মতামত

মোরসালিনের মায়ের কথায় শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ‘গা জ্বালা’ কেন?

একটা কৌতুক দিয়ে শুরু করি। এক ভদ্রলোক বন্ধুদের আড্ডায় বলছিলেন, আমার এক ছেলে ডাক্তার, এক ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, এক ছেলে শিক্ষক হলেও আরেক ছেলে সন্ত্রাসী, রাজনৈতিক দলের গুন্ডা। ওই সন্ত্রাসী ছেলেটাকে বের করে দিচ্ছো না কেন ঘর থেকে? বন্ধুরা একসঙ্গে বলে উঠল। কীভাবে বের করি বলো! ওই তো সবচেয়ে বেশি টাকা কামায়, উত্তর দেন বাবা।

গল্পটা মনে পড়ল বাংলাদেশের তরুণ ফুটবলার মোরসালিনের সাফল্যে তাঁর মায়ের গর্ব আর সেই গর্বের বিপরীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে আক্রমণ করা নিয়ে। বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল ২০ বছর পর গতকাল মালদ্বীপকে হারাতে পেরেছে। খেলার শেষ দিকে আঠারো বছরের তরুণ মোরসালিন এক চোখধাঁধানো গোল করে জয় নিশ্চিত করেন। আমার সহকর্মী, প্রথম আলোর সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ আলম এর পরপরই মোরসালিনের মায়ের অনুভূতি জানতে চান।

তিনি জানান, ছেলেকে খেলার ব্যাপারে তিনি উৎসাহ দিতেন না। ছেলে মামার বুট ধার করে খেলত। এমনকি বৃত্তির টাকাতে বুট কিনলেও মায়ের ভয়ে সেই বুট বাসায় আনার সাহস পায়নি। সৌদিপ্রবাসী স্বামীর টাকাতে সংসার চালানো মোরসালিনের মা চাইতেন ছেলে কেবল পড়াশোনা করুক, খেলা থেকে দূরে থাকুক। কিন্তু এখন ছেলের সাফল্যে তিনি গর্বিত।

এই শেষ লাইনটা বলে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষত ফেসবুকে রোষের শিকার হন। যে মা ছেলেকে ফুটবল খেলতে দিতেন না, তিনিই ছেলের ফুটবল-সাফল্যে গর্ব করায় তাঁকে কেউ কেউ ‘বিষাক্ত মা’, ‘ভণ্ড’ ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত করছেন। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের উদারনীতির নিক্তি দিয়ে মাপলে এই মাকে ‘ধান্দাবাজ’ বলেই মনে হতে পারে। তিনি স্বপ্নের পথে বাঁধা হয়ে থাকেন; কিন্তু স্বপ্ন সফল হলে গৌরব করেন। এ কেমন দ্বিচারিতা!

কিন্তু এই আপাত দ্বিচারিতার ব্যাপারটা একটু তলিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে পাওয়া যাবে, আমাদের গভীর কিছু সামাজিক সমস্যা, খেলাধুলায় পিছিয়ে পড়ার আর্থসামাজিক পটভূমি, আর খসে পড়বে সদা ভালো মানুষটি সেজে থাকা উদারতাবাদীদের মুখোশ।
প্রথমেই বলা গল্পটায় ফিরে যাই। গল্পটা বাড়াবাড়ি মনে হলেও এর পেছনে অনেকটাই সত্য লুকানো। তবে সেইখানেও একটা ‘কিন্তু’ আছে। সন্ত্রাসীরা সবচেয়ে বেশি অর্থ ও ক্ষমতা উপভোগ করলেও অন্যান্য পেশায় থাকা তাঁর ভাইয়েরাও এর কাছাকাছি উপভোগ করতে পারেন। যদি তাঁরা অসৎ হন। বেতনের বাইরে ‘উপরির’ ব্যবস্থা করতে পারেন।

আমরা এমন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারিনি, যেখানে মোরসালিনরা নিশ্চিন্তে খেলতে পারে, মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় রিকশাওয়ালার ছেলে আর শিল্পপতির ছেলের পার্থক্য থাকবে না, সাফজয়ী নারী ফুটবলাররা বাস্তবের চাপে একে একে খেলা ছেড়ে না দিয়ে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখবে।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আমাদের যে সমাজচিত্র, তা হরেদরে মোটামুটি এই রকমই। গ্রামের সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া মোরসালিনের কথা বাদই দিলাম, এমনকি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে জন্ম নেওয়া তরুণদেরও এখন দুইটা স্বপ্ন: হয় বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি অথবা কোনো ধরনের বৃত্তি জোগাড় করে দেশছাড়া। বিসিএসের প্রতি এই লোভ কেবল যে অন্যান্য পেশার চরম অনিশ্চয়তার বিপরীতে সরকারি চাকরির পরম নিশ্চয়তা আর ক্ষমতা অর্জন তা-ই নয়, ‘উপরির’ লোভও একটা বড় অনুপ্রেরণা। আর দেশছাড়া মানে সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা।

তবে, মাথায় রাখতে হবে যে উচ্চশিক্ষিতের বৃত্তি কিংবা নাগরিকত্ব (মোটা অঙ্কের বিনিয়োগের বিপরীতে) নিয়ে বিদেশগমন আর মোরসালিনের বাবার দেশছাড়ায় কিছুটা পার্থক্য আছে। দেশের বিদেশি মুদ্রা উপার্জনের অন্যতম উৎস এই রেমিট্যান্সযোদ্ধারা দেশ ছাড়েন অনেকটা বাধ্য হয়ে। মিলের জায়গাটা হচ্ছে, এ নিম্নমধ্যবিত্ত অল্পশিক্ষিত তরুণদেরও এই দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সংকট আর আর্থসামাজিক নিরাপত্তাও অপ্রতুল। সে এক বড় আলাপ।

আবার মোরসালিনের মায়ের কথায় ফিরে যাই। আজকে প্রথম আলোর প্রথম পাতার শীর্ষ সংবাদটি হচ্ছে, দেশের শীর্ষ দশ ভাগ ধনীর হাতে আয় ৪১ শতাংশ। দেশের সম্পদ/ উপার্জন কতটা অসমভাবে বণ্টিত, তা মাপা হয় গিনি সহগ দিয়ে। গত বছরের তথ্যমতে এই ইন্ডেক্সে বাংলাদেশের স্কোর ০.৬৬১ (০ মানে সমবণ্টিত, আর ১ মানে একজনের কাছেই সব সম্পদ), অর্থাৎ বাংলাদেশের সম্পদের বণ্টন অনেকটাই অসম।

শুধু তা-ই নয়, গ্রাম বনাম শহরে এই বৈষম্য আরও প্রকট। কারণ, তা কেবল অর্থ নয়, সামাজিক ক্ষমতায়নের বেলাতেও প্রযোজ্য। শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যদি যথেষ্ট বিত্তের মালিক না-ও হন, তাঁর সামাজিক প্রভাব ও ক্ষমতা গ্রামের লোকের তুলনায় বেশি।

বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে এসব অসাম্য দূর করার একমাত্র উপায় হিসেবে দেখা হয় শিক্ষাকে। যদিও শিক্ষা সোশ্যাল মোবিলিটি তথা সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তনের নিশ্চয়তা দেয় না, কিন্তু মোরসালিনের মায়ের মতো মানুষের একমাত্র আশা এই যে, তাঁর ছেলে ‘জজ-ব্যারিস্টার’ হয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বাপের মতো একা একা দূরদেশে জীবন কাটাতে বাধ্য হবে না। আর তাই যেকোনো মূল্যে তাঁকে লেখাপড়া শেখাতে চান।

‘আমরা এমন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারিনি, যেখানে মোরসালিনরা নিশ্চিন্তে খেলতে পারে...’

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এখানেও মোরসালিনেরা প্রবল অসাম্য আর বাধার মুখোমুখি হন। কাগজে-কলমে জাতপাতের ব্যবস্থা উঠে গেল অদৃশ্যভাবে সেই ব্যবস্থা চালু আছে। শূদ্রের ছেলে শূদ্র হবে, চা-বাগানের কুলির ছেলে সারা জীবন সেখানেই পচে মরবে, রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের সন্তানেরা সস্তা শ্রমিক হয়ে দেশের জন্য টাকা আনবে, এই ব্যবস্থাই বিরাজ রাখা আছে। ফলে মোরসালিনদের অবস্থার উন্নতিতে প্রবল বাধা বিদ্যমান। সেই আলাপটাও আরেক লম্বা বিশ্লেষণ।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, প্রোষিতভর্তৃকা মোরসালিনের মায়ের পক্ষে ছেলের খেলাধুলাকে সমর্থন দেওয়া আত্মহত্যার শামিল। এই চরম অসাম্যর ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে তাঁর পক্ষে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মতো উদারতাবাদ দেখানো সম্ভব নয়। কোনোমতে টিকে থাকা মানুষটার একমাত্র আশা ছেলে জজ-ব্যারিস্টার হওয়া, খেলোয়াড় নয়।

কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, খেলোয়াড়েরা তো কোটি কোটি কামায়। সেই উজ্জ্বল গল্পটাও আসলে অনেক অন্ধকার ঢেকে দেয়। কোটিতে একজন সাকিব আল হাসান হন, লাখে একজন জাতীয় দলে খেলেন। বাকিরা? টিকে থাকার জন্যই তাঁদের লড়াই করতে হয়।

উন্নত দেশগুলোতে মাঝারি মানের খেলোয়াড়দেরও আর্থিক সামাজিক নিরাপত্তা থাকে। প্রথম বিভাগে না পারলেও, দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা আরও নিচের বিভাগে খেলা হয়। নানা রকম সরকারি-বেসরকারিভাবে কর্মসংস্থান করা হয়। একসময় বিজেএমসি, বিটিএমসির মতো প্রতিষ্ঠান এই দেশে সেই কাজ কিছুটা করলেও এখন আর সেই চর্চা নেই বললেই চলে। এখানে পড়ালেখা বাদ দিয়ে খেলার দিকে ঝুঁকে পড়া, যেই জীবনে একটা চোট পুরো ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে পারে, নেহাতই একটা জীবন জুয়া।

মোরসালিনের মা বাচ্চা ছেলের শখের মূল্য দিতে গিয়ে তাঁকে এই জুয়ায় ঠেলে দেবেন, এটা ভাবাই তো অবিমৃশ্যকারিতা। একটা সময় সমাজ তাঁর সদস্যদের দায়িত্ব নিত, কিন্তু এখন সেই জায়গা নিয়েছে রাষ্ট্র আর বাজার। মুক্তবাজার অর্থনীতি আর নিওলিবেরাল যুগে রাষ্ট্র মোরসালিনদের প্রতি ন্যূনতম দায়িত্বও পালন করে না, তাঁদের জন্য নিরাপত্তার জাল মেলে দেয় না, এটা জেনেও মা কেন এই ঝুঁকি নেবেন?

মোরসালিনের আলাপে আরেকটা পর্যবেক্ষণ বলে রাখি। বাংলাদেশ ম্যাচ জয়ের পর টেলিভিশনের সাংবাদিক আরেক গোলদাতা রাকিবের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। প্রশ্নটা ইংরেজিতে করলেও রাকিব বাংলায় উত্তর দেন। বাংলাদেশে জাতীয় দলে যাঁরা খেলেন, অধিকাংশই উচ্চশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পান না অথবা সে রকম পরিবার থেকে আসেন না।

প্রশ্ন আসতে পারে, সেসব পরিবারের ছেলেরা কেন খেলতে আসেন না, যেসব উদারবাদীরা ‘আমার ছেলেমেয়ে যা চায় তাই হবে বলে বেড়ান’? তাঁদের ছেলেমেয়েরা কেন ফুটবলার হন না ? বিদেশি লীগ নিয়ে সারা দিন পড়ে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর প্রায় সবাই শেষতক করপোরেট চাকরি কিংবা বাপের ব্যবসাতেই মন দেন কেন? কারণটা ওপরেই বলা হয়েছে, এই দেশে খেলাধুলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

মোরসালিন আর রাকিবরাই শেষতক দেশের জন্য গর্ব বয়ে আনেন। এত বাধার পরও তাঁদের অদম্য ইচ্ছাশক্তি তাঁদের এগিয়ে নেয়। আর, আমরা তথা শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা কী করি? তাঁরা জিতলে তাঁদের নিয়ে গর্ব করি। মোরসালিন গোল দিলে বড় ছবি ছাপি, গরিবের ছেলে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় টিকলে বড় করে সংবাদ করি। মেয়েরা ট্রফি আনলে ঢাকার রাস্তার তাঁদের সংবর্ধনা দিই।

এসব আমরা করি নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে। আমরা এমন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারিনি, যেখানে মোরসালিনরা নিশ্চিন্তে খেলতে পারে, মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় রিকশাওয়ালার ছেলে আর শিল্পপতির ছেলের পার্থক্য থাকবে না, সাফজয়ী নারী ফুটবলাররা বাস্তবের চাপে একে একে খেলা ছেড়ে না দিয়ে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখবে।

অথচ, আমরা গালভরে গর্ব করি মুক্তিযুদ্ধের। যেই যুদ্ধের বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল যথাসম্ভব অসাম্যর সমাজ গড়ার। সেই স্বপ্নে নেতৃত্ব দিয়েছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সেই লড়াইটা ছিল ভূমিমালিক এলিট শ্রেণির বিরুদ্ধে।

শিক্ষিত মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে থাকা সেই দেশ এখন আর্থসামাজিক অনায্যতা আর অসাম্যর উর্বর ভূমি। একসময় আমরা দুর্নীতিকে অন্তত সামাজিকভাবে বাধা দিতাম, প্রবল ঘৃণা করতাম, অথচ এখন তা হয়ে উঠেছে আদরণীয়, প্রথমে উল্লিখিত গল্পটার মতোই। আমাদের মা-বাবারও দুর্নীতিবাজ সন্তানদের প্রতি থাকে প্রচ্ছন্ন গর্ব। কী এক ভয়ংকর অবস্থা!

সেই ব্যর্থতা ভুলতে আমরা তোপ দাগি মোরসালিনের মায়ের প্রতি। মোরসালিনদের বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে আমরা তাঁদের অর্জনে গৌরব করতে দ্বিধা করি না, অথচ একই কারণে ক্ষোভ দেখাই মোরসালিনের মায়ের আচরণে।

মোরসালিনের মা মোটেই ভণ্ড নন, সেটি বরং আমরাই।

  • সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক