ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, আমাদের এলাকার মানুষের আয়োডিনের অভাব। আশপাশে তাকালে গলগণ্ড বা ঘ্যাগওয়ালা মানুষ দেখতে পেতাম প্রচুর। আয়োডিনের অভাবে বুদ্ধিরও ঘাটতি হয়। আমরা কমবুদ্ধির মানুষ, তাই সোজা কথা সহজভাবেই বুঝি।
যেমন ধরুন ইশপের মিথ্যাবাদী রাখাল আর বাঘের গল্পটা। আমরা এটার মানে জানি—সদা সত্য কথা বলবে, কখনো মিথ্যা বলবে না। কিন্তু এই গল্পের আরও নতুন নতুন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। একটা হলো, বালকদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে দেওয়া উচিত নয়।
আরেকটা হলো, রাখাল বালক যতবার মিথ্যা বলেছিল, ততবারই তার উদ্ধারে গ্রামবাসী এগিয়ে এসেছিল। একবার মাত্র সে সত্য বলেছিল, সেবার আর কেউ এগিয়ে আসেনি। কাজেই সত্য বললে ধরা খাবে।
চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। স্বল্প-আয়োডিনের সরল বুদ্ধিতে এই কথাটার মানে বুঝতাম, বিপদের সময় বা প্রয়োজনের সময় সঠিক বুদ্ধিটা চট করে আসে না। বিপদ বা প্রয়োজন চলে যাওয়ার পর বুদ্ধিটা এসে মাথায় উঁকি দিতে থাকে। আরে, এইটা করা যেত, ওইটা করা যেত। বাড়িতে বা পাড়ায় চোর এলে লোকে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। চোর পালিয়ে যাওয়ার পর মনে হয়, আরে, চোরটাকে তো এইভাবে ধরা যেত, ওইভাবে ধরা যেত।
কিন্তু বুদ্ধিমান লোকেদের কাছে এসে এই কথাটার নতুন ব্যাখ্যা পেলাম। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। কাজেই আপনি চোরকে পালাতে দিন। আমাদের চারপাশে অসংখ্য চোর। এই চোরদের কেন গৃহস্থরা পালানোর সুযোগ করে দেন? কারণ, এর ফলে গৃহস্থের বুদ্ধি বাড়ে। চোরকে পালাতে দিলে ব্যাপারটা আয়োডিনের কাজ করে। ব্রেন শক্তিশালী হয়।
হবেও বুঝিবা। তা না হলে যাঁরা চোরকে পলায়ন করতে দিচ্ছেন, তাঁদেরকেই কেন দেখছি সবচেয়ে স্মার্ট, সবচেয়ে চৌকস, সবচেয়ে পারঙ্গম। যে বেচারারা চোর ধরবার চেষ্টা করেছেন, তাঁরা এখন পস্তাচ্ছেন। ইতিহাস তাঁদের পক্ষ নিচ্ছে না।
তবে চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে—এই কথাটাকে ঘুরিয়ে আরও একভাবে বলা যায়। আর তা হলো, চোরকে প্রতিপালন করালে বুদ্ধি বাড়ে। আপনি চোরকে পালতে দেবেন। কারও হাতে চোরকে তুলে দিয়ে বলবেন, পেলে-পুষে মানুষ করে দিন বা চোর করে দিন।
এটা আমাদের ঘরে-বাইরে করে যেতে হয়। আপনার ড্রাইভার, রোজ ঠিক সময়ে আসে, বেশি রাত করে ডিউটি করলেও কোনো ওজর-আপত্তি করে না, গাড়ি ভালো চালায়, গাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে, যন্ত্রপাতি করে, আপনার বাজার-সদাই করে দিতেও তার আপত্তি নাই, আদব-কায়দা ভালো, শুধু একটাই সমস্যা, ছোটখাটো চুরি করে।
আপনি তাকে দিয়ে তেল কেনান, সে ৫ হাজার টাকার তেল কিনে ৫ হাজার ৫০০ টাকা দাবি করে। আপনি কিন্তু তাকে বাদ দেন না। রেখে দেন। কারণ, কিছু টাকা আপনার বেশি যায় বটে, তার বিনিময়ে আপনি ভালো সার্ভিস পান।
এই ঘটনাটাই ম্যাক্রোলেভেলে ঘটতে পারে। কর্তা জানেন, তাঁর এই কর্মচারী একটু চুরিচামারি করে, ঘুষ-টুষ খায়, টাকাপয়সা নয়ছয় করে, কেউবা একটু পটেটো-চিপস ভালোবাসে, কারও-বা আনুষঙ্গিক আরও কিছু অভ্যাস আছে, তারপরও তিনি কিছু বলেন না। পালেন। প্রতিপালন করেন। পালতে দেন। মানে পালান। এইভাবেও চোর পালানো যায়। আর এইভাবে চোরদের পালাতে দিলে কর্তার বুদ্ধি বাড়তে থাকে।
‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’—একটা আড্ডায় এই বাগধারাটির এ প্রকার ব্যাখ্যা শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ। কিছুক্ষণ নিজের তর্জনী নিজের কপালে ঠুকলাম। তাই তো। চোরকে পালাতে দিলে বুদ্ধি বাড়ে। আর চোরকে পালতে দিলে, মানে প্রতিপালন করতে দিলেও বুদ্ধি এবং সাফল্য বাড়ে।
‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’—একটা আড্ডায় এই বাগধারাটির এ প্রকার ব্যাখ্যা শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ। কিছুক্ষণ নিজের তর্জনী নিজের কপালে ঠুকলাম। তাই তো। চোরকে পালাতে দিলে বুদ্ধি বাড়ে। আর চোরকে পালতে দিলে, মানে প্রতিপালন করতে দিলেও বুদ্ধি এবং সাফল্য বাড়ে।
সেই কারণে বুদ্ধিমানেরা চোরদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেন না। বরং এমন ব্যবস্থা কায়েম করে রাখেন, যাতে চোরেরা প্রতিপালিত হয় এবং যথাসময়ে পলায়ন করতে সমর্থ হয়। এর ফলে তাঁদের বুদ্ধি আরও বেড়ে যায়।
আয়োডিনের অভাবে সব সময়ই বোকার দলেই ছিলাম। কখনোই বুদ্ধিমান ছিলাম না, ঠিক কাজটি করিনি। বুদ্ধির ঘাটতি দূর করতে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খাব বলে ভাবি। বুদ্ধির অভাবে তাও করা হয়ে ওঠে না।
এখন ভাবছি, কিছু চোরকে পালিয়ে যেতে দিই। দেখি বুদ্ধি বাড়ে কি না।
কিন্তু চোরেরা আমার চেয়ে ঢের বেশি বুদ্ধিমান। তারা আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসে, পালায় না। পালাবে কেন। পালালে যে আমার বুদ্ধি বেড়ে যাবে!
তবুও আশা হারাই না। মনে মনে জপ করি, চোরের দশ দিন, সাধুর এক দিন।
একদিন পাশার দান উল্টে যাবে। চোর ধরা পড়বেই।
কিন্তু চোরদের ধরা পড়তে দেখি না।
লালন সাঁইয়ের গান মনে করি:
ধরো চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে।
সেকি সামান্য চোরা ধরবি কোনা কাঞ্চীতে॥
পাতালে চোরের বহর
দেখায় আশমানের উপর,
তিন তারে হচ্ছে খবর,
হাওয়া মূলাধার তাতে॥
লালন ঠিকই বলেছেন। এই চোর সামান্য নয়। তাঁদের বিচরণ আন্ডারগ্রাউন্ডে, কিন্তু তাঁদের দেখা যায় আসমানের ওপর। এদের ধরা আমাদের সাধ্যি নয়। যাঁদের সাধ্যি ছিল, তাঁরা ধরেন না।
এই রে, আবার লালনকে সাঁইকে উদ্ধৃত করলাম। ধরেটরে নিয়ে যাবে না তো!
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক