মতামত

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘একক ভর্তি’ পরীক্ষা স্থগিত হলো কেন?

চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একক ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার গত ১৫ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্যের নির্দেশে প্রজ্ঞাপন জারি করে এবং তা কীভাবে নেওয়া হবে, তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কাছে প্রস্তাব চাওয়া হয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটে গত মাসের শেষের দিকে ইউজিসি ‘একক ভর্তি’ পরীক্ষার একটি খসড়া অধ্যাদেশ রাষ্ট্রপতির অনুমতির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।

কিন্তু হঠাৎই ‘একক ভর্তি’ পরীক্ষা চলতি শিক্ষাবর্ষে নেওয়া হচ্ছে না বলে সংবাদমাধ্যমে খবর বের হয়েছে। ইউজিসির এক সদস্যের বরাত দিয়ে প্রথম আলো বলছে, আসন্ন শিক্ষাবর্ষে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হবে। গুচ্ছ থেকে একক ভর্তি পরীক্ষার আয়োজনের জন্য যে ইউজিসি দায়িত্ব পেয়েছিল, হঠাৎ কী এমন ঘটনা ঘটল যে তাঁরা একক ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করতে পারছে না?

যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রপতির আদেশে একক ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছিল, সেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক মাসেও কেন ইউজিসির পাঠানো খসড়ার চূড়ান্ত করতে পারল না? কী এমন ঘটনা ঘটেছে, যা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের প্রাক্কালে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করতে দেখা যাচ্ছে?

শিক্ষা নিয়ে কাজ করে এমন এক অনুজ সাংবাদিকের কাছ থেকে গত ২৭ নভেম্বর ইউজিসিকে লেখা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠি এবং ইউজিসির প্রেরিত খসড়াটি দেখার সুযোগ হয়েছে। এই চিঠি পড়ে ‘স্পষ্টত’ অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রতিফলিত হয়েছে।

ওই চিঠিতে বলা হচ্ছে, ইউজিসিকে কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া নির্ধারণের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা। কিন্তু তা না করে ইউজিসি সরাসরি অধ্যাদেশের খসড়া পাঠিয়েছে। জাতীয় সংসদ অধিবেশন না থাকা, অর্থাৎ বিলুপ্ত থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা বিবেচনায় অধ্যাদেশ জারি করেন। বর্তমানে দেশে কোনো জরুরি অবস্থা বিদ্যমান নেই। বিধায় এ ক্ষেত্রে অধ্যাদেশ প্রণয়নের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়।

অর্থাৎ শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইউজিসির প্রেরিত ‘অধ্যাদেশ’ শব্দ দিয়ে করা খসড়াটিকে উড়িয়ে দিয়েছেন। নির্বাচনের প্রাক্কালে আপাতত দৃষ্টিতে হয়তো মনে হবে, অধ্যাদেশটি সংসদেই পাস করতে হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে আইনে পরিচালিত হয়, সেই ১৯৭৩ অধ্যাদেশে স্পষ্ট বলা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো আইন সংযোজন বা বাতিল করতে পারবেন। যেখানে আচার্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি, সেখানে ‘হুট করে জরুরি অবস্থা’ জারির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আদেশ কার্যকরের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, সত্যিই তা আমার জানা নেই। এটি সংবিধান সংশোধনের কোনো বিল নয়, যা সংসদে যেতে হবে।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, ইউজিসি যে অধ্যাদেশই করতে যাচ্ছে, তা গত ১১ অক্টোবর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, যা সব সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারও হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি ‘অধ্যাদেশে’ নাখোশ হয়েই থাকে, তাহলে সহজেই তো ইউজিসিকে জানিয়ে দিতে পারত, ‘আপনারা প্রস্তাব দিন, আমরা পরবর্তীকালে এটিকে অধ্যাদেশ বানিয়ে দেব।’ কিন্তু তা না করে ইউজিসি খসড়া মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের ২৭ দিন পর তারা মতামত জানিয়ে খসড়া বাতিল করছে। এটি দুই প্রতিষ্ঠানেরই অসহযোগিতার ফসল, যার জন্য ভোগান্তির শিকার হবেন ‌১০ লাখ ছেলেমেয়ে।

তবে ইউজিসির প্রস্তাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেন বাগড়া দিয়েছে, তা চিঠির পরের কিছু অংশ স্পষ্ট করেছে। চিঠিতে আরও বলা হচ্ছে, খসড়া অধ্যাদেশের ৫-১০ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ নামে যে কমিটি হবে, তার চেয়ারম্যান হবেন ইউজিসি চেয়ারম্যান, যিনি এরই মধ্যে বিধিবদ্ধ সংস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত।

এ পরিপ্রেক্ষিতে তার আরেকটি কর্তৃপক্ষের প্রধানের দায়িত্ব পালন করা সমীচীন হবে না। ‘ইউজিসি আদেশ, ১৯৭৩’ বলে গঠিত বিধিবদ্ধ সংস্থার অধীন আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আরেকটি কর্তৃপক্ষ থাকতে পারে না। এরপরও পুনরায় গঠনকাঠামো, কার্যক্রম, পরীক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ‘প্রস্তাব’ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করতে ইউজিসিকে অনুরোধ করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে একক ভর্তি পরীক্ষা নিতে হবে। ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কষ্ট লাগব করতে এমন একটি ভালো উদ্যোগকে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দড়ি টানাটানির বিষয় বানানো উচিত হবে না। বরং সরকারের উচিত হবে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে (পাবলিক ও বেসরকারি) একক ভর্তি পরীক্ষার অধীন কীভাবে নেওয়া যায়, সে জন্য প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করা।

এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, ইউজিসির খসড়ার ৫-১০ নম্বরে ঠিক কী এমন কথাবার্তা লেখা ছিল, যার কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নাখোশ হলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য ইউজিসির খসড়ায় যেতে হবে।

পাঁচ ও ছয় নম্বর ধারায় বলা হচ্ছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের স্নাতক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ’ নামের একটি কর্তৃপক্ষ থাকবে। এর কার্যালয় হবে ইউজিসি। প্রয়োজনে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় এর শাখা স্থাপন করতে পারবে।

সাত নম্বরে কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বর্ণনা করলেও আট নম্বরে বলা হচ্ছে, কারা কারা এই কর্তৃপক্ষ গঠনে থাকতে পারবে। ইউজিসির চেয়ারম্যান হবেন এই ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান। আর তাঁর মনোনীত দুজন সদস্য পূর্ণকালীন হবেন। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যরা ডিফল্ট সদস্য হিসেবে এই কমিটিতে থাকবেন। আর ৯ ও ১০ নম্বর অধ্যাদেশে এই কর্তৃপক্ষ ঠিক কী কী ক্ষমতা ও দায়িত্ব পালন করবে, সেই সব বলা হয়েছে।

অর্থাৎ পুরো এই খসড়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাউকে কোনো পদায়ন ও ক্ষমতার বলয়ে রাখা হয়নি। ফলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখানে ক্ষমতা প্রদর্শনের কোনো সুযোগ থাকছে না। এ কারণে খসড়াটিকে চূড়ান্ত অনুমোদন না দিয়ে ইউজিসিকে সংশোধনের তাগাদা দিয়েছে।

প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের একক ভর্তি পরীক্ষায় ইউজিসির চেয়ারম্যান কিংবা তাঁর মনোনীত ব্যক্তিদের ক্ষমতায়নের সুযোগ দেওয়া হবে কেন? কোন আইনের বলয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ঠিক আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার চেয়ারম্যান বনে যাবেন? এটি কি যুক্তিযুক্ত হতে পারে?

এই খসড়া পড়ে কখনোই আমার কাছে মনে হয়নি, এটি ‘ভর্তি পরীক্ষাসংক্রান্ত কোনো খসড়া’ বা ‘দিকনির্দেশনা’। ভর্তি পরীক্ষা কীভাবে হবে, মানবণ্টন কীভাবে, প্রশ্নপত্রের ধরন কেমন হবে, ফলাফল অনুসরণে প্রযুক্তি কী হবে, এসব না লিখে ইউজিসি ভর্তি পরীক্ষাকে যেভাবে নিজেদের দায়িত্বে নিতে চাইছে, তা এই কয়েক পাতার খসড়া পড়ে যে কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, ইউজিসি পুরো ভর্তি পরীক্ষার আয়–ব্যয় নিজেরাই করতে চাচ্ছে। ১৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘কর্তৃপক্ষ ভর্তিসংক্রান্ত কার্যক্রম দ্রুত সম্পাদনের লক্ষ্যে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন, ২০০৬ এবং তদাধীনে প্রণীত বিধিমালায় যাহা কিছুই বলা থাকুক না কেন, ভর্তি পরীক্ষাসংক্রান্ত কাজে বিশেষ বিবেচনায় দরপত্র প্রক্রিয়া বা অন্য কোনো ক্রয়পদ্ধতি প্রয়োগ ব্যতীত সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট উৎস থেকে পণ্য ও সংশ্লিষ্ট সেবা বা কার্য ও ভৌত সেবা ক্রয় করিতে পারবে। কিন্তু কেন এই অবাধ স্বাধীনতা দিতে হবে? এর ব্যাখ্যা সেখানে নেই।

যে বিষয়টি অবাক করার মতো, তা হলো এ অধ্যাদেশের নির্দেশিকায় সরল বিশ্বাসে কোনো কাজের ফলে যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে ওই শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর বিরুদ্ধে কেউই কোনো ফৌজদারি মামলা করতে পারবেন না। কী আজব নিয়ম বলুন! আপনি ভুল করবেন, কিন্তু শাস্তি পাবেন না। এমন অদ্ভুত নিয়মকানুন ১৭ নম্বর অধ্যাদেশে বলা হয়েছে।

এখন কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস করলে কিংবা টাকাপয়সার নয়ছয় করলেও রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে না? এমন আইন তৈরি করার কথা কেন ইউজিসি ভাবছে?

এটি কখনোই একক ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য যুক্তিযুক্ত অধ্যাদেশ হয়নি। ভর্তি পরীক্ষা কখনোই ইউজিসির একক দায়িত্বে বা নিয়ন্ত্রণে হওয়া উচিত হবে না। বরং স্বতন্ত্র কমিশন বা সংস্থা গঠন করে স্বাধীনভাবে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন সমীচীন হবে বলে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।

একক ভর্তি পরীক্ষা কারা সামলাবে, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন হবে কীভাবে, তা নিয়ে প্রথম আলোয় আমি লিখেছি। এটি দেখলেও অন্তত ইউজিসি কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বোধদয় হওয়ার কথা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল, এ প্রস্তাবে কেবল ইউজিসিকে দায়িত্ব না দিয়ে তারাও একসঙ্গে কাজ করা, যাতে এমন ভুল–বোঝাবুঝি কিংবা ক্ষমতায়নের বলয় জনসমক্ষে আসে।

যাহোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে একক ভর্তি পরীক্ষা নিতে হবে। ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কষ্ট লাগব করতে এমন একটি ভালো উদ্যোগকে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দড়ি টানাটানির বিষয় বানানো উচিত হবে না। বরং সরকারের উচিত হবে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে (পাবলিক ও বেসরকারি) একক ভর্তি পরীক্ষার অধীন কীভাবে নেওয়া যায়, সে জন্য প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করা।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, খুব দ্রুত একক ভর্তি পরীক্ষার নতুন খসড়া তৈরি হবে; ভবিষ্যতে লাখ লাখ ছেলেমেয়ে বাড়ির পাশে কোনো কেন্দ্রে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দেবেন; বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন ভোগান্তি ছাড়া।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: nadim.ru@gmail.com