কুড়িগ্রাম থেকে রংপুরে যাওয়ার পথে বুড়াইল নদের ওপর সেতুর কাছে রংপুর মেট্রোপলিটন লেখা সাইনবোর্ড চোখে পড়বে। এখান থেকে রংপুর মেট্রোপলিটন এলাকা শুরু। এটি মূলত প্রত্যন্ত গ্রাম। এখানে নগরায়ণ হতে আরও কয়েক যুগ লাগবে। আরও খানিকটা এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে রংপুর সিটি করপোরেশন লেখা আরেকটি সাইনবোর্ড। যেখান থেকে সিটি করপোরেশন শুরু সেটিও অজপাড়াগাঁ। নগরায়ণের কথা সেখানকার মানুষ কল্পনা করেন বলে মনে হয় না।
পার্ক মোড় এলাকা শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখসংলগ্ন। এখানে ত্রিভুজাকৃতির একটি উঁচু স্থান আছে। এই স্থানকে নান্দনিকভাবে সাজানো যেত। এখানেই আছে খোকসাঘাঘট নদ। নদের পাশে স্থানটি মনোরম করে তোলা যেত। এগুলো কদর্য রূপ নিয়ে পড়ে আছে। এর পাশ দিয়ে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট যাওয়ার সড়ক। একইভাবে ঢাকা থেকে রংপুরে প্রবেশমুখও বলা যায়।
পার্ক মোড় থেকে শহরের দিকে প্রবেশ করতেই প্রথমে পড়বে লালবাগ। লাল রঙের বাগিচা অর্থে লালবাগ হলেও সেখানে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে একটি বাঘের প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়েছে, যার রং লাল। সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা লালবাগকে ভেবেছে ‘লাল বাঘ’। এ নিয়ে শহরের মানুষ হাসাহাসি করলেও তার কোনো পরিবর্তন ঘটানো হয়নি।
লালবাগে প্রবেশমুখে প্রধান সড়কটাই একটি ডাস্টবিন। সড়কের অনেকটা অংশজুড়ে ওই এলাকার ময়লা ফেলা হয়। দুর্গন্ধ না নিয়ে শহরে প্রবেশের কোনো উপায় নেই। এভাবেই অভ্যাগতরা আপ্যায়িত হন।
লালবাগ থেকে পায়ে সামান্য পথ গেলেই খামার মোড়। খামার মোড়ে সড়কের ওপর অনেক দোকানপাট গড়ে উঠেছে। সেখানে ফুটপাতের ওপর আছে গোয়ালঘর। এখানে ১২টি গরু আছে। এই গরুগুলোর গলার দড়ি খুলে শহরে ছেড়ে দেওয়া হয়। শহরটা গরুগুলোর স্বাধীন গোচারণ ভূমি। অসংখ্য দুর্ঘটনার কারণ ব্যস্ত সড়কে ছেড়ে দেওয়া গরুগুলো।
কদিন আগে গোয়ালঘরের পাশে সড়কে গরুগুলো জাবর কাটছিল। পাশে বসে থাকা লক্ষ্মী রাণীর সঙ্গে কথা হলো। লক্ষ্মী রাণী ও তাঁর স্বামী হরিশচন্দ্র মিলে গরুগুলো লালনপালন করেন। তিনি জানালেন, গরুগুলো ছেড়ে দেওয়া হয় শহরের বিভিন্ন ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া খাবারের জন্য। গরুগুলো জানে শহরে কোথায় কোথায় ডাস্টবিন আছে। কখনো কখনো রাতেও তাঁরা গরুগুলো শহরে ছাড়েন।
আরেকটু এগিয়ে গেলে শাপলা চত্বর। শাপলা চত্বরে কিছুদিন আগেও শহরের উন্নয়নের ফিরিস্তি বৈদ্যুতিক বড় পর্দায় দেখানো হতো। সেই উন্নয়ন স্পর্শ করতে পারেনি নগরবাসীকে। শাপলা থেকে আরও খানিকটা এগিয়ে গেলে জাহাজ কোম্পানির মোড়। এটাই শহরের প্রাণকেন্দ্র। দিন যত যাচ্ছে, শহরের যানজট তত বাড়ছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে যানজট এখন সারা দিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
এই যানজট প্রায় এক কিলোমিটার দূরের কাচারিবাজার পর্যন্ত হয়ে থাকে। শহরে যে পরিমাণ মানুষ আছে আর শহরের আয়তন যত বেশি, এতে করে এই শহরে যানজট হওয়ার কোনো কারণই নেই। কিন্তু শহরজুড়ে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক গুণ বেশি অটোরিকশা। সিটি করপোরেশনের কোনো সিটি সার্ভিস চালু হয়নি।
জাহাজ কোম্পানি থেকে পায়রা চত্বর হয়ে সুপারমার্কেটের দিকে হাঁটলে চোখে পড়বে ফুটপাত ব্যবসায়ীদের দখলে। সুপারমার্কেট পেরিয়ে গেলে সিটি কাঁচাবাজার। বাজারের ভেতরের সড়ক অপ্রশস্ত। নতুন জুতা পরে বাজারে যাওয়া কঠিন। মাছের বাজার কাদাপানিতে ভরা। সম্পূর্ণ শহরটাই নোংরা। এর মধ্যে কাঁচাবাজার যেন কিছুটা বেশি।
কাঁচাবাজারের পাশেই রংপুর সিটি করপোরেশনের কার্যালয়—নগর ভবন। সিটি করপোরেশন সম্প্রতি দৃষ্টিনন্দন একটি ফটক নির্মাণ করেছে। ফটকের সামনে প্রধান সড়কের ভেতরে বিদ্যুতের খুঁটি। সামনে সড়কের ওপর পানের দোকান। বছর দশেক আগে সড়ক সম্প্রসারিত হয়েছে। সড়কের কাজ করেছে সড়ক বিভাগ। দুই মেয়রের আমল শেষ হলেও শহরের প্রধান সড়কের ভেতরে থাকা বিদ্যুতের খুঁটি কেউ সরাতে পারেননি। এ রকম অব্যবস্থাপনায় ভরা অপরিকল্পিত-অপরিচ্ছন্ন, নান্দনিকতা বর্জিত, নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত রংপুর সিটি করপোরেশনে ২৭ ডিসেম্বর ২০২২ অনুষ্ঠিত হবে তৃতীয় সিটি করপোরেশন নির্বাচন।
নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীর সংখ্যা ৯। এর মধ্যে কেউ কেউ ইশতেহার প্রকাশ করেছেন। যদিও এই ইশতেহার কেবল নির্বাচনে ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য। তাই যেভাবে প্রতিশ্রুতির কথা লিখলে ভোটারের মন পাওয়া যাবে, সেভাবে বলার চেষ্টা করা হয়েছে। এর আগে ইশতেহার ঘোষণা করলেও সেই ইশতেহার অনুযায়ী কাজ জনগণের কাছে পৌঁছায়নি। অবশ্য জনগণ ইশতেহারে বিশ্বাসও করে না।
জাতীয় পার্টির মনোনীত সদ্য সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ২৮ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন। আওয়ামী লীগের এই প্রার্থী ২৯ দফা ইশতেহার প্রকাশ করেছেন। বিএনপি এবার নির্বাচনে নেই। জাসদ (ইনু) থেকে মশাল প্রতীকে নির্বাচন করছেন শফিয়ার রহমান। এ ছাড়া জাকের পার্টি, খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কংগ্রেস এবং স্বতন্ত্র থেকে দুজন নির্বাচন করছেন।
পোস্টারে ছেয়ে গেছে সিটি করপোরেশনের আওতায় থাকা শহর এবং গ্রামের অংশ। সব সড়ক-অলিগলি এবং প্রত্যন্ত গ্রামের কাঁচা সড়কও ভরে গেছে পোস্টারে। কোথাও কোথাও পরিবেশের ক্ষতিকর প্লাস্টিকে মোড়ানো পোস্টার টাঙানো হয়েছে। বেলা দুইটার পর থেকে চলে মাইকিং। হরেক রকম গানে-ছড়ায় তাল মিলিয়ে চলতে থাকে প্রচারণা। প্রচারণা মতে, সব প্রার্থী ভালো।
রংপুর শহর এখনো একটি আদর্শ ও অনুকরণীয় শহর হয়ে উঠতে পারে। রিকশাচালক মোহাম্মদ তারেক সড়ক বিভাজকগুলো রং না করার কারণে আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘রংপুর শহরটা ভালো না। রাজশাহী শহর খুব সুন্দর। ফেসবুক, ইউটিউবে অনেক ভিডিও দেখছি। কোনো দিন যাই নাই।’ সঙ্গে থাকা চিকিৎসক ফজলুল করিম বলছিলেন, ‘রংপুরের মেয়র-কাউন্সিলরদের রাজশাহী শহর দেখিয়ে আনা প্রয়োজন। তাহলে বুঝত ভালো শহর কাকে বলে।’
শহরের বিত্তহীন-নিম্নবিত্তেরা আছেন নিজেদের তিন বেলার খাবার সংগ্রহের ব্যস্ততায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পিষ্ট তাঁদের জীবন। মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তদের অর্থনৈতিক টানাটানিতে বিপন্ন জীবন। অন্যদের মধ্যে অনেকের মনোযোগ জাতীয় রাজনীতিতে। রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার ভোটারের উত্তেজনা কম।
মেয়র পদের চেয়েও কাউন্সিলর প্রার্থীরাই যেন নির্বাচনে উত্তাপ ছড়াচ্ছেন। প্রায় সবাই ভাবছেন নির্বাচনে কোন গন্ডগোল হবে না। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন ইভিএম ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করবে না তো! তবে সামনে জাতীয় নির্বাচনের কথা ভেবে নির্বাচন কমিশন একটি ভালো নির্বাচন করবে বলেই আমরা মনে করি।
আসন্ন নির্বাচনে মেয়র যিনি হন না কেন, নাগরিক সেবার মানবৃদ্ধিতে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় মনোযোগ দিতে হবে। নয়তো রংপুর সিটি করপোরেশন কিংবা মেট্রোপলিটন হবে নামমাত্র, বাস্তবে নিম্নমানের পৌরসেবার বেশি কিছু নগরবাসীর জীবনে জুটবে না।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক
wadudtuhin@gmail.com