মতামত

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে পুলিশ ডাকল কে ?

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এবারের নির্বাচনে দ্বিতীয় দিনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়
ছবি: সাজিদ হোসেন

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ভোট গ্রহণের তারিখ ছিল গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার। কিন্তু গত দুই দিন, বিশেষভাবে বুধবার সেখানে কোনো নির্বাচনী পরিবেশ ছিল না, ছিল সংঘাতের পরিস্থিতি। পাল্টাপাল্টি মিছিল-স্লোগান, বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের হামলা-সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় বুধবার এমনটাই দেখা গেছে।বৃহস্পতিবারও দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি মিছিল-স্লোগান ও ধাক্কাধাক্কি হয়েছে। এরই মধ্যে নির্বাচনে ভোট গ্রহণও চলেছে। বলাবাহুল্য, এ নির্বাচন একটি ‘একতরফা’ নির্বাচন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ইতিহাসে এ রকম নির্বাচন ও নির্বাচনের সময় এ রকম পুলিশি তৎপরতা এর আগে আর কখনো দেখেননি বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেল হলো বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ (সাদা প্যানেল) ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেল (নীল প্যানেল)। বলে না দিলেও যে কারও বুঝতে পারার কথা-প্রথমটি আওয়ামী লীগপন্থী আর দ্বিতীয়টি বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সংগঠন। সমিতির বর্তমান কার্যকরী কমিটির সভাপতি, সম্পাদকসহ সাত সদস্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগপন্থী এবং কোষাধ্যক্ষ, সহসম্পাদকসহ অপর সাত সদস্য বিএনপিপন্থী। এবারের নির্বাচনপ্রক্রিয়ার শুরুতেই কমিটির আওয়ামী লীগপন্থী সদস্যরা একতরফাভাবে নির্বাচন উপকমিটি গঠন করেন। এরপর বিএনপিপন্থী সদস্যরাও আরেকটি উপকমিটি ঘোষণা করেন।

পাল্টাপাল্টি উপকমিটি গঠনের পর নির্বাচন নিয়ে সংশয় শুরু হয়। এ অবস্থায় সমিতির সদস্যরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসেন এবং দুই পক্ষের ঐকমত্যের ভিত্তিতে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. মনসুরুল হক চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন উপকমিটি পুনর্গঠন করা হয়। ১০ মার্চ বিএনপিপন্থী প্যানেলের সভাপতি প্রার্থী এ এম মাহবুব উদ্দিন ও সম্পাদক প্রার্থী মো. রুহুল কুদ্দুসের কাছে নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম।

দুজনই বলেছিলেন, মনসুরুল হক চৌধুরী আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও ব্যক্তিত্বের কারণে তাঁরা আশাবাদী। একই দিন আওয়ামীপন্থী প্যানেলের সম্পাদক মো. আব্দুন নূরের সঙ্গেও কথা হয়। একটি সুষ্ঠু, সুন্দর নির্বাচন হবে বলে তিনি বেশ জোর দিয়েই বলেছিলেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছিল, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি একটি ‘দৃষ্টান্তমূলক’ নির্বাচন করতে যাচ্ছে।

ভোটের এক দিন আগে সোমবার নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়ক মনসুরুল হক চৌধুরী পদত্যাগ করেন। তাঁর এ পদত্যাগের পর নির্বাচন নিয়ে ‘ঝামেলার’ আঁচ পাওয়া যায়। তাঁর পদত্যাগের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না প্রথম আলোকে বলেন, মনসুরুল হক চৌধুরী একজন দায়িত্ববান ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। গুরুতর কোনো ঘটনা না ঘটলে তাঁর পদত্যাগ করার কথা নয়। নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে এমন কিছু হয়েছে, যে কারণে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।

মনসুরুল হক চৌধুরীর পদত্যাগের পর দুই পক্ষ আবার পাল্টাপাল্টি নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়কের নাম ঘোষণা করে এবং মঙ্গলবার থেকেই সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল, হইচই ও হট্টগোল চলে। সন্ধ্যার দিকে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া এবং হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন আইনজীবী আহত হন। এরপর পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। এ রকম অবস্থায় পরের দিন কীভাবে ভোট গ্রহণ হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দেয়।

ভোটের দিন বুধবার সকালে সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায়। সকাল ১০টা থেকেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি, ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীরা ভোট গ্রহণের আগে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠনের দাবি জানাচ্ছিলেন। এরপর দুপুর ১২টার দিকে পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করে। এতে আইনজীবী, সাংবাদিকসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোর কাছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন জেড আই খান পান্না। তিনি বলেন, ‘পুলিশ যেভাবে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের মারধর করেছে, তা ন্যক্কারজনক। সামরিক শাসনের সময়েও পুলিশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে এ রকম কাজ করার সাহস পায়নি। এই দিনটি একটি কলঙ্কিত দিন, এর জন্য আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত।’

বৃহস্পতিবার সকালেও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবন এবং ভোটকেন্দ্রে বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায়। তার মধ্যেই দ্বিতীয় দিনের ভোট গ্রহণ চলছিল। আওয়ামী লীগ-সমর্থিত আইনজীবীরা তাঁদের প্রার্থীদের ব্যালট নম্বরসংবলিত ব্যাজ নিয়ে ভোটকেন্দ্রের সামনে জমায়েত হয়েছিলেন। অন্যদিকে বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে গতকালের পুলিশি হামলার কথা জানান। পুলিশের হামলার বিষয়টি নিয়ে কথা হয় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে। এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের সময় পুলিশের এমন তৎপরতা তিনি এর আগে দেখেননি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে, তিনি সেটার নিন্দা জানান।

আইনজীবী সমিতি ভবনে পুলিশের তৎপরতা নিয়ে একাধিক আইনজীবী তাঁদের অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আইনজীবী বলেন, আইনজীবীদের নির্বাচন নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, সেটা নিয়ে তাঁরা নিজেরা আলাপ-আলোচনা করতে পারতেন। কিন্তু এভাবে পুলিশ ডেকে নিয়ে আসাটা ঠিক হয়নি। এটা সুপ্রিম কোর্টের সব আইনজীবী এবং বিচার বিভাগের জন্য অমর্যাদাকর হয়েছে।

পুলিশ কে ডাকল?

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় বিপুল পরিমাণ পুলিশের উপস্থিতি নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে এসেছে। এর মধ্যে একটি হলো, ‘সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় পুলিশ ডাকল কে?’ এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের কথায়। তিনি বলেছেন,‘এবার যেহেতু আগের দিন রাতের বেলায় মাহবুব উদ্দিন খোকন ও অন্যরা ব্যালট পেপার নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দেওয়ার কারণে সমিতির বর্তমান সভাপতি ও সম্পাদক পুলিশের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বিপুলসংখ্যক পুলিশ এসেছিল, তা বলেছি।’ (প্রথম আলো অনলাইন, ১৬ মার্চ)। তাঁর এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে যে প্রশ্ন উঠে তা হলো, সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে এভাবে পুলিশ আসতে পারে কি-না? আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশের আগে পুলিশ কি সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েছে? আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সম্পাদকের কি সুপ্রিম কোর্টের ভিতরে পুলিশ ডাকার এখতিয়ার আছে? নির্বাচন নিয়ে গত দু্‌ইদিনে যা ঘটেছে তাতে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে দেখা জরুরি।

প্যানেলভিত্তিক নির্বাচনই কি দলাদলির কারণ

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির গঠনতন্ত্রে প্যানেলভিত্তিক নির্বাচনের কোনো বিধি বা নিয়ম নেই। তবু দীর্ঘদিন ধরে প্যানেলভিত্তিক নির্বাচন হয়ে আসছে। আইনজীবী সমিতির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু আইনজীবী নেতারা নন, এই দুই প্যানেলে কারা থাকবেন, সেটা নির্ধারণে সরাসরি ভূমিকা রাখেন দল দুইটির শীর্ষ নেতারা। এর ফলে আইনজীবী সমিতির নির্বাচনগুলো রাজনৈতিক নির্বাচনের মতো হয়ে গেছে এবং আইনজীবীদের একটি বড় অংশ দলীয় আনুগত্য প্রকাশে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। একটি পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনে অতি রাজনীতিকীকরণ বা দলবাজিকেই সমস্যার অন্যতম কারণ হিসেবে জানিয়েছেন একাধিক আইনজীবী।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি একটি পেশাজীবী সংগঠন। দেশে এ রকম আরও অসংখ্য পেশাজীবী সংগঠন থাকলেও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির আলাদা একটা গুরুত্ব আছে। আর এ কারণেই এই সংগঠনের নির্বাচনটি ‘দৃষ্টান্তমূলক’ হবে, এমন প্রত্যাশা ছিল অনেকের। কিন্তু দলাদলি এবং যেকোনোভাবে নির্বাচনে জেতার যে সংস্কৃতি কয়েক বছর ধরে সারা দেশে চালু হয়েছে, সেটা থেকে সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনটিকেও ছাড় দেওয়া হলো না।

আগামী বছরখানেকের কম সময়ের মধ্যে দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তার আগে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এই ‘একতরফা’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। সারা দেশে সব পর্যায়ে নির্বাচনব্যবস্থা যে ভেঙে পড়েছে এবং ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে নির্বাচন হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এ নির্বাচন সেই দৃষ্টান্তই হয়ে থাকল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ রকম পুলিশি পাহারায় একতরফা নির্বাচন তিনি এর আগে কখনো দেখেননি। আইনজীবীদের উচিত গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করা। কিন্তু ক্ষমতার জন্য আজ তাঁরা পুলিশ দিয়ে একতরফা নির্বাচন করছেন।

আগামী বছরখানেকের কম সময়ের মধ্যে দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তার আগে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এই ‘একতরফা’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। সারা দেশে সব পর্যায়ে নির্বাচনব্যবস্থা যে ভেঙে পড়েছে এবং ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে নির্বাচন হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এ নির্বাচন সেই দৃষ্টান্তই হয়ে থাকল।

  • মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক