গত সপ্তাহে আমি যখন লন্ডনে যাই, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরগরম এক প্রশ্নে, ‘কেট কোথায়’। এরপর তো এল মা দিবসের সেই ঘষামাজা করা ছবি। সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে খাবার টেবিল পর্যন্ত আলোচনা ওই একই ইস্যুকে ঘিরে ঘুরপাক খেতে লাগল।
দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস ছবিটি ফটোশপ করা বলে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেয়। ছবিতে প্রিন্সেস অব ওয়েলস জ্বলজ্বল করছিলেন। ট্যাবলয়েডগুলো আর যায় কোথায়? তারা প্রশ্ন তুলল, কোনো দিন কি কেনসিংটন প্যালেস দায়িত্বশীল তথ্যসূত্র হয়ে উঠতে পারবে না?
হাহ্! কোন কালে ট্যাবলয়েড কেনসিংটনকে নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র ভাবত, তা-ই তো মনে পড়ছে না। ১৯৮৫ সালে যখন আমি ভ্যানিটি ফেয়ারের সম্পাদক তখন একটা নিবন্ধ লিখেছিলাম, প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়ানার বৈবাহিক অবস্থা খুব বাজে পর্যায়ে পৌঁছেছে। সঙ্গে সঙ্গে প্যালেস এই খবর নাকচ করে দিল। শুধু যে প্যালেসই এ কাজ করেছিল তা নয়, রাজদম্পতিও টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়ে জানালেন আমার দাবি অসত্য। তাঁদের এই দৌড়ঝাঁপ দেখেই বুঝেছিলাম, আমি যা লিখেছি ঠিকঠাক লিখেছি। পরে কিন্তু আমার লেখা সত্যিই হলো।
কিন্তু কেটকে নিয়ে গুজবের ডালপালা এবার সীমা ছাড়িয়েছে। ক্যাথেরিনকে নিয়ে গত সপ্তাহে মসলাদার, কৌতুকপূর্ণ ও নিষ্ঠুর এমন সব আলোচনা হয়েছে, যে কেউ ভাবতেও পারেননি কয়েক দিন পরই কী ঘটতে চলেছে। এর মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে শুক্রবার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আসতে যাচ্ছে। সবার ধারণা ছিল, ঘোষণাটি হয়তো কিং চার্লসকে নিয়ে। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে ক্যানসারে ভুগছেন।
কিন্তু ক্যাথেরিন যখন ভিডিও বার্তায় জানালেন তিনি নিজেও ক্যানসারে আক্রান্ত, তখন সবাই যেন বজ্রাহত হলো। রাজপরিবারের এই সদস্য কতটা সহ্য করেছেন, সেই ভাবনায় মুখও লুকালেন অনেকে।
ক্যাথেরিনের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঘোষণাটি ছিল সুলিখিত ও আবেগঘন। ক্যাথেরিনের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ ছিল, কিন্তু তাঁকে দেখে ভেঙে পড়েছেন বলে মনে হয়নি। ড্যাফোডিল ফুলের ঝাড়কে পেছনে রেখে ক্যাথেরিন সেদিন যখন কথা বললেন, আমরা একজন অসুস্থ মাকে দেখলাম। যিনি প্রাণঘাতী রোগ ও যন্ত্রণাদায়ক চিকিৎসার মধ্যে তাঁর ছোট ছোট উদ্বিগ্ন সন্তানকে এই শকুনে মিডিয়ার চোখ থেকে আড়ালে রাখতে প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন।
আমি জানতে পেরেছি, এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা তাঁর জন্য খুব কঠিন ছিল। সে কারণে তিনি ভজকট পাকিয়ে ফেলেন। আমরা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে প্রিন্স হ্যারির শত্রুসুলভ সম্পর্কের খবর জানি। যদিও প্রকাশ্যে কিছু বলেননি, তবু খুব সম্ভবত প্রিন্স উইলিয়ামের ঘৃণা আরও তীব্র। তিনি তাঁর দাদি রানি এলিজাবেথের নির্দেশনাকে শিরোধার্য করে নিয়েছেন, ‘কখনো অভিযোগ করবে না, কখনো ব্যাখ্যা দেবে না।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই বাড়বাড়ন্তের যুগে এই চিন্তা রীতিমতো জাদুকরি। তবে তথ্যের অপর্যাপ্ততায় শূন্যতা তৈরি হয় আর এই শূন্যতা গুজব ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে ফুলেফেঁপে ওঠে।
উইলিয়ামও তাঁর বয়স যখন ত্রিশের কোঠায়, তখন ডাচ অব কর্নওয়েল হিসেবে সহায়সম্পত্তি বুঝে নেননি। ছোট ভাইকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত দুই ভাইয়ের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। মেগান মার্কেল দৃশ্যপটে প্রবেশের পরই হ্যারি একটার পর একটা বোমা ফাটিয়ে গেছেন। সাসেক্সদের এই ঝগড়াবিবাদ আরও সৃষ্টিশীল উপায়ে মেটানো যেত যদি প্যালেস একটু কম সংকীর্ণমনা হতো।
প্রায় একই সময়ে চার্লসের ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার খবর উইলিয়াম ও ক্যাথেরিনকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। তাঁরা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে সন্তানদের বড় করার চেষ্টা করছিলেন। এখনই তাঁরা রাজকার্যে যুক্ত হতে চাননি। তাঁদের আরও কিছুটা সময় দরকার ছিল। কিন্তু সেই সময়টা তাঁরা পাবেন কি না, এ নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন তাঁরা।
প্রিন্স চার্লসের ডাকাবুকো বোন প্রিন্সেস অ্যান এবং আমুদে ও মোহনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকার রানি ক্যামিলা ছাড়া পরিবারের আর কারও কাছ থেকে সে অর্থে তাঁরা সহায়তা পাননি। চার্লস বরাবর রাজপরিবার ছোট থাকার পক্ষে ছিলেন, কিন্তু এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে রাজপরিবারের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টাসিটোতে হ্যারি ও মেগানের ভাঁড়ামি, হ্যারির আত্মজীবনী স্পেয়ারে একের পর এক বিধ্বংসী ঘটনার প্রকাশ, প্রিন্স অ্যান্ড্রুর বিব্রতকর কাণ্ডকারখানা—যার সম্পর্ক কেবল ঘোড়ার সঙ্গে এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে নয়, এমন এক প্রেক্ষাপটে উইলিয়াম ও ক্যাথেরিন মারাত্মক চাপেই পড়েছিলেন।
উইলিয়ামের পর রাজপরিবারের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হলেন ক্যাথেরিন। সাম্রাজ্য এমনিই সুতার ওপর ঝুলছে। অনেকেই বলে থাকেন, এই সুতাটাই হলো ক্যাথেরিন।
আমি এখন যে মন্তব্য করব, সেটি হয়তো খুব জনপ্রিয় হবে না।
রাজপরিবারের এই দুর্দশা ও দুর্বলতার জন্য রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ দায়ী। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রুথ বেইদার গিন্সবার্গ (১৯৮৩ সাল থেকে ২০২০ সাল মৃত্যু পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন) বলে বিবেচনা করবে। এত বেশি দিন তিনি দায়িত্ব পালন করেন যে তিনি যে উত্তরাধিকার রেখে গেছেন, তাঁদের চিন্তা–চেতনা তাঁর পুরোপুরি বিপরীত।
আমি মনে করি, ২০১২ সালে দায়িত্ব গ্রহণের ৬০ বছর পূর্তিতে রানি এলিজাবেথের সরে যাওয়া উচিত ছিল। ওই সময় লন্ডন তুমুল আলোচনায়, অলিম্পিক গেমসের আসর হলো। ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড সফরে গেলেন এলিজাবেথ। ক্ষতে প্রলেপ লাগানোর ওই সফর সফলও হলো। প্রিন্স চার্লস অবশেষে ক্যামিলা পার্কারকে বিয়ে করে থিতু হলেন। প্রিন্স হ্যারি আফগানিস্তানে দুবার সামরিক অভিযানে অংশ নিয়ে বীরের বেশে ফিরলেন এবং প্রিন্স উইলিয়াম ও কেট মিডলটন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন।
সে সময় সিংহাসন উত্তরাধিকারীকে হস্তান্তর করা কী যে ভালো একটা কাজ হতো। ঠিক যেমনটি এ বছরের জানুয়ারিতে করেছেন ডেনমার্কের রানি। ৫২ বছর সিংহাসনে আসীন থাকার পর দ্বিতীয় মারগ্রেদ নববর্ষের ভাষণে সিংহাসন থেকে নেমে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি অত্যন্ত রুচিসম্মত কারণ দেখান এর পেছনে। বলেন, সময় অনেক কিছু কেড়ে নেয়।
অন্যদিকে রানি এলিজাবেথ কি করলেন? মৃত্যু পর্যন্ত আরও প্রায় ১০ বছর সিংহাসনে থাকলেন। খুব সম্ভবত তিনি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তাঁর জীবনের দৈর্ঘ্য বড় হোক বা ছোট, আমৃত্যু তিনি জনগণকে সেবা দেবেন—সেই প্রতিজ্ঞায় অটল থাকলেন। তিনি দেখেছিলেন, ষষ্ঠ জর্জের বিধবা স্ত্রী কতটা বঞ্চিত জীবন কাটিয়ে গেছেন।
ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে নৈশভোজ, প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর স্বামীর আলোচনা থেকে পাওয়া গরম খবর কোনো কিছুই বেশি দিন ভোগ করতে পারেননি তিনি। জীবনভর হ্যাটের পালক আর রিবন ঠিকঠাক করে গেছেন। দ্বিতীয় এলিজাবেথ বিশ্ব রাজনীতি ও ক্ষমতা এসব ভালোবাসতেন। একইভাবে ভালোবাসতেন বালমোরালে ঘোড়ার পরিচর্যা করতে।
কিন্তু তাঁর ৭০ বছরের রাজত্ব পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠতে দেয়নি। তাঁরা একটি অস্পষ্ট কাঠামোর মধ্যে আটকা পড়েছিলেন। অথচ বহু আগেই সংস্কার প্রয়োজন ছিল। চার্লস দূরদর্শী মানুষ, মানবহিতৈষী কাজের অভিনব সব পরিকল্পনা আর সাম্রাজ্যকে আধুনিকীকরণের জন্য অনেক ভাবনা ছিল মাথায়।
কিন্তু অপেক্ষা করতে করতে সেসব ভাবনা ‘দই’ হয়ে যায়, ওগুলো কার্যকর আর হয়নি। বিপর্যস্ত মানুষটি যাঁকে ভালোবাসতেন, তাঁকে বিয়ে করার অনুমতি পেয়েছেন ৫৬ বছর বয়সে। সর্বোচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থা হলেও তাঁর হাতে সময় আছে খুবই কম। তিনি যেকোনো পরিস্থিতিতে বলেন, ‘আমার কপাল।’ কিন্তু এ কথাটি এর আগে আর কখনো এত সত্য বলে মনে হয়নি।
উইলিয়ামও তাঁর বয়স যখন ত্রিশের কোঠায়, তখন ডাচ অব কর্নওয়েল হিসেবে সহায়সম্পত্তি বুঝে নেননি। ছোট ভাইকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত দুই ভাইয়ের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। মেগান মার্কেল দৃশ্যপটে প্রবেশের পরই হ্যারি একটার পর একটা বোমা ফাটিয়ে গেছেন। সাসেক্সদের এই ঝগড়াবিবাদ আরও সৃষ্টিশীল উপায়ে মেটানো যেত যদি প্যালেস একটু কম সংকীর্ণমনা হতো।
মুকুট ঘিরে মানুষের প্রধান আকর্ষণই হলো পূজনীয় প্রতিষ্ঠান ও এই প্রতিষ্ঠানের ভেতর আটকে পড়া মানুষের মধ্যকার উদ্বেগ–উৎকণ্ঠার চর্চা। কিন্তু সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নজর অমার্জনীয়। এখন কি তাদের দেখিয়ে দেখিয়ে জীবনযাপন করতে হবে, ভালোবাসতে হবে? এই দাবি কি অন্যায় দাবি নয়?
ক্যাথেরিনের যুদ্ধটা আরও তীব্র, ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধের চেয়েও। এমন এক দায়িত্ব তাঁদের কাঁধে চাপতে বসেছে, যার জন্য তাঁরা প্রস্তুত নন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্যাথেরিনের অসুস্থতা। এই মুহূর্তে প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্সেস ক্যাথেরিনের ওপর এসে পড়বে পুরো সাম্রাজ্যের ভার।
নিবন্ধটি দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত
টিনা ব্রাউন দ্য ডায়ানা ক্রনিকলস ও দ্য প্যালেস পেপারের লেখক