তালব্য-শ, নাকি দন্ত-স দিয়ে নামের বানানটা শুরু, বলতে পারলেন না। কারণ, বর্ণের সঙ্গে চেনা–পরিচয় হয়ে ওঠেনি; যাওয়া হয়নি কখনো বিদ্যালয়ের আঙিনায়। বর্ণ শব্দের আরেক অর্থ যে রং, সেটিও তাঁর জীবনকে রাঙায়নি কখনো। স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনকে যদি রঙিন অভিহিত করা চলে, তবে তাঁর জীবনযাপন সম্পূর্ণ ‘সাদা-কালো’। প্রতিদিন মেহনত, প্রতিদিন অনটন, প্রতিদিন জোড়াতালি—তাঁর জীবনের শাঁস ও নির্যাস।
‘শ’ ও ‘স’ নিয়ে দ্বন্দ্বটাও ভারি মজার। জন্ম হয়েছিল কোনো এক শুক্রবারে। মা-বাবাসহ অন্যদের মুখে এ কথা বহুবার শোনা। আর এ কারণেই নাকি তাঁর নাম রাখা হয় ‘শুকবাসী’, মোছাম্মৎ শুকবাসী। একাধিকবার উচ্চারণ শুনে যতটা বোঝা গেল—কোনোভাবেই তা ‘সুখবাসী’ নয়। আর তা যদি হয়েও থাকে, তবে এর চেয়ে প্রকট প্রহসন আর কী হতে পারে! আক্ষরিক ও আত্মিক—উভয় অর্থেই যাঁর নুন আনতে পান্তা ফুরায় দশা, তাঁর সঙ্গে সুখের দেখা কেবল স্বপ্নেই সম্ভব। অবশ্য মাথাপিছু আয়ের হিসাবে কাগজে-কলমে তাঁর আর্থসামাজিক অবস্থান হয়তো ভিন্নই হবে।
শুকবাসী শাক বেচে বেঁচে আছেন, কোনোমতে। এক পয়সাও চালান নেই তাঁর। জামাতা প্রতিদিন দুই-আড়াই হাজার টাকার কয়েক পদের শাক কিনে এনে দেন। বিক্রি শেষে যে লাভ থাকে, তার আধাআধি ভাগ হয় তাঁদের মধ্যে। তা দিন শেষে কত লাভ থাকে? দিন ভালো গেলে ৫০০ টাকা, গড়পড়তা ৪০০ থেকে ৪৫০। মাসে মেরেকেটে পাঁচ হাজার টাকাও হয় না। এর মধ্যে ঘরভাড়াই তিন হাজার টাকা। স্বামী শরাফত আলী শেখ পক্ষাঘাতে (প্যারালাইলিস) আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। ৭০ বছর বয়সী মানুষটির জন্য সপ্তাহে ওষুধ লাগে ১ হাজার ২০০ টাকার। শুকবাসীরও ডান পা প্রায় অচল, নিচের অংশে সাড়া পান না। তাঁরও ওষুধ লাগে নিয়মিত। কোমরে বেল্ট বেঁধে চলেন। এরপরও ৫০ ছুঁই ছুঁই শুকবাসীকেই এখনো রোজগারের জন্য রোজ পথে নামতে হয়। তাতেও কি দুবেলা দুমুঠো খাবারের জোগাড় নিশ্চিত করতে পারেন? পারেন না।
শরাফত-শুকবাসী দম্পতির এক মেয়ে ছাড়া এক ছেলেও আছে। তবে বিয়ের পর স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ছেলে আলাদা থাকেন, জামালপুরের বকশীগঞ্জে। সেখানেই রিকশা চালান। মেয়ে আর জামাতা ঢাকার নন্দীপাড়ায় শুকবাসীর বাসার কাছেই ভাড়া থাকেন। জামাতারও পেশা রিকশাচালনা।
১০ বছর আগে জামালপুরের ইসলামপুরের গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় এসেছিলেন তাঁরা; দেশের তাবৎ দিন আনি দিন খাই মানুষের মতো তাঁরাও আশা করেছিলেন, আয়রোজগারে জোয়ার আসবে। ঢাকায় টাকা নাকি বাতাসে ওড়ে। এ কথায় কিছুটা সত্যতা থাকলেও বলা যায়, সেই টাকা সবাই ধরতে পারেন না। আর যাঁরা ধরতে পারেন, তাঁরা সে টাকা দেশেও রাখেন না; তাঁদের সিন্দুক থাকে বিদেশে।
এলাকায় রিকশাচালনা বাদ নিয়ে ঢাকায় এসে শাক বেচা শুরু করেছিলেন শরাফত। তিনি অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হওয়ার পর শুকবাসী স্বামীর পেশা বেছে নেন। পূর্ব রামপুরার টিভি রোডের মাথায়, যেখানে শরাফত শাক নিয়ে বসতেন, সেখানেই এখন প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা কাটে শুকবাসীর।
কদিন আগেই জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ হয়েছে। কিছুটা কৌতূহল নিয়েই শুকবাসীর কাছে বাজেট নিয়ে জানতে চাওয়া হলো। কিছু বলতে পারলেন না। উত্তর অবশ্য অনুমেয়ই ছিল। অথচ কী পরিহাস, শুকবাসীদের জীবনের প্রতিটা দিনই ‘বাজেটনির্ভর’; আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে জান কয়লা! জিনিসপত্রের আগুন-আঁচের দামের এই বাজারে গরিবের কয়লা হওয়া জান কি অন্য কোনো পক্ষকে কোনোভাবে লাভবান করে? কে জানে!
শুকবাসী তাঁর জীবনের গরিমাহীন গল্প যখন বলছিলেন, তার প্রতিটি শব্দ, বর্ণ, দাড়ি-কমা চোখের জলে ভিজে যাচ্ছিল! কত স্বপ্ন ছিল, নাতি–নাতনি নিয়ে একসঙ্গে থাকবেন। ছেলে থেকেও যেন আজ নেই।
দশাসই চেহারার স্বামী আজ আর এক পা–ও হাঁটতে পারেন না। নিজেরও চলাফেরা করা কত কষ্টের।
এরপরও পেটের তাগিদে তাঁকে কাজে বেরোতে হয়। দেশের বাড়িতে ফিরে যাবেন, তারও উপায় নেই। স্বামীর ভিটেটুকুও নেই। বাবার সম্পদের ছিটেফোঁটাও পাননি শুকবাসী।
যে অর্থে শুক; শুক্র অর্থ শুকতারা, এমনকি শুক্রবার তো আমাদের সাপ্তাহিক কর্মবিরতির দিন—এর কোনোটাই শুকবাসীর জীবনের জন্য প্রযোজ্য নয়। না জীবনের কোনো দিশা আছে, না আছে দুঃখের শেষ! শুকবাসীদের জীবনে প্রতিদিনের সংগ্রামই কেবল সত্য।
হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
ই–মেইল: hello.hasanimam@gmail.com