প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। বিজ্ঞানী নিউটনের প্রখ্যাত এই সূত্র বিজ্ঞান ছাপিয়ে বাণিজ্যেও সমানভাবে প্রযোজ্য হতে চলেছে। বহুকাল আগে ইতালির হিসাববিদ লুকা ডি প্যাসিওলি অবশ্য দুই তরফা দাখিলাপদ্ধতির অবতারণা করেন বৈজ্ঞানিকভাবে হিসাব রাখার সুবিধার্থে। দুই তরফা দাখিলাপদ্ধতির মূল কথা হলো, এক পক্ষের জন্য যা আদান, অন্য পক্ষের জন্য তা প্রদান। এক পক্ষের লাভ মানে অন্য পক্ষের ক্ষতির সম্ভাবনা। নীতিশাস্ত্রে তাই লাভ–ক্ষতির প্রশমন ঘটিয়ে উভয় পক্ষের লাভ তথা উইন-উইন অবস্থানের কথা বলা হয়। বাস্তবে উভয় পক্ষের লাভের সম্ভাবনা খুব একটা দেখা যায় না। সেখানে এক পক্ষের পৌষ মাস হলে অন্য পক্ষের সর্বনাশের কথাই বেশি শোনা যায়। এই যেমন শেয়ারবাজারের কথাই ধরা যাক। সেখানে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ক্রমাগত লোকসান গুনছেন। এর অর্থই হলো, তুলনামূলক বৃহৎ এবং চতুর বিনিয়োগকারী ক্রমাগত লাভের মুখ দেখছেন। বাস্তবে এর ব্যত্যয় ঘটার সম্ভাবনাই অল্প। এর কারণ, একটি নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে একটি নির্দিষ্ট পণ্যের চাহিদা ও জোগান হেরফের না হলেও কৃত্রিম কারসাজির মাধ্যমে মূল্য স্তর অস্বাভাবিক করা সম্ভব। তথ্যপ্রবাহে অসমতা তথা ইনফরমেশন অ্যাসেমেট্রি থাকলে সে সম্ভাবনা আরও বাড়ে। সেখানে ক্রেতা ঠকার মানে বিক্রেতার লাভ। ক্রেতার অস্বাভাবিক ক্ষতির অর্থ বিক্রেতা বা কারসাজির হোতাদের অস্বাভাবিক অর্থ সমাগম।
আবহমানকাল ধরে প্রচলিত ‘কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ’—বাংলা ও বাঙালির চরিত্র ও জীবনযাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। কোনো দেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি বা দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি দেখা দিলে সেখানেও মানুষ লাভ–লোকসানের হিসাব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কেন হয়, তার পেছনে যৌক্তিক এবং অযৌক্তিক নানা কারণই আছে। দুই ধরনের মূল্যস্ফীতির কথা বহুল প্রচলিত। একটি হলো, বাজার চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ‘ডিমান্ড পুল’ মূল্যস্ফীতি আর অপরটি হলো বাজারে প্রচলিত পণ্য ও সেবার উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে ‘কষ্ট পুশ’ মূল্যস্ফীতি। বিভিন্ন কারণে বাজারে প্রচলিত দ্রব্য ও সেবার চাহিদা বেড়ে যেতে পারে। মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়লে, বিভিন্ন অনুষ্ঠান, ঈদ, পূজা পার্বণ, বছরের বিভিন্ন সময়কাল, ঋতু পরিবর্তন, ভোক্তার রুচির তারতম্য, আবহাওয়া ও জলবায়ুর ভারসাম্যহীনতা প্রভৃতি কারণে ভোক্তার চাহিদায় পরিবর্তন আসে। উদ্ভূত পরিস্থিতি ও সময়ে পণ্যের জোগান যথাযথ না হলে তার মূল্যবৃদ্ধি স্বাভাবিক।
উদাহরণস্বরূপ এ দেশে কোরবানি ঈদ উপলক্ষে গরুর চাহিদা বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই মানুষ বেশিসংখ্যক গবাদিপশু কেনে বলে জোগানে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয় এবং গরুর বাজারমূল্য বাড়তি থাকে। শীতকালে গরম কাপড়ের চাহিদা বৃদ্ধি, বর্ষায় ছাতা, গরমকালে অফিস আদালত ও বাসাবাড়িতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আয় বাড়ার কারণে জনগণের কাছে নতুন ও বর্ধিতহারে অর্থ সমাগম হলে তারা বাজারে নতুন নতুন চাহিদা সৃষ্টি করে। মানুষের পকেটে ব্যয়যোগ্য অর্থের পরিমাণ বাড়লে তারা প্রাথমিক ভোগ্যপণ্যের সঙ্গে সঙ্গে বিলাসী পণ্য ও সেবা, প্রমোদ, দেশ–বিদেশে ভ্রমণ ইত্যাদির চাহিদা সৃষ্টি করে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায় যেকোনো ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন ও ভোক্তার নিকট পৌঁছানোর খরচ যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি হারে বেড়েছে বাজারমূল্য।কোনো কোনো পণ্য ও সেবার উৎপাদনকারী আবার এককাঠি সরেস। তারা গরু মেরে জুতা দানের মতো পণ্যমূল্য ১০ টাকা বাড়িয়ে ১ টাকা ডিস্কাউন্ট দেয়। এ যেন বানরের পিচ্ছিল বাঁশ বেয়ে ওপরে ওঠার অঙ্কের মতো। বানর যেমন পাঁচ মিটার ওঠে আর দুই মিটার নামে, ঠিক এ দেশে পণ্যের মূল্য যে হারে বাড়ে, তা আর কমে না।
অন্যদিকে, ‘কষ্ট পুশ’ মূল্যস্ফীতির মূল কারণ উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি। কোনো পণ্য বা সেবার উৎপাদনের মৌলিক উপকরণ হলো মূলধন এবং শ্রম। মূলধন ও কাঁচামালের উৎপাদন ও সংগ্রহের খরচ নানাবিধ কারণে বাড়তে পারে। ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়লে ঋণ সংগ্রহের খরচ বাড়বে। ট্যাক্স, শুল্ক, খাজনা, পরিবহন ব্যয়, চাঁদা, ইজারা ইত্যাদি খরচ বাড়লে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। আবার অনেক সময় প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট নানা কারণেও পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ খরচ বাড়ে। এই যেমন বন্যা, খরা ও যুদ্ধ। বন্যা ও খরা, মহামারি, অতিবৃষ্টি প্রভূত কারণে ভূমির উৎপাদনশীলতা কমে যায়। যুদ্ধের কারণে সরবরাহ চেইন নষ্ট হয়ে যায়। এরূপ সীমাবদ্ধতার কারণে উৎপাদন পরিমাণ ঠিক রাখা সম্ভব হলেও সরবরাহ ঘাটতির কারণে দ্রব্যমূল্য বাড়ে। বন্যার সময় ফসলি জমির পরিমাণ কম থাকে অথবা কম উৎপাদন হলে প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না। বর্ষার সময় কাঁচা মরিচের দাম বৃদ্ধি সে কারণেই ঘটে।
আলোচিত ‘ডিমান্ড পুল’ অথবা ‘কষ্ট পুশ' যে ধরনের মূল্যস্ফীতির কথাই বলা হোক না কেন, তা জনজীবনে দুর্ভোগের সৃষ্টি করে। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। আয় সুনির্দিষ্ট থাকায় ভোক্তা কোনো একটা পণ্যে বেশি খরচ করতে বাধ্য হলে অন্য কোনো পণ্য বা সেবা কম ভোগ করে থাকে। সে ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবায় ব্যয় বাড়ার কারণে তাদের জীবনমান নিম্নগামী হয়। ‘ডিমান্ড পুল’ মূল্যস্ফীতির কারণে চাহিদা মেটাতে ভোক্তা প্রথমত বাজারে উচ্চমূল্য পরিশোধে ইচ্ছুক থাকলেও পরবর্তী ধাপে তা পরিশোধে হিমশিম খায়। এতে আখেরে পণ্যের মূল্যটিই বাড়ে, ভোক্তার বাড়ে নাভিশ্বাস।
‘কষ্ট পুশ’ টাইপের মূল্যস্ফীতি সে তুলনায় কিছুটা যৌক্তিক। নির্দিষ্ট পরিমাপক না থাকলেও স্বল্প হারে এ ধরনের মূল্যস্ফীতির অস্তিত্ব অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক বলেই ধরে নেওয়া হয়। অর্থনীতিতে এর পেছনে যৌক্তিকতা রয়েছে। যেমন উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে কৃষক খুশি হন এবং ন্যায্যমূল্য না পেলে অথবা বহু বছর ধরে একই মূল্য পেলে কৃষক পণ্য উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হন। শ্রমবাজারের কথাও যথার্থ। শ্রমিক প্রতিবছরেই তাঁর শ্রমমূল্য বা মজুরির কিছুটা প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা করেন। আকাঙ্ক্ষিত মজুরি ও মজুরির প্রবৃদ্ধি না ঘটলে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। দৃশ্যমান শ্রমিক অসন্তোষ শ্রমিক ধর্মঘট ও উৎপাদনে অস্থিরতা কারণ। অন্যদিকে অদৃশ্যমান শ্রমিক অসন্তোষের কারণে শ্রমিকের গতিশীলতা কম হয় এবং কম উৎপাদন করে। সে ক্ষেত্রে শিল্পকলকারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর অনেকেই তাদের অর্থনীতিতে তাই ‘কৃত্রিম কষ্ট পুশ’ মূল্যস্ফীতি বজায় রাখে। উদাহরণস্বরূপ, জাপানের সদ্য প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে জাপানের স্থবির অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে ‘ইনফ্লেশন হিট’ তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত। ‘আবেনোমিক্স’ নামে প্রসিদ্ধ এ তত্ত্বে জাপানে উৎপাদন ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, যাতে মানুষ বেশি উৎপাদনে প্রণোদিত বোধ করে।
যে ধরনের মূল্যস্ফীতির কথাই হোক না কেন, সে ক্ষেত্রে অর্থনীতির সব পক্ষই লাভবান হয় না। কথিত মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে প্রত্যাশিত (অ্যান্টিসিপেটরি) আয় বণ্টন সম্ভব না হলে সমাজের একটি পক্ষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অন্য একটি পক্ষ চরমভাবে লাভবান হয়। যেমন কৃষকের উৎপাদিত পণ্য কাঁচা মরিচের কথায় আসা যাক। সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশ উত্তরবঙ্গের একটি জেলায় এক কাপ চায়ের দামে এক কেজি কাঁচা মরিচ পাওয়া যাচ্ছে। এক কাপ চায়ের বর্তমান দাম ১০ টাকায় এক কেজি কাঁচা মরিচ কৃষকের বিক্রি পর্যায়ে মূল্য হলেও রাজধানীতে কাঁচা মরিচের কেজি ৮০ টাকা। রাজধানীর ক্রেতাসাধারণ ১ কেজি কাঁচা মরিচে ৮০ টাকা পরিশোধ করলেও প্রকৃত উৎপাদক পাচ্ছেন ১০ টাকা। এ ধরনের মূল্যস্ফীতিতে মধ্যস্বত্বভোগী তথা পাইকার, পরিবহন মালিক, শহুরে বিক্রেতা, বাজার নিয়ন্ত্রক, ইজারাদার ইত্যাদি পক্ষ লাভবান হলেও আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রান্তিক কৃষক। সাধারণ ভোক্তা এ ক্ষেত্রে বর্ধিত মূল্য পরিশোধ করলেও তাদের উপযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বাজারে এ রকম উদাহরণের কমতি নেই। হালে এমন সব জিনিসের দাম বাড়ছে যার চূড়ান্ত দায়ভার পড়ে জনসাধারণের ওপর। জনগণ সে দায়ভার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
সূত্র অনুযায়ী দ্রব্যের দাম বাড়লে চাহিদা কমে এবং দাম কমলে চাহিদা বাড়ে। কিন্তু অর্থনীতির এরূপ সরল সূত্র সব সময় কার্যকর থাকে না। যেমন বাসভাড়া বাড়লে মানুষ চাইলেই বাসে চড়া বাদ দিতে পারে না। ওষুধের দাম বাড়লে রোগী কম ওষুধ সেবন করে সুস্থতার প্রত্যাশা করে না। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি ও শিক্ষা উপকরণের খরচ বাড়লে মানুষ সন্তানাদি অশিক্ষিত করে ঘরবন্দী রাখবে, সে ধারণা অমূলক। সুতরাং মূল্যবৃদ্ধির যেকোনো অবস্থানেই বাজার সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীরা মূল্যবৃদ্ধির চাপ খুব সহজেই ভোক্তার কাঁধে চাপিয়ে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাদের লোকসানের ধার ধারতে হয় না। দুধ–চিনির দাম বাড়ায় মোড়ের চা বিক্রেতা প্রথমে পূর্ব মূল্য ১০ টাকায় চা দিলেও চায়ের পরিমাণ কমিয়ে দিত। সর্বশেষ সেই চা বিক্রেতা ১০ টাকার চা ১২ টাকায় বিক্রি করছে। অনেক মধ্যস্বত্বভোগী ও আমদানিকারক পণ্য বাজারে অস্থিরতা ও অনৈতিক কৃত্রিম সংকট তৈরি করেও দাম বাড়ায়।
তারা আগে কম দামে আমদানিকৃত পণ্য বৈদেশিক বাজারে সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে বেশি দামে বিক্রি করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। নিকট অতীতে সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির কারসাজি তার উদাহরণ। এরূপও দেখা যায়, আমদানিকৃত পণ্যে বিদেশে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে দেশীয় বাজারে দাম বাড়লেও বিদেশে যখন দাম কমে, দেশের বাজারে ব্যবসায়ী তো বটেই, সরকারি পর্যায়েও দাম কমানো বা সমন্বয়ে গড়িমসি চলে। কোনো কারণে একবার দাম বাড়লে যৌক্তিক কোনো কারণেও আর দাম সেভাবে কমে না।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায় যেকোনো ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন ও ভোক্তার নিকট পৌঁছানোর খরচ যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি হারে বেড়েছে বাজারমূল্য।কোনো কোনো পণ্য ও সেবার উৎপাদনকারী আবার এককাঠি সরেস। তারা গরু মেরে জুতা দানের মতো পণ্যমূল্য ১০ টাকা বাড়িয়ে ১ টাকা ডিস্কাউন্ট দেয়। এ যেন বানরের পিচ্ছিল বাঁশ বেয়ে ওপরে ওঠার অঙ্কের মতো। বানর যেমন পাঁচ মিটার ওঠে আর দুই মিটার নামে, ঠিক এ দেশে পণ্যের মূল্য যে হারে বাড়ে, তা আর কমে না। অন্যদিকে ভোক্তারা ছোটবেলার পাটিগণিতের অঙ্ক তথা পণ্যের মূল্য কত শতাংশ বাড়লে পণ্যের ব্যবহার ও ভোগ কত শতাংশ কমাতে হবে, সে হিসাব মেলাতে হিমশিম খায়। যেখানে মূল্যস্ফীতির কারণে বাজার সিন্ডিকেট, মধ্যস্বত্বভোগী, কালোবাজারি, পরিবহন ব্যবসায়ী, আড়তদার, তদারক প্রতিষ্ঠানের রমরমা মুনাফার পৌষ মাস সেখানে সাধারণ জনগণের অবস্থা সর্বদাই সাড়ে সর্বনাশ।
ড. শহীদুল জাহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক।