যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে দুটি যুদ্ধজাহাজ ও রণতরি মোতায়েন করতে দেখে একটা গল্প মনে পড়ে গেল। গল্পে ঢোকার আগে জানিয়ে রাখা ভালো, যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধজাহাজ ও রণতরির আয়োজন করেছে ইসরায়েলের জন্য। যেন তারা ‘অন্যায়ের প্রতিশোধ’ নিতে ফিলিস্তিনে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে।
গল্প বলেছেন সেইন্ট অগাস্টিন। আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট একজন জলদস্যুকে একবার পাকড়াও করেছিলেন। তাঁকে তিনি বললেন, তোমার সাহস তো মন্দ না, তুমি গোটা দুনিয়াকে নষ্ট করে বেড়াচ্ছ। জবাবে ওই জলদস্যু বললেন, ‘আমার জাহাজটা যেহেতু ছোট্ট, তাই আমি তোমাদের চোখে চোর। আর যেহেতু তোমার বিশাল নৌবহর আছে, তাই একই কাজ করেও তুমি সম্রাট।’
দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ঔপনিবেশিক যুদ্ধের পর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন আবারও মধ্যপ্রাচ্যে ঢুকেছে। তাদের খদ্দের ইসরায়েলকে সুরক্ষা দিতে আমেরিকা এখন ফিলিস্তিনি ও অন্যান্য প্রতিরোধকারী গোষ্ঠীগুলোকে হুমকি দিচ্ছে। এমন এক সময়ে তারা এই অবস্থান নিল, যখন ইসরায়েল ক্রমেই গাজায় বোমাবর্ষণ করে পুরো এলাকার দখল নিতে চাইছে। তাদের এমন একটা ভাব যেন যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল যে নারকীয় তাণ্ডব চালাচ্ছে, তা এখনো যথেষ্ট হয়নি। মার্কিন প্রশাসন তাই প্রবল উৎসাহে অবরুদ্ধ গাজাবাসীকে গণহত্যায় সহযোগী হিসেবে যুক্ত রয়েছে।
নতুন-পুরোনো যেকোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মতো আমেরিকা এখন মানবাধিকার নিয়ে খুব সতর্কতার সঙ্গে কথা বলছে। কারণ, তারা নিজেরাই মানবজীবনকে ধ্বংস করে চলেছে।
যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে যে তারা যুদ্ধের নীতি অনুসরণ করে, কিন্তু ইসরায়েল যখন হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে, তখন তার পক্ষে যুক্তি খাড়া করতে দ্বিধা করে না। কোমল হৃদয়ের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি একটি মৃতদেহ দেখে দুঃখে কাতর হয়। আর হাজার হাজার নারী-শিশুকে হত্যায় প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে বা রাজনৈতিক যুক্তি উপস্থাপন করে হত্যাকারীকে সমর্থন দিতে পিছপা হয় না। তাদের কূটনীতিকেরা শান্তির কথা বলে, যুদ্ধকে উসকায়।
মধ্যপ্রাচ্যে বছরের পর বছর চালানো যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল প্রচারণামূলক শব্দের সংকলন ও সংবাদমাধ্যমের উপযোগী ভাষা শিখেছে। এই ভাষা দিয়ে তারা তাদের ন্যায়পরায়ণতা প্রদর্শন করে আর তাদের শত্রুদের ‘শয়তান’ হিসেবে উপস্থাপন করে। তারা দাবি করে যে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী প্রশিক্ষিত, ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তারা তাদের কাজ চালায়। এই আলোচনায় ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের প্রাণহানির মতো ঘটনা গুরুত্বই পায় না।
আমেরিকা ও ইসরায়েলের ভাষ্য অভিন্ন এবং বিভ্রান্তিকর। তারা বলে, তাদের যুদ্ধ বর্বরতার বিরুদ্ধে সভ্যতার যুদ্ধ, মন্দের বিরুদ্ধে ভালোর যুদ্ধ, নৈতিক দেউলিয়াত্বের বিপরীতে নৈতিক স্বচ্ছতার যুদ্ধ। তাদের যুদ্ধ সব সময় আত্মরক্ষার জন্য। তাই ন্যায়সংগত এবং মহৎ। যদি তাদের মিত্ররা সন্ত্রাসী ও একনায়কও হয়, দ্রুততার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র তাকে মুক্তিকামী ও মধ্যপন্থী বলে প্রচার করতে শুরু করে।
এই ন্যায়পরায়ণতা খুবই মূল্যবান বলে গণ্য হতো, যদি এতে সত্য বা সামান্য সততা থাকত। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের এই কৌশলগত বন্ধুত্বের শুরু ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ ও দখলের পর। ওই সময় থেকে এই অঞ্চল অস্থিতিশীল এবং নৃশংসতার ঘূর্ণাবর্তে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬০ সালে ইসরায়েলকে এ অঞ্চলে পুলিশের ‘মর্যাদা’ দেয়, ১৯৭০-এ ইসরায়েল প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে দাঁড়ায়, কৌশলগত কারণে ইসরায়েল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ১৯৮০ সালে। তখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে ইসরায়েল বরাবর সামনে থেকেছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো যতবারই ইসরায়েল কোনো শান্তি উদ্যোগ নাকচ করেছে, ততবারই পেন্টাগন তার জন্য নতুন একটা সামরিক সহায়তা চুক্তি নিয়ে হাজির হয়েছে।
এর মধ্যে সর্ব সাম্প্রতিক চুক্তির মূল্য ৩৮ বিলিয়ন ডলার। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন শত্রু খুঁজে বের করা অথবা এই অঞ্চলে আরও বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা সৃষ্টির আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের উচিত নিজেদের চেহারাটা আয়নায় দেখা এবং আমাদের ভয়াবহ যুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করা।
১০ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা ও হাজার হাজার মানুষকে জখমের পর অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন আবারও মধ্যপ্রাচ্যে গেছেন। এবার তাঁর উদ্দেশ্য ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধকে কূটনীতি ও কৌশলগত সফলতা বলে চালানো। তারা হয়তো ঔপনিবেশিক ইসরায়েলকে ঘিরে ‘শান্তি উদ্যোগ’ নিতে চায়। তাতে আরব দেশগুলোকে জবরদস্তি করে অন্তর্ভুক্তও করা হতে পারে।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
মারওয়ান বিশারা আল-জাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক