এই আর সপ্তাহ দুয়েক পর প্রকৃতিতে গ্রীষ্মের দাবদাহ শুরু হতে যাচ্ছে। গত বছর মার্চ থেকে শুরু করে একদম সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা দাবদাহ ছিল। গত দুই বছরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেশ কয়েকবার রেকর্ড ভেঙেছে। উপকূলে বছরে একাধিক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে শুরু করেছে।
সিলেটের উজান থেকে নেমে আসা ঢলে হাওরে অস্বাভাবিক বন্যায় ধানের ক্ষতি আমরা দেখেছি। এসব কারণে হাওর, উপকূল ও শহরের সাধারণ নাগরিকদের এ জন্য অনেক কষ্ট ও ভোগান্তি সহ্য করতে হয়েছে।
এখন অনেকেরই মনে প্রশ্ন, এবারও কি গত বছরের মতো প্রকৃতি বৈরী আচরণ করবে? প্রকৃতিতে নেমে আসবে একের পর এক দুর্যোগ ও বিপর্যয়। আর এসব কি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত? এই তীব্র গরম আর চরম আবহাওয়া থেকে কি তবে বাংলাদেশের মানুষের রক্ষা পাওয়ার কোনো পথ নেই।
এই প্রশ্নের সরাসরি কোনো হ্যাঁ অথবা না উত্তর নেই। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতি যে বৈরী হয়ে উঠছে, প্রতিটি ঋতু যে চরম আচরণ করছে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। সময় যত গড়াবে, এ ধরনের বিপদ তত বাড়বে। তবে এই বৈরিতা থেকে রক্ষা পেতে আমাদের প্রকৃতির দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া ভিন্ন কোনো উপায় নেই।
শহরগুলোয় আমরা দেখি গরমের তীব্রতা কমাতে গাছপালা ও জলাভূমি রক্ষার চেয়ে ঘরে ঘরে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র স্থাপনের প্রতিযোগিতা। এতে ঘরের ভেতরে তাপ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সামগ্রিকভাবে শহরে গরম বাড়ছে। একইভাবে আমরা বলতে পারি বঙ্গোপসাগর থেকে আসা ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ হতে পারে আমাদের সুন্দরবন। ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, ইয়াস ও মহাসেনের ক্ষেত্রে আমরা তেমনটা দেখেছি।
একইভাবে আমরা হাওরগুলোর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এবং বৈশিষ্ট্যকে যদি রক্ষা করতে পারি, তাহলে তা সেখানকার জনগোষ্ঠীকে তো বটেই, সারা দেশের মানুষের বিপদ কমাতে পারে। কারণ, আমাদের হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার হাওর শীতকালীন পাখির আশ্রয়স্থল, জীববৈচিত্র্যের আধার। আবার একই সঙ্গে মাছের বিশাল ভান্ডার। আর এর চারপাশের হাওরগুলোয় দেশের ধানভান্ডার। ফলে হাওরগুলোকে তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে রক্ষা করতে হবে।
অন্যদিকে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে, তা নানাভাবে প্রমাণিত। লবণাক্ত পানি উপকূল দিয়ে ধেয়ে আসায় এবং ভূগর্ভের পানি বেশি উত্তোলনের কারণে উপকূল দিয়ে লবণাক্ত পানি দেশের ভেতরে প্রবেশ করবে। উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত লবণপানি প্রবেশ করছে।
এদিকে বৃষ্টির সময়কালেরও বড় পরিবর্তন আমরা দেখতে পাচ্ছি। যেমন বর্ষার আগে বৃষ্টি বাড়ছে, যা হাওরে ধান পাকার আগে আগাম ঢল নিয়ে আসছে। ওই এলাকার বছরের একমাত্র ফসল বোরো ধান এতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যা ওই এলাকার অধিবাসীদের দীর্ঘ মেয়াদে দারিদ্র্যের মধ্যে ফেলছে। সামগ্রিকভাবে দেশেও খাদ্যনিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলছে। চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে।
জলবায়ুর এসব পরিবর্তন দীর্ঘ মেয়াদে দেশের খাদ্যনিরাপত্তার ওপর চাপ বাড়বে। সুপেয় পানির অভাব দেখা দেবে, স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, দারিদ্র্য বাড়বে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়বে এবং সাধারণ মানুষের জীবিকা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এরই মধ্যে আমরা দেখেছি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোয় দারিদ্র্যের হার দ্রুত বাড়ছে। যেমন কুড়িগ্রামে প্রায় প্রতিবছর একাধিকবার বন্যা হয়। পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা ও বরিশালে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়। সুনামগঞ্জে নামছে আগাম বন্যা। এসব দুর্যোগের কারণে ওই সব এলাকায় দারিদ্র্যের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ইতিমধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়াগুলো মোকাবিলার জন্য সরকার ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান বা জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরি করেছে। বিশ্বজুড়ে বলা হচ্ছে, এ জন্য কমিউনিটিভিত্তিক অ্যাডাপ্টেশন বা সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে অভিযোজন, ইকোসিস্টেমভিত্তিক অ্যাডাপ্টেশন বা প্রতিবেশসম্মত অভিযোজন এবং নেচারভিত্তিক সলিউশন বা পরিবেশভিত্তিক অভিযোজনের পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশে অনেকগুলো এলাকাকে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) বা প্রতিবেশ-সংকটাপন্ন এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকা জীববৈচিত্র্যের বিবেচনায় খুব সমৃদ্ধ। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে এই এলাকায় এবং এসব এলাকার ওপর নির্ভরশীল জনমানুষের জীবনযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সুন্দরবন ও হাকালুকি হাওর দুটি এলাকাকে সরকার ইতিমধ্যে প্রতিবেশসংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই দুই এলাকা ও এলাকা দুটির ওপর নির্ভরশীল কাছাকাছি এলাকার জনসাধারণকে কেন্দ্র করে প্রকৃতিসম্মত অভিযোজনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
দুটি এলাকার এই প্রকৃতিনির্ভর ব্যবস্থাপনা সফল হলে তা সারা দেশের অন্য ইসিএ এলাকা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি মডেল বা অনুসরণীয় কাঠামো তৈরি করবে। অন্য ইসিএগুলো যদি তা অনুসরণ করে, তাহলে তা সারা দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এসব প্রাকৃতিক সম্পদ কেন্দ্রীয় জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার উন্নয়নে তা আমাদের পথ দেখাবে।
একই সঙ্গে স্থানীয় নাগরিকদের সহযোগিতায় এই দুটি এলাকায় দুটি ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। স্থানীয় জনসাধারণ এই দুটি জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ এলাকার ওপর নির্ভরশীল, তাদের এই নির্ভরতা কমাতে এবং পরিবেশসম্মত সম্পদ আহরণের বিষয়ে সুশিক্ষিত করে তুলতে হবে। উপকারভোগীদের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। যেমন স্থানীয় লোকজনের বড় অংশ রান্নার জ্বালানি হিসেবে বন ও প্রকৃতি থেকে কাঠ সংগ্রহ করে। এটা কমিয়ে সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে স্থানীয় লোকজনকে উৎসাহ ও সহযোগিতা দিতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুপেয় পানির প্রাপ্যতা ওই এলাকার জনসাধারণের জন্য বিশেষ সমস্যা, এই সমস্যার সুরাহা করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁদের জীবিকার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারলেই তাঁরা পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণে উৎসাহী হবেন। এলাকা দুটিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দেওয়ার কাজটি পর্যালোচনা করে তাঁকে জনসাধারণের ব্যবহার উপযোগী করা হবে।
● আইনুন নিশাত, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস