উফফ, কী গরম! দুইটা গাছ কেটে আসি...

সরকারের অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন গাছ কাটারও কোনো অনুমতি নেই। অথচ সেখানে রাজধানী শহরে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে রাতের আঁধারে গাছ কেটে ফেলল সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।
ছবি সৌজন্য: ডেইলি স্টার

গরম এখন চরমে, সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ঘর থেকে বের হলেই কি শুধু ত্রাহি অবস্থা, ঘরের ভেতরেও কি নয়? তবে যাদের ঘরে শীততাপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) আছে, তাদের কথা আলাদা। তেমন ঘরই বা কয়টা বা কত শতাংশ? তবে সন্দেহ নেই, যে হারে নব্য ধনী বেড়েছে, শুধু করোনার মরণাপন্ন অবস্থায়ই তো কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছিল কয়েক হাজার, তাতে এসির ব্যবহারও নিশ্চয়ই বেড়েছে। প্রতিদিন অফিস থেকে ঘেমে নেমে বাসায় ফেরার পর ফ্যান চালাতেই যখন আগুনের হলকার মতো গরম হাওয়া এসে গায়ে লাগে এবং মুখ দিয়ে ‘উফফফ’ শব্দ বের হয়, তখন শুনতে হয়, কেন ভাই বাসায় আসতে গেলেন, অফিসেই থেকে যেতেন!

নদীমাতৃক দেশে মরুভূমির লু হাওয়ায় মানুষের দিশেহারা অবস্থা। কৃষকের ফসল পুড়ে যায়। খেটে খাওয়া মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। সড়কের পিচ গরম হয়ে ধোঁয়া ওঠে। রেললাইন বেঁকে গিয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি করে। কয়েকটা দিন বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি বা কালবৈশাখী হলো কি হলো না, এরপর আবারও তাপমাত্রার ঊর্ধ্বগতি। যেকোনো আড্ডায় এ নিয়ে আলাপ উঠলে এসির প্রসঙ্গটা চলে আসে অবধারিতভাবে। খুব ভালো করেই খেয়াল করি, একবারের জন্যও আসে না গাছ লাগানোর কথা।

স্কুলের বাংলা ব্যাকরণ বইতে ‘বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি’ রচনা পড়ে বড় হওয়া প্রজন্ম আমরা। পরীক্ষার আগে ঢুলুঢুলু চোখে মুখস্থ করেছি সেই সহজ-সরল লাইনটি, ‘গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়, সেই অক্সিজেন পেয়ে আমরা বেঁচে থাকি।’

বলা হয়ে থাকে, মানুষ সারা জীবন যে অক্সিজেন নেয়, তা সরবরাহ করতে মাত্র আটটি গাছই যথেষ্ট। অথচ এই ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে সারা জীবনে আটটি গাছ লাগানো মানুষের সংখ্যা হবে হাতে গোনা। গাছ লাগাবে কী, বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বরং পোস্ট ভাইরাল হয়ে যায়, ‘খুব গরম পড়ছে, যাই দুইটা গাছ কেটে আসি।’ খুবই রসাত্মক হলেও কী নিদারুণ ও নির্মম বাস্তবতা প্রকাশ করে দেওয়া একটি বক্তব্য।

‘যে দেশে জনপ্রতিনিধি হতে নাগরিকের ভোট গৌণ হয়ে পড়ে, সেখানে মানুষের প্রতিবাদ ক্ষমতাচর্চার কাছে হার মানতে বাধ্য।’ সাত মসজিদ রোড, রাজধানী।

পরিবেশ ঠিক রাখা কোনোভাবেই শুধু ব্যক্তি-দায়িত্ব নয়, এটি একটি সামাজিক কর্মসূচিও। রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব তো অবশ্যই। দেশের নদী-খাল, পাহাড়-টিলা, জঙ্গল-বনভূমিগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাদেরই। সরকারের অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন গাছ কাটারও কোনো অনুমতি নেই। অথচ সেখানে আমরা দেখলাম কী, এমন আগুনমুখো তাপমাত্রার মধ্যেও রাজধানী শহরের ধানমন্ডি-সাতমসজিদ সড়কে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে রাতের আঁধারে গাছ কেটে ফেলল সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। ওই এলাকায় হাজারো রেস্টুরেন্ট থাকতে পারবে কিন্তু কয়েক শ গাছ থাকতে পারবে না।

এ নিয়ে পরিবেশবিদ ও সচেতন নাগরিক সমাজ আন্দোলন-বিক্ষোভ-মানববন্ধন কত কিছু করে গেল। সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরগরম হলো। কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করা হলো না। যে দেশে জনপ্রতিনিধি হতে নাগরিকের ভোট গৌণ হয়ে পড়ে, সেখানে মানুষের প্রতিবাদ ক্ষমতাচর্চার কাছে হার মানতে বাধ্য। এখানেও কি তেমনটি দেখা গেল না?

সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল-পরিকল্পনা বিভাগের এক গবেষণা বলছে, ঢাকা মহানগরে ২০ ভাগ সবুজ এলাকা থাকা প্রয়োজন, আছে সাড়ে ৮ ভাগের কম। অবশিষ্ট সবুজ কীভাবে ধরে রাখা যাবে, সবুজ কীভাবে আরও বাড়ানো যাবে, তা না করে বরং সবুজ ধ্বংস করার ব্রতই নিয়েছে যেন সিটি করপোরেশন।

ওই গবেষণায় এ-ও বলা হয়েছে, যা সবুজ আছে, তা-ও অনেক ক্ষেত্রে মুনাফা করার জন্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য ছেড়ে দেয় শহরের দেখভালকারী এ প্রতিষ্ঠান। যার বড় নমুনা হতে পারে করোনাকালে অবরুদ্ধ সময়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হয়েছিল নির্বিচারে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত উদ্যানটি বিনষ্ট করে এখন বাণিজ্যিকীকরণের কাজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে।

সিটি করপোরেশন বা রাজউকসহ সব সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষ মিলে শহরটিকে এমনভাবে গড়ে তুলেছে, সেখানে যে গাছের জন্য জায়গা রাখা দরকার, একটু খালি জায়গা রাখতে হবে, সেই চিন্তাই করা হয়নি। গাছ না কেটেও পরিবেশের ক্ষতি না করেও যে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা যায়, তা আমাদের নীতিনির্ধারকদের মানসিকতার মধ্যেই নেই। অন্য দেশে গাছ বাঁচিয়ে রাস্তা করা হয়। আর আমাদের দেশে রাস্তা করার জন্য সবার আগে গাছ কেটে ফেলা হয়।

কী কারণে শুকিয়ে যায় পাবর্ত্য চট্টগ্রামের পানির ছড়াগুলো? কেন পানিসংকটে ভুগতে সেখানকার বাসিন্দাদের

শুধু রাজধানী শহরের নয়, অন্যান্য বড় বড় শহরগুলো থেকেও কয়েক দিন পরপর উন্নয়ন বা সৌন্দর্যবর্ধনের নামে গাছ কাটার খবর আমরা পাই। এ দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পরিবেশ ও প্রকৃতির আধার বলা যায়। সেগুলোও এখন ধ্বংস হতে চলেছে। যার সর্বশেষ নমুনা হতে পারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। অহেতুক ও অযৌক্তিক উন্নয়নের ভারে বিশ্ববিদ্যালয়টির নিসর্গ হারিয়ে যেতে বসেছে, এই আলাপ এখন পুরোনো হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছ, পাহাড়, বন এভাবে উজাড় করা হয়েছে যে কয়েক দিন পরপর বিশাল বিশাল অজগর সাপ হল বা ক্লাসরুমে এসে ঢুকে পড়ছে।

নব্বই দশকে বিটিভিতে গাছ লাগানোর জন্য মানুষকে উৎসাহিত করতে কিছু বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো। একটি বিজ্ঞাপনে গাছ কাটার দুঃখে ভারাক্রান্ত কবিরাজের চরিত্রে প্রয়াত অভিনেতা আবুল খায়েরের সেই বিখ্যাত বাণী নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে, ‘এক একটা গাছ, এক একটা অক্সিজেনের ফ্যাক্টরি।’

আরেকটি বিজ্ঞাপন ছিল এমন, সদ্য বাবা হওয়ার পর এক ব্যক্তি সন্তান আগমন উদ্‌যাপন করছেন গাছ লাগিয়ে। সে গাছ বড় হয়ে সন্তানের উপকারে আসবে, এমন ছিল তাঁর নিয়ত।

সরকারিভাবে সেসব বিজ্ঞাপন এখন আর প্রচার করা হয় না। গাছ লাগানোর জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়োজনও মনে করা হয় না। বরং এখন গাছ না লাগিয়েই বৃক্ষরোপনে জাতীয় পুরস্কার কর্মসূচি ভাগিয়ে নিতে সরকারি যত বন্দোবস্ত দেখা যায়।

কী সহজে, কক্সবাজারে নামকাওয়াস্তে মূল্যে বিশাল বিশাল বনভূমি বিভিন্ন সরকারি কর্তৃপক্ষকে বরাদ্দ দেওয়া হয়! প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির নামে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গাছ লাগানোর মধ্যে কী ‘সুখ’, সেটি আদৌ জানা হলো না। সিলেটে সমৃদ্ধ সংরক্ষিত বন ধ্বংস করে প্রায় হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য ব্যয় ধরে বছরে ১০ লাখ দর্শনার্থী আগমনের লক্ষ্যে বিশাল সাফারি পার্ক তৈরির জন্য স্বয়ং পরিবেশমন্ত্রীর মধ্যে যে ‘উৎসাহ-উদ্দীপনা’ দেখা যায়, তাতেও অবাক হতে হয়।  

এভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে পাহাড়। কক্সবাজারে দুই হাজার অবৈধ ডাম্পার-পিকআপে অবাধে মাটি-বালু-গাছ পরিবহন চলে। সেগুলো থামানোর কেউ নেই।

দেশের বনাঞ্চলগুলোর হাল বোঝার বড় উদাহরণ হতে পারে মধুপুরের শালবন। কাগজে-কলমে বনাঞ্চল হলেও সেখানে অনেক জায়গায় এখন প্রাকৃতিক বনের অস্তিত্বই পাওয়া যায় না। কিছু দূর পরপর গ্রামীণ ছোট ছোট বাজার। মানুষের বাড়িঘরে ভরা পুরো এলাকা। দেশের অন্যান্য এলাকার গ্রামের মতোই একেকটি গ্রাম। যেখানে পাকা রাস্তা, বিদ্যুতের লাইন—সব রয়েছে। বাস, ট্রাক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা, ভ্যান—সব চলছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, ‘আগে পুরো এলাকা ছিল গজারি বন। দেখতে দেখতে বন উজাড় হয়ে গেল। এখন বনও নাই, বন্য প্রাণী নাই। আস্তে আস্তে বন শহর হইয়া যাইতাছে।’

ডয়চে ভেলের একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের বাজেটে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংরক্ষণে ১ হাজার ৫০১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। আগের অর্থবছরেও বরাদ্দ ছিল হাজার কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক তহবিল ও বিভিন্ন উৎস থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে ১৪০ কোটি ডলারের বেশি। আর সর্বশেষ আইএমএফের ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ঋণের ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন দেওয়া হয়েছে জলবায়ু খাতে। পরিবেশবিজ্ঞানী ও জলবায়ুবিশেষজ্ঞদের মতে, বরাদ্দ অর্থের অর্ধেকের বেশি টাকা চলে যায় পকেটে। ২০ ভাগ হয় অপচয়, ২০ ভাগ যায় যাঁরা প্রকল্প পাস করেন, তাঁদের পকেটে, ১০-১৫ ভাগ চলে যায় ঠিকাদারসহ অন্যান্যদের পকেটে। আর বাইরে থেকে পাওয়া অর্থ কোথায় যায়, সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

এই গরমে খাগড়াছড়ি ঘুরে আসার সুযোগ হলো। সেখানকার বন্ধুদের মুখে একটাই কথা, পাহাড়ে এমন গরম কল্পনাতীত। তাপমাত্রা কখনো কখনো সমতল থেকেও বেশি। গাছপালার কারণে এখানের পরিবেশটা সারা বছর মোটামুটি আরামদায়কই থাকে। কিন্তু এবার আগুনঝরা গরম। স্বাভাবিকভাবেই তখন পাহাড় কেটে, বন ধ্বংস করে, পাথর তুলে ছড়ার সর্বনাশ করে, ঝিরিতে বিষ মিশিয়ে, গাছ উজাড় করে পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে রাস্তা, পর্যটনকেন্দ্র ও রিসোর্ট বানানোর প্রসঙ্গই চলে এল। তখন রেড ইন্ডিয়ানদের বিখ্যাত একটি প্রবাদ মনে পড়ল, ‘যেদিন পৃথিবীর শেষ গাছটি কেটে ফেলা হবে, শেষ মাছটি ধরে ফেলা হবে, শেষ নদীটির জলও বিষাক্ত করে ফেলা হবে, শুধু সেদিনই মানুষ বুঝবে, টাকা খেয়ে বাঁচা যায় না।’ আফসোস, তখন মানুষের আর কিছুই করার থাকবে না।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী