ থেকে শুরু করে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে।
● নাটালি টোসি দ্য গার্ডিয়ান–এর ইউরোপবিষয়ক কলাম লেখক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া; ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত