২০২২ সালের সর্বশেষ শিক্ষাক্রম ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। কেবল অভিভাবক ও শিক্ষক নয়, দেশের শিক্ষাবিদদের একটি বড় অংশ এই শিক্ষাক্রমকে গ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু এই শিক্ষাক্রম কেন এত সমালোচনার মুখে পড়ল, তার বিশ্লেষণ বেশি হয়নি। মোটাদাগে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য এ ধরনের একটি শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে পাঠ্যপুস্তক নিয়েও।
বর্তমানে ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকার জনমতের প্রতিফলন ঘটিয়ে এই শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন ও সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছে। সাধারণভাবেই ধারণা করা যায়, পাঠ্যপুস্তকেও এর প্রতিফলন ঘটবে। পরিমার্জন ও সংস্কারের জন্য ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমকে ভিত্তি ধরার চিন্তা করা হচ্ছে, যেটি মূলত ১৯৯৬ সালের শিক্ষাক্রমকে অনুসরণ করে তৈরি। এখন আগামী অন্তত ১০ বছরের জন্য যে শিক্ষাক্রমের পরিকল্পনা করা হবে, তা যেন আমাদের পিছিয়ে না দেয়, সেটি প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে পুরোনো শিক্ষাক্রমের দুর্বলতা ও ঘাটতি যেমন বিবেচনায় নেওয়া দরকার, তেমনি নতুন শিক্ষাক্রমের ভালো দিকগুলোও গ্রহণ করা দরকার।
আমাদের এখন যুগের চাহিদার দিকে লক্ষ রেখে বিষয়গত জ্ঞানের চেয়ে দক্ষতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তবে সবচেয়ে জরুরি শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান হালহকিকত পর্যালোচনা করার জন্য এবং নতুন করণীয় নির্ধারণের জন্য জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করা
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রস্তাব করা হয়েছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান-মানবিক-ব্যবসায় শিক্ষা বিভাজন থাকবে না। এর পেছনে যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, সব স্কুলশিক্ষার্থী যাতে মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রতিটি বিষয়ে ভিত্তিমূলক দক্ষতা অর্জন করে। প্রায় কোনো দেশের স্কুলপর্যায়ে এমন বিভাজন নেই। তা ছাড়া এ বয়সের একজন শিক্ষার্থী নিজেও বুঝে উঠতে পারে না তার জন্য কোন ধারাটি ভালো হবে। এখন যদি আমরা নবম শ্রেণিতেই আগের মতো বিভাজনে ফিরতে চাই, তাহলে এ নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনার প্রয়োজন হবে।
নতুন শিক্ষাক্রমের পরীক্ষা ও মূল্যায়নপদ্ধতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি তর্ক উঠেছে। অভিভাবকেরা বারবার বলার চেষ্টা করেছেন, পরীক্ষা না থাকলে শিক্ষার্থীরা পড়তে চায় না। শিক্ষাক্রমপ্রণেতাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থী নির্ধারিত যোগ্যতা বা দক্ষতা অর্জন করল কি না, সেটাই বিবেচ্য হবে। এ ক্ষেত্রে গতানুগতিক ধারায় পরীক্ষা হবে না। আশা করা গিয়েছিল, নতুন পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের গাইড ও কোচিং–নির্ভরতা কমাবে। তবে সেটি মোটেও কমাতে পারেনি। আবার পুরোনো পরীক্ষাপদ্ধতি ও প্রশ্নের ধারা যে ভালো, সেটিও বলা যাবে না।
পুরোনো শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, সেটি মুখস্থনির্ভর। নতুন শিক্ষাক্রমে এ থেকে বেরিয়ে আনার পরিকল্পনা আছে। শ্রেণি কার্যক্রমে যে কারণে শিক্ষকদের পড়ানোর আগে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও ধারণা যাচাই করার কথা বলা হয়েছে। এমনকি শিক্ষার্থীরা নিজেরাও বিষয়টি নিয়ে নিজেরা আলোচনা করবে। কিন্তু অভিভাবকেরা বলছেন, শিক্ষকেরা ক্লাসে পড়ান না। একই সঙ্গে বাস্তবতা এই, আমাদের শ্রেণিকক্ষগুলো নতুন ধারণা বাস্তবায়নের উপযোগী নয়। তা ছাড়া শিক্ষকেরা ঠিকমতো প্রশিক্ষণও পাননি। ফলে নতুন পদ্ধতি তাঁরা বুঝে উঠতে পারেননি।
নতুন শিক্ষাক্রমে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধিতাকে বিবেচনায় নিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশনা ছিল। এমনকি মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও বিকল্প উপায়ের কথা বলা হয়েছে। আগের শিক্ষাক্রমগুলোতে সব ধরনের শিক্ষার্থীকে একই পদ্ধতিতে পরীক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ভাষা যোগাযোগের ক্ষেত্রেও শোনা-বলা-পড়া-লেখা—এই চার স্তরের বাইরে স্পর্শ-দর্শনসহ অন্যান্য ইন্দ্রিয়গত অনুভূতিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এমনকি শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত আগ্রহ, অভিরুচি ও বিশেষ দক্ষতার ক্ষেত্রকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
এরপরও মানতে হবে, নতুন শিক্ষাক্রম সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এর সবচেয়ে বড় কারণ, একটি অগণতান্ত্রিক অজনপ্রিয় সরকারের আরও অনেক বিষয়ের মতো শিক্ষাক্রমও বিরোধিতার মুখে পড়েছে। জনমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে একে সংস্কার বা সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়নি। পাঠ্যপুস্তকেও সমস্যা রয়ে গেছে। বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তকে জাতীয় ইতিহাসের অংশ এমনভাবে লিখিত হয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই প্রামাণ্য নয় এবং বাংলাদেশের গণমানুষের চেতনার বিরোধী। ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিপন্থী কিছু বিষয় নিয়েও আপত্তি ছিল, যার কিছু কিছু শেষ পর্যন্ত এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
অভিভাবকেরা নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আন্দোলন পর্যন্ত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, নতুন পদ্ধতিতে অ্যাসাইনমেন্ট আর প্রজেক্ট ওয়ার্কের জন্য প্রচুর আর্ট পেপার, মার্কার কিনতে হচ্ছে। দলগত কাজে দলনেতাদের সব দায়িত্ব নিতে হয়। বাড়ির কাজের নামে শিক্ষার্থীদের মারাত্মকভাবে ডিভাইসমুখী করা হচ্ছে। বিদ্যালয়ে কেন আলুভর্তা আর ডিম ভাজি করা শেখানো হবে। এর বাইরে আরও গুরুতর অভিযোগ, শিক্ষকেরা নিজেদের ‘প্রাইভেট’ বা ‘ব্যাচ’–এর শিক্ষার্থীকে মূল্যায়নে ভালো স্কোর দেন। এসব প্রশ্ন ও অভিযোগের উপযুক্ত জবাব এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
নতুন পদ্ধতিতে ফলাফল প্রদানের ক্ষেত্রে জিপিএ-ভিত্তিক ফলাফলকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। এটি নিয়েও আপত্তি উঠেছে। এই বাইরে নীতিগত আরও কিছু বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে। যেমন প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এবং মাধ্যমিক শিক্ষা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত হবে কি না। মীমাংসা বা সিদ্ধান্ত যেটিই হোক, তা করতে হবে আমাদের বিদ্যমান অবস্থা ও পরিকাঠামোকে বিবেচনায় নিয়ে। বাস্তবতাবহির্ভূত শিক্ষাপদ্ধতি যত ভালোই হোক, তা বাস্তবায়নযোগ্য হয় না। এমনকি তা সুফলও বয়ে আনে না।
আমাদের এখন যুগের চাহিদার দিকে লক্ষ রেখে বিষয়গত জ্ঞানের চেয়ে দক্ষতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তবে সবচেয়ে জরুরি শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান হালহকিকত পর্যালোচনা করার জন্য এবং নতুন করণীয় নির্ধারণের জন্য জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করা। সেই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে শিক্ষাক্রমের সংস্কার করতে হবে এবং পাঠ্যপুস্তক তৈরি করতে হবে। এ কাজের দায়িত্ব দিতে হবে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও উদ্যমী ব্যক্তিদের।
তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক