সভা–সমাবেশ ঠেকাতে ধরপাকড় ও নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদ

নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে থেকে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ
ছবি : প্রথম আলো

নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদ সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আন্দ্রেয়াস শেডলার লিখেছেন, নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদ বা ইলেকটোরাল অথোরিটারিয়ানিজমে জনপ্রতিনিধি ও সরকারপ্রধান নির্বাচিত করার জন্য নিয়মিতই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও ন্যায্যতার উদার গণতান্ত্রিক নীতিমালাকে এমন ব্যাপক ও পদ্ধতিগতভাবে লঙ্ঘন করা হয় যে নির্বাচন বিষয়টি ‘গণতন্ত্রের হাতিয়ার’-এর বদলে কর্তৃত্ববাদের হাতিয়ারে পরিণত হয়। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনে সর্বজনীন ভোটাধিকারের স্বীকৃতি এবং বিরোধী দলগুলোকে অংশ নিতে দেওয়া হলেও সব মিলিয়ে নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় এত মারাত্মক, ব্যাপক ও পদ্ধতিগতভাবে রাষ্ট্রীয় প্রভাব বিস্তার করা হয় যে তখন আর তাকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলা চলে না।

কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় যেসব উপায় অবলম্বন করে নির্বাচনের ওপর প্রভাব বিস্তার করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে: বৈষম্যমূলক নির্বাচনী আইন, বিরোধী দল ও প্রার্থীদের নির্বাচনের মাঠ থেকে দূরে রাখা, তাদের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারবঞ্চিত করা, তাদের গণমাধ্যমে অংশগ্রহণ ও অর্থ সংগ্রহে নিয়ন্ত্রণ আরোপ, সমর্থকদের ভোটাধিকারে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক নানা উপায়ে বাধা প্রদান, ভয়ভীতি কিংবা প্রলোভনের মাধ্যমে পক্ষ ত্যাগ করানো কিংবা স্রেফ ভোট জালিয়াতি করা। (তথ্যসূত্র: দ্য পলিটিক্স অব আনসার্টেইনিটি সাসটেইনিং অ্যান্ড সাবভার্টিং ইলেক্টোরাল অথরিটারিয়ানিজম, ২০১৩ বাই আন্দ্রেয়াস শেডলার)

গবেষকেরা দেখিয়েছেন নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনের দিন ছাড়াও নির্বাচনের ওপর প্রভাব বিস্তারের নানা পদ্ধতি রয়েছে, যেমন ইনস্ট্রুমেন্টাল ম্যানিপুলেশন, ইনফরমেশনাল ম্যানিপুলেশন ইত্যাদি। ইনস্ট্রুমেন্টাল ম্যানিপুলেশন হলো সরাসরি নির্বাচনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, এমন সব কাজ কারবার, যার মধ্যে রয়েছে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ ও প্রচারণায় বাধা দেওয়া, ভোটের আইনকানুন ও ভোটার রেজিস্ট্রেশনের ওপর প্রভাব বিস্তার, ভোটারদের প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে সরকারি অর্থ ব্যয় ইত্যাদি।

অন্যদিকে ইনফরমেশনাল ম্যানিপুলেশন হলো নির্বাচনের আইনকানুন, ভোটার বা প্রতিপক্ষের ওপর প্রত্যক্ষ কোনো কার্যক্রম না চালিয়ে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করা, যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও স্থাপনা ব্যবহার করে সরকারি দলের নির্বাচনী প্রচারণা চালানো, সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষমতাসীন দলের সভা সমাবেশ ও প্রচারণায় ব্যবহার করা, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলোয় পক্ষপাতদুষ্ট প্রচারণা ও তথ্য প্রচার ইত্যাদি। (তথ্যসূত্র: ইলেক্টোরাল স্ট্র্যাটেজিস আন্ডার অথরিটারিয়ানিজম: এভিডেন্স ফ্রম দ্য ফরমার সোভিয়েত ইউনিয়ন, ২০১৯ বাই মেগান হাউসার)

বাংলাদেশে নির্বাচনের বহু আগে থেকেই সারা বছর ধরে এ ধরনের ইনস্ট্রুমেন্টাল ও ইনফরমেশনাল ম্যানিপুলেশন জারি থাকে। এর অংশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধী দলের সভা–সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া না হলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে সভা–সমাবেশ করার পথে সব ধরনের বাধা তৈরি করা হয়। তার জন্য ক্ষমতাসীন দল, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নানাভাবে কাজে লাগানো হয়। সাম্প্রতিক কালে বিরোধী দল বিএনপির বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে অনুষ্ঠিত সমাবেশে এবং ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বিভাগীয় সমাবেশ উপলক্ষে যেভাবে বাধা তৈরি করা হয়েছে এবং হচ্ছে তা সরকারের কর্তৃত্ববাদী আচরণেই অংশ।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, ১০ ডিসেম্বর ঘিরে রাজধানী ঢাকাকে ‘অবরুদ্ধ’ করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এ পরিকল্পনা অনুসারে, ১০ ডিসেম্বর ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা কার্যত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেওয়া হবে, যাতে কয়েক স্তরের বাধা ভেদ করে বিএনপির পক্ষে বড় জমায়েত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর ফলে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে পড়লেও পরিস্থিতি যে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে, এটা প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহলে বোঝানোর জন্য সরকার তার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে।(সূত্র: বিএনপির সমাবেশ ‘সফল’ হতে দেবে না সরকার, ৬ ডিসেম্বর ২০২২, প্রথম আলো)

এর আগে ১ ডিসেম্বর থেকে সারা দেশে পুলিশের বিশেষ অভিযান শুরু হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে এই বিশেষ অভিযানের কারণ হিসেবে জঙ্গি দমন, মহান বিজয় দিবস, খ্রিষ্টানদের বড়দিন ও খ্রিষ্টীয় বর্ষবরণ উদ্‌যাপন নিরাপদ-নির্বিঘ্ন করার কথা বলা হলেও বিএনপি অভিযোগ করেছে, এ বিশেষ অভিযান আসলে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় গণসমাবেশ সামনে রেখেই চালানো হচ্ছে। দলটি বলছে, তালিকা ধরে তাদের মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও সংগঠকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর ও আশপাশের জেলার নেতারা অভিযানের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। প্রায় প্রতি রাতে বিভিন্নজনের বাড়িঘরে অভিযান চালানো হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বিশেষ অভিযানের প্রথম পাঁচ দিনে (৫ ডিসেম্বর সকাল ৬টা পর্যন্ত) সারা দেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩ হাজার ৮৯৫ জনকে। (সূত্র: ১০ ডিসেম্বর ঘিরেই বিশেষ অভিযান, প্রথম আলো, ৭ ডিসেম্বর ২০২২)

এর আগে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে লোকসমাগম ঠেকাতে সরকারের ইঙ্গিতে গণপরিবহনের ধর্মঘট ডেকে সমাবেশের জন্য নির্দিষ্ট শহরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। (সূত্র: বিএনপির সমাবেশের শহরে গণপরিবহন রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে?, বিবিসি বাংলা অনলাইন, ১৭ নভেম্বর ২০২২)

এ রকম পরিস্থিতি যে এবারই প্রথম হচ্ছে, তা নয়, এর আগেও বিভিন্ন সময় এমন ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষেও নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই বিরোধী দলের ওপর নানাভাবে চাপ তৈরি করা হয়েছিল। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা যেন নিজ এলাকায় থেকে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নিতে না পারেন, সে উদ্দেশ্যে নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকেই কল্পিত অপরাধের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দেওয়া হতে থাকে।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানী ঢাকায় উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা না ঘটলেও ঢাকা মহানগরের ৫০টি থানা এলাকায় বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বেআইনি জমায়েত, পুলিশের ওপর হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ এবং নাশকতার চেষ্টা চালানোর অভিযোগে শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই ৫৭৮টি মামলা করা হয়। এসব মামলায় বিএনপির কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে আসামি করে তাদের ধরতে ‘বিশেষ অভিযান’ শুরু করে ঢাকা মহানগর পুলিশ।

ফলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হলেও বিএনপির নেতা-কর্মীরা পালিয়েই বেড়াতে বাধ্য হন। সেপ্টেম্বর ছাড়াও ২০১৮ সালের অক্টোবর, নভেম্বরেও নাশকতার মামলা হয়েছে। অক্টোবরে ৭৬টি ও নভেম্বরে ৪৩টি নাশকতা মামলার তথ্য পাওয়া যায়। সেপ্টেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত এসব মামলায় বিএনপি-জামায়াত ও এর অঙ্গসংগঠনের ১ হাজার ৫০৯ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। (সূত্র: এক ভয়ংকর সেপ্টেম্বর!, ২০ ডিসেম্বর ২০১৮, প্রথম আলো)

কোনো দেশে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে শুধু নির্বাচনের দিন সুষ্ঠু ভোট হলেই হবে না, নির্বাচনের আগের বছরগুলোতেও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ-অর্থ-অবকাঠামো-আইন-প্রশাসনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে

অথচ সভা–সমাবেশ করা কিংবা রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত হওয়া ইত্যাদি যেকোনো দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ন্যূনতম শর্ত। বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে গণতন্ত্র থাকার কথা বলা হলেও ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো লঙ্ঘিত হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। আসলে গত তিন দশকে যে রাজনৈতিক শক্তিগুলো বাংলাদেশকে শাসন করেছে, তারা যে গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের বস্তুগত স্বার্থের সঙ্গে এসব গণতান্ত্রিক দাবি–দাওয়া ও আকাঙ্ক্ষার মৌলিক বিরোধ রয়েছে। এ কারণে আন্দোলনের চাপে পড়ে বিভিন্ন সময় তারা অবাধ নির্বাচন, আইনের শাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে নানান প্রতিশ্রুতি দিলেও ক্ষমতায় গিয়ে এগুলো বাস্তবায়নের জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেনি, যার প্রতিক্রিয়ায় তাদের অনিয়ম, দুর্নীতি, লুণ্ঠনের সব পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে, কোনো দেশে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে শুধু নির্বাচনের দিন সুষ্ঠু ভোট হলেই হবে না, নির্বাচনের আগের বছরগুলোতেও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ-অর্থ-অবকাঠামো-আইন-প্রশাসনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। আর এসব বিষয় নিশ্চিত করতে হলে দেশের সংবিধান ও আইনকানুনের সংস্কার, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও অর্থ ব্যবহারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। এটা ঠিক যে ভোটের দিনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হলে সারা বছরের গণতন্ত্রের লড়াই করাও মুশকিল হয়ে যায়।

ভোটের দিন যদি ইচ্ছামতো ভোট লুটে নেওয়া যায়, তাহলে সারা বছরের গণতন্ত্র কায়েমের জন্য শাসকগোষ্ঠীর ওপর চাপ তৈরি করা বিরোধী দলগুলোর জন্য কঠিন হয়ে যায়। কাজেই লড়াইটা দুই ফ্রন্টেই চালাতে হবে—ভোটের দিনের গণতন্ত্রের জন্য যেমন লড়তে হবে, তেমনি সারা বছরের গণতন্ত্রের অ্যাজেন্ডাকেও সেই লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে স্থির করতে হবে।

দুনিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলো তো বটেই, অনেক কর্তৃত্ববাদী দেশও বহু আগেই নির্বাচনের দিনের ভোট জালিয়াতির বিতর্ক থেকে বেরিয়ে এসেছে। এসব দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা অন্তত এইটুকু পরিপক্বতা অর্জন করতে পেরেছে যে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার মধ্যেও ভোটের দিন ব্যাপকহারে সরাসরি ভোট জালিয়াতি করা সম্ভব হয় না। ফলে এসব দেশে রাজনৈতিক বিতর্কের জায়গাটা নির্বাচনের দিনের গণতন্ত্রকে ছাড়িয়ে সারা বছরের গণতন্ত্রের দিকে ধাবিত হতে পেরেছে।

বাংলাদেশের জনগণের দিক থেকে আফসোসের ব্যাপার হলো স্বাধীনতার ৫০ বছরের বেশি সময় পার হয়ে এসেও ভোটের দিনের জালিয়াতি এখনো বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রধান সমস্যা, ফলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির লড়াই ভোটের দিনের গণতন্ত্রের প্রশ্ন অতিক্রম করে সারা বছরের গণতন্ত্র ও অধিকারের লড়াইয়ের দিকে মনোযোগ দিতে পারছে না।

  • কল্লোল মোস্তফা লেখক ও প্রকৌশলী, সর্বজনকথা সাময়িকীর নির্বাহী সম্পাদক