আইটি খাত: গাছে তুলে মই কেড়ে নেবেন?

২০১২-২০১৩ সালের দিকের কথা। আমি তখন দেশের সফটওয়্যার শিল্প অ্যাসোসিয়েশনের (বেসিস) সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে ছিলাম। সেই সময় দেশে সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি যে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল সফটওয়্যার বা আইটি জানা জনবলের বিশাল অভাব। অনেকের হয়তো মনে আছে, ২০০০ সালে আমাদের পাশের দেশ ভারতে ওয়াইটুকে নিয়ে যে সফটওয়্যার ও নানা ধরনের আইটি সার্ভিস রপ্তানির যে জোয়ার তৈরি হয়েছিল, ২০০০ ও তার পরের কয়েক বছর সেই জোয়ার থিতিয়ে এসেছিল ২০০৫-২০০৬–এর দিকে।

সেই জোয়ারে দেশে ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রচুর আইটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট তৈরি হয়েছিল, পাবলিক–প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন আইটি ডিপার্টমেন্ট খুলেছিল। কিন্তু যখন অল্প কিছুদিন পরেই জোয়ার থেমে গেল, খুব তাড়াতাড়িই পরিস্থিতি পাল্টে গেল। অনেকের স্বপ্নভঙ্গ হলো। কেননা আইটি বিষয়ে পড়াশোনা করে চাকরি পাওয়া যাচ্ছিল না। আস্তে আস্তে অনেক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট বন্ধ হয়ে গেল, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের আইটি ডিপার্টমেন্টের আসনসংখ্যা কমিয়ে ফেলল। এভাবেই চলল কয়েক বছর। ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবক—কেউই আইটি ক্যারিয়ারের ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছিলেন না। ২০১৩ সালে আমি যখন বেসিসের দায়িত্বে ছিলাম, তখন প্রতিনিয়তই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি।  

তবে ঘটনা আবার ঘুরে যাওয়া শুরু করল ২০১৫ সালের পর থেকে। একদিকে সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন বাস্তবায়নে এই খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করা শুরু করল। অন্যদিকে দেরিতে হলেও বেশ কিছু ভালো আইটি কোম্পানি দেশে এবং বিদেশের বাজারে তাদের সফটওয়্যার সেবা ও পণ্য সফলভাবে বিক্রি এবং সরবরাহ করা শুরু করল। ফ্রিল্যান্সিং ও আউটসোর্সিং নিয়ে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ শুরু হলো সেই সময় থেকে। দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো প্রতিনিয়ত তরুণ ফ্রিল্যান্সারদের সাফল্য নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন বা ফিচার প্রকাশ করল। অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীরা এতে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত হলেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং আসনের সংখ্যা বাড়ানো হলো।

ইউজিসির (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) পরিসংখ্যানমতে যেখানে ২০১৫ সালে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সব মিলিয়ে ছাত্রছাত্রী ছিলেন ১৫ হাজারের কম, ২০২২ সালে এসে সেটি বেড়ে গেছে প্রায় ১ লাখের কাছাকাছি। আমি নিজে কিছুদিন আগে দেশের পাঁচটি প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি যে দু-তিন বছর আগেও সবচেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রী ছিল বিবিএ বিভাগে। এখন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বা কম্পিউটার সায়েন্সে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন।

এই বছরে (২০২৪) সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে ৩০ হাজারের বেশি কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করা শিক্ষার্থী চাকরির বাজারে আসবেন। এই সংখ্যা আগামী দু-তিন বছরে আরও বাড়বে, কেননা এখনো অনেকে শিক্ষার্থী। একই সঙ্গে আজকাল অনেকেই অনলাইনে কোর্স করছেন বিভিন্ন প্রোগ্রামিংয়ের ওপর। এ ছাড়া সরকারি আইটি ট্রেনিং সারা দেশে চলছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে। সব মিলিয়ে প্রতিবছর প্রায় দেড় লাখ তরুণ–তরুণী আইটি বিষয়ে পড়াশোনা করে চাকরির বাজারে ঢুকছে।

আমরা সবাই জানি যে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে শিক্ষিত বেকার সমস্যা। সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণা (সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ) রিপোর্টে দেখা গেছে, যাঁরা পড়াশোনা শেষ করছেন, তাঁদের ৫০ শতাংশের বেশি নিজেদের পছন্দের চাকরি পাচ্ছেন না। আমরা সবাই জানি, সমাজের ওপর কী ভয়ংকর প্রভাব পড়ছে এই শিক্ষিত বেকার সমস্যার। শিক্ষিত এই বেকারদের অনেকেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে মাদকাসক্ত হচ্ছেন বা সন্ত্রাসের মতো কাজে জড়াচ্ছেন অথবা অনলাইন বেটিংয়ের মতো ক্ষতিকর পথে উপার্জনের চেষ্টা করছেন।

তথ্যপ্রযুক্তি হতে পারে এই বিশালসংখ্যক যুবগোষ্ঠীকে আমাদের সমাজ ও অর্থনীতির ইতিবাচক ধারায় সম্পৃক্ত করার অন্যতম প্রধান উপায়। কেননা আইটি শিল্পের মাধ্যমে লাখ লাখ তরুণের কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্ভব (ইতিমধ্যেই দেশে ১০ হাজারের বেশি ছোট ও মাঝারি আইটি কোম্পানিতে ৫ লাখের বেশি তরুণ গ্র্যাজুয়েট কাজ করছেন)।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই খাতের উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে এই সম্ভাবনা শিগগিরই হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। কারণ, এই খাত যে কর অব্যাহতি সুবিধা পেয়ে আসছে ১০ বছর ধরে, ২০২৪ সালের জুন মাসে তার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এই অব্যাহতি যদি তুলে নেওয়া না হয়, তাহলে হুমকির মুখে পড়বে এই শিল্প, কেননা নতুন বিনিয়োগ হওয়ার সুযোগ কমে আসবে রাতারাতি।

আইটি খাতের সঙ্গে প্রায় দুই যুগ কাজ করছি। এই প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি, অন্য যেকোনো শিল্পের সঙ্গে সফটওয়্যার ও আইটি সার্ভিস খাতের যে জায়গাটা সবচেয়ে বেশি পার্থক্য, সেটি হচ্ছে এই শিল্পের প্রায় শতভাগ বিনিয়োগ উদ্যোক্তাদের নিজেদের পকেট থেকে বা ব্যবসার ক্ষুদ্র মুনাফা থেকে এসেছে।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, যেকোনো সফটওয়্যার বা আইটি সার্ভিস কোম্পানি মুনাফা করলেও কেন আয়কর দেবে না! অন্য খাত যদি দেয় এবং তারাও যদি বাড়তে পারে, তাহলে এই খাতের ওপরে কর আরোপে সমস্যা কোথায়? যৌক্তিক প্রশ্ন এবং এটা নিয়ে আলোচনা শুরুও হয়েছে।

আইটি খাতের সঙ্গে প্রায় দুই যুগ কাজ করছি। এই প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি, অন্য যেকোনো শিল্পের সঙ্গে সফটওয়্যার ও আইটি সার্ভিস খাতের যে জায়গাটা সবচেয়ে বেশি পার্থক্য, সেটি হচ্ছে এই শিল্পের প্রায় শতভাগ বিনিয়োগ উদ্যোক্তাদের নিজেদের পকেট থেকে বা ব্যবসার ক্ষুদ্র মুনাফা থেকে এসেছে।

তৈরি পোশাকশিল্প, টেক্সটাইল, ওষুধ, নির্মাণ, কৃষিপণ্য বা অন্য যেসব শিল্প দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, সেগুলোর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রায় অর্ধেক আসে ব্যাংকঋণ থেকে। ওই সব খাত ব্যাংক থেকে খুব সহজেই ঋণ পেতে পারে উদ্যোক্তাদের যে স্থাবর সম্পদ আছে (যেমন জমি, মেশিনারি, স্টক ইত্যাদি), সেগুলোকে বন্ধক রেখে। কিন্তু সফটওয়্যার বা আইটি সার্ভিস খাত যেহেতু একটি মেধাভিত্তিক শিল্প, এখানে ব্যাংকগুলো সহজেই ঋণ দিতে পারে না।

যদি কোনো উদ্যোক্তা তাঁর নিজস্ব সম্পদ (ব্যাংক এফডিএর, সঞ্চয়পত্র বা ব্যক্তিগত বাড়ি বা সম্পদ) বন্ধক হিসেবে রাখেন, তাহলে কোনো কোনো সময় ব্যাংক অল্প কিছু ঋণ দিতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই শিল্পের যে ১০ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা আছেন, তাঁদের বেশির ভাগ ফার্স্ট জেনারেশন উদ্যোক্তা, প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা—ব্যক্তিগত বা নিজস্ব সম্পদ খুব কম উদ্যোক্তারই আছে। এ কারণে বেশির ভাগ আইটি উদ্যোক্তা ব্যাংক থেকে ঋণ পান না। ব্যবসা চালাতে বা বড় করার একমাত্র ভরসা চলমান ব্যবসার ক্ষুদ্র মুনাফা (সাধারণত এই ব্যবসায় বিক্রির ৫-১০ শতাংশ মুনাফা হয়ে থাকে)। ২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে যদি এর ওপর ৩০ শতাংশ হারে কর আরোপ হয়, তখন মোট বিনিয়োগের প্রায় এক–তৃতীয়াংশ কমে যাবে। এই ব্যবসাগুলোর সম্প্রসারণ থমকে যাবে।

সরকারের উচ্চ মহলের যাঁরা এই ব্যাপারগুলোর দায়িত্বে আছেন, তাঁদের বুঝতে হবে যে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে (যেমন সারা দেশে প্রচুর আইটি ট্রেনিং, উদ্যোক্তা তৈরির কার্যক্রম, জেলায় জেলায় আইটি পার্ক ইত্যাদি) সমাজের তরুণ একটা অংশের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ তৈরি হয়েছে। অন্য কোনো খাতের তুলনায় এই খাতে সবচেয়ে বেশি গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থান (কেউ উদ্যোক্তা, কেউ কর্মী) তৈরি হচ্ছে। এখন যদি সরকার এই খাতের ওপর নতুন করে আয়কর আরোপ করে, তাহলে ব্যাপারটা লাখ লাখ তরুণকে গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়ার মতো একটি ব্যাপার হবে। নতুন প্রজন্মের এই স্বপ্নভঙ্গের দায় কি নীতিনির্ধারকেরা নিতে চাইবেন?

  • ফাহিম মাশরুর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিডি জবস