বাঁশের চটা দিয়ে বানানো সরু পোলোর মতো কাঠামোর ওপর চ্যাপটা অ্যালুমিনিয়ামের বিরাট থালা রেখে স্কুলগেটের মুখে দাঁড়াতেন হরি কাকু। থালার ওপর আঠালো গুড়ের (নাকি জ্বাল দেওয়া চিনির শিরা!) টানার ওপর বাদাম ছড়িয়ে দেওয়া জিনিসটার নাম মদন-কটকটি। দুই টাকা দিলে কাকু টুক করে মাটির ভাঙা কলসির চাড়ার (খোলামকুচি) মতো মদন-কটকটির একটা টুকরা ভেঙে কাগজে করে দিতেন।
বহু বছর পর দেখি সেই মদন–কটকটি নামীদামি কোম্পানির চকমকা ফিনফিনে প্লাস্টিকের মিনি প্যাকেটে ঢুকে ‘পি-নাট বার’ হয়ে গেছে। বিএসটিআইয়ের সিল মারা সেই পি-নাট বারের মোড়ক লম্বায় ইঞ্চি চারেক, প্রস্থে পৌনে এক ইঞ্চিমতো। প্যাকেটের ভেতরের পি–নাট বারের দৈর্ঘ্য-প্রস্থও প্রায় একই।
হরি কাকুর কটকটির মতো স্বাদের না হলেও পি-নাট বার খেতে খারাপ না। বাচ্চারা পছন্দ করে বলে মাঝে মাঝে দোকান থেকে পাঁচ-দশটা কিনে বাসায় ঢুকি।
সেদিন শিশুপুত্রের হাতে পি-নাট বার দেওয়ার পর সে দাঁত দিয়ে প্যাকেট ছিঁড়ে ভেতরের মদন কটকটি ওরফে পি-নাট বার টেনে বার করল। তারপর সেটা হাতের তালুতে রেখে আমার দিকে অভিযোগের সুরে হিন্দি কার্টুন সিরিজ ‘চিকু-বান্টি’র সংলাপ ছুড়ে দিল, ‘তুম উল্লু বানায়া মুঝে?’ তার গলায় প্রতারিত হওয়ার অভিব্যক্তি স্পষ্ট।
আমি বললাম, ‘কেন? আমি আবার তোকে কখন উল্লু বানালাম?’
সে তখন প্যাকেট আর হাতের পি-নাট বার দেখাল। খেয়াল করে দেখি, প্যাকেট আগের মাপেই আছে, কিন্তু ভেতরের মাল খাটো হয়ে গেছে। চার বছর বয়সী বাচ্চাকে ১৪ বছরের বাচ্চার পায়জামা পরালে, পায়জামার আগা যেভাবে ঢলঢল করে, সেই রকমের একটা ব্যাপার হয়েছে। চার ইঞ্চি প্যাকেট থেকে বেরিয়ে এসেছে দুই ইঞ্চির কম লম্বা পি-নাট বার।
পরের দিন একই জিনিস কিনতে গিয়ে দোকানদারকে বললাম, ‘ভাই, ঘটনা অ্যাবা হলো ক্যাবা কইরে?’
দোকানদার হেসে বললেন, ‘মামা, সবই কপাল! সারা দুইন্যার অত্থনীতিক ভালো না। যুদ্ধ বাধল ইউকেরেনে, ফুল হাতার পি-নাট বার হাফ হাতা হইলো বাংলাদেশে।’
খেয়াল করে দেখলাম, বিএসটিআইয়ের অনুমোদনের সিল তখনো আছে। তার মানে, যা হচ্ছে সরকারি নিয়মেই হচ্ছে।
দুদিন আগে মুদির দোকানে গিয়েছি সাবান কিনতে। বিখ্যাত ব্র্যান্ডের কাপড় কাচা সাবান চাইলাম। দোকানি সাবানটা হাতে দিতেই চমকে গেছি। আগে সাবান যতটা পুরু ও ওজনদার ছিল, তার অর্ধেকও এখন নেই।
বললাম, ‘মামা, কী ঘটনা?’
দোকানদার বললেন, ‘যারা আগের মতো মোটা সাবান কেনার ক্ষমতা হারায় ফেলসে, তাগো লিগ্যা এই সিলিম সাবান।’
সেই ‘স্লিম’ সাবান দিয়ে কাপড় কাচতে গিয়ে দেখি, সাবানের অর্ধেকের কম খরচ হওয়ার পর সেটাকে আর সাবান সাবান মনে হচ্ছে না। শুরুতে কাপড়ে সাবান ডলা দেওয়ার পর যেভাবে সহজে ফেনা হচ্ছিল, তা আর হচ্ছে না। দ্বিগুণ জোরে ডলা-ঘষা করতে হচ্ছে। কিন্তু ফেনা হচ্ছে না। মানে সাবানের সাইজ পাওয়া গেছে আগের তুলনায় অর্ধেক, দাম পড়েছে আগের তুলনায় দ্বিগুণ, আর ডলা-ঘষায় জোর খাটাতে হয়েছে আগের চেয়ে বেশি। সাবানের ‘চল্টা’ কাপড়ে ঘষার সময় রাগে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল—‘তুম উল্লু বানায়া মুঝে!’
অফিসের নিচে মোল্লার চায়ের দোকানে গিয়ে দেখি একই ‘কেস’। পাউরুটির সাইজ জামবাটি থেকে নুনের বাটিতে নেমেছে। পাঁচ টাকা দামের বিস্কুটের চেহারা-ছবি লিলিপুটের মতো ঠেকছে। কেকের স্লাইস আগের চেয়ে শুধু যে চওড়ায়-বহরে কমেছে, তা না; তার ‘শারীরিক কাঠামো’ সুপার মডেলদের চেয়ে স্লিম হয়ে গেছে। কেকে কামড় বসালে আগে ডিমের যে ঘ্রাণ আসত, সেই ঘ্রাণও এখন ফিকে হয়ে গেছে।
কারওয়ান বাজারের ‘মিন্তি’ (বাজার করতে আসা লোকজনের সদাই ঝাঁকায় করে যাঁরা গাড়ি বা রিকশায় তুলে দেন) আজমল বললেন, ‘সকালে একখান পাউরুটি, একখান কলা আর চা খাই। তাতেই প্যাট ভইর্যা যাইত। কয় দিন ধইর্যা যে পাউরুটি খাইতেছি, তা ছুডো হয়া গ্যাছে গা। প্যাট ভরে না। কিন্তু তাই খায়াই দাঁত কেটকি মাইরা ব্যালা পার করতে অয়। একটার জায়গায় দুইটা রুটি কিনবার অবস্থা নাই।’
দুপুর বেলা লাঞ্চ করতে রেস্তোরাঁ বা ক্যানটিনে ঢোকার পর ইদানীং বেশি বেশি মনে হয় ‘জগৎ ছোট হয়ে আসছে’। খিদের পেটে ছন্দ-মাত্রার ঠিক নেই এমন স্বরচিত দর্শনাশ্রিত এক খিলি কাব্য-কথা মাথায় ঘুরতে থাকে:
‘ছোট হয়ে আসছে সব—
ছোট হয়ে আসছে আলামিনের মাগুর মাছের ঝোলের পেয়ালা
কাঁচকলা আর আলু ভর্তার দলা
ছোট হয়ে আসছে টিলার মতো ভাতের বোঝার ওপর পুঁইশাকের আঁটি।
ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী—
ছোট হয়ে আসছে
অফিসের ক্যানটিনে মাংসের বাটি।’
বাটিতে মাংসের বিরল উপস্থিতিতে আপনার প্রথমে মনে হবে, ক্যানটিনওয়ালারা কি আপনাকে ‘উল্লু’ বানাচ্ছে? পরক্ষণে নিজেই নিজেকে বলবেন, ‘বাবা রে, বাজারে এক কেজি গরুর মাংসের দাম আটশো থেকে সাড়ে আটশো টাকা। এই সুররিয়ালিস্টিক দাম-দরের বাজারে রিয়ালিস্টিক জিনিস আশা করো ক্যান?
বিভিন্ন ক্যানটিন রেস্তোরাঁয় গরুর মাংসের অর্ডার দিলে বাটিতে করে যা আনা হয়, সেটিকে গরুর মাংস না বলে ‘গরুর মাংসের ধারণা’ বা আরও ভদ্দরলোকি ভাষায় ‘কনসেপ্ট অব বিফ’ (সংক্ষেপে ‘সিওবি’ বা ‘কব’ও বলা যেতে পারে) বলা যেতে পারে। মানে, ভুনা মাংসের বাটি হিসেবে যে বাটিটি আপনার সামনে রাখা হবে, আপনি তার ভেতরে থাকা মসলার ঢিবিতে হাতড়ে মাংস খুঁজতে থাকবেন এবং একপর্যায়ে দু–এক টুকরা মাংস পেয়ে আপনার ধারণা হবে যে আপনি আসলেই মাংস দিয়ে ভাত খাচ্ছেন।
বাটিতে মাংসের বিরল উপস্থিতিতে আপনার প্রথমে মনে হবে, ক্যানটিনওয়ালারা কি আপনাকে ‘উল্লু’ বানাচ্ছে? পরক্ষণে নিজেই নিজেকে বলবেন, ‘বাবা রে, বাজারে এক কেজি গরুর মাংসের দাম আটশো থেকে সাড়ে আটশো টাকা। এই সুররিয়ালিস্টিক দাম-দরের বাজারে রিয়ালিস্টিক জিনিস আশা করো ক্যান?
জানো না! সরকারের বাজেট আর সংসারের বাজেট এক জিনিস না! সরকারের বাজেট বাড়ছে, সেই তুলনায় সংসারের বাজেট বাড়ছে না। সেই কারণে সব ছোট হচ্ছে। চাল-ডাল-তেল-নুনের লিস্টি থেকে শুরু করে সবকিছু ছোট হয়ে আসছে।’
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com