জানতাম যদি শুভংকরের ফাঁকি!

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত কড়াইল বস্তি।
ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি হাতে পেলাম বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়) কর্তৃক প্রকাশিত ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন। প্রচ্ছদে একটি বিশেষণের উল্লেখ আছে—প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা। আশান্বিত হলাম এই ভেবে যে সেই ‘লাই, ড্যাম লাই অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস’-এর ঘেরাটোপ থেকে মুক্তিলাভ ঘটবে।

সরকারিভাবে এ জনশুমারি উন্মোচন করা হয় সপ্তাহ কয়েক আগে (জুলাই ২৭, ২০২২)। গুরুত্বপূর্ণ চুম্বক তথ্যগুলো প্রথম পাতায় সাজিয়ে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশ পেল। সেই সংখ্যায় তথ্যের পসরায় এক জায়গায় দৃষ্টি আটকে গেল: বস্তিবাসী জনসংখ্যা ১,৮০,০০,৪৮৬ (এক কোটি আশি লাখ চার শ ছিয়াশি), (দ্য ডেইলি স্টার, জুলাই ২৮, ২০২২)। সত্যিই!

না, বিভ্রম নয়। মোটা হরফে প্রথম পাতায় সংখ্যাটি দৃশ্যমান। ভাবলাম, তাহলে অবশেষে ডিজিটাল সত্যই প্রকাশ পেল! কিন্তু না। পরিসংখ্যান তার মিথ্যার খোলস পরিত্যাগ করেনি। প্রতিবেদনটির ১.১১ সারণিতে (পৃষ্ঠা-৪৩) উল্লেখ করা হয়েছে, জাতীয় পর্যায়ে বস্তিবাসীর সংখ্যা ১৮,০০,৪৮৬ (আঠারো লাখ চার শ ছিয়াশি) মাত্র। অর্থাৎ ডেইলি স্টার–এর উল্লেখ করা প্রতিবেদনের চেয়ে মাত্র একটি শূন্যের (‘০’) ঘাটতি হয়েছে। মুদ্রণবিভ্রাট আমার এ লেখার মুখ্য বিষয় নয়। মূল প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশে বস্তিবাসীর সংখ্যা আসলেই কত?

ঢাকা মহানগরীর (মেগা সিটি বলাই জুতসই) এখনকার জনসংখ্যা কত বলা সঠিক হবে? জনশুমারি প্রতিবেদনটির জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যানে মহানগরীর উল্লেখ নেই। তার একটা উদ্যোগহীনতার কারণ সম্ভবত এটাই যে ঢাকা মহানগরীর এলাকা নির্ধারণ নিয়ে বিস্তর বিভ্রান্তি ও অস্পষ্টতা বিদ্যমান। একেক প্রতিষ্ঠান নিজের মতো ঢাকার এলাকা কখনো গালিভার, কখনো লিলিপুট বিবেচনা করে জনসংখ্যার ঘনত্ব নির্ধারণ করেছে। তারপরও মেগা সিটির জনসংখ্যা নিদেনপক্ষে যে এক কোটি ছাপিয়ে উপচে পড়ছে, তাতে সন্দেহ নেই।

নখদর্পণে পাওয়া সহজলভ্য তথ্যমতে তা ১ কোটি ৫০ লাখের বেশি। অনির্ধারিত বা বিতর্কিত নিরূপিত সীমা নিয়ে এই মহানগরীতে বস্তিবাসী আসলেই কতজন? ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক, তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে ঢাকা মহানগরীতে ৪০ লাখ বস্তিবাসীর উল্লেখ করে একটি ব্যানার ঝুলিয়েছিলেন কারওয়ান বাজারের রেলক্রসিং–সংলগ্ন কোণটিতে। ব্যানারে অবশ্য রেফারেন্স উল্লেখ করা থাকে না। যদিও ব্যানারটির ছবি তুলে রাখা হয়নি।

এবার একটু অতীতে দৃষ্টিপাত করা সমীচীন মনে করি। ২০০৫ সালে ঢাকা মহানগরীতে বস্তির অবস্থান ও বস্তিবাসীর সংখ্যা নিরূপণে একটি জরিপ করা হয়। সেটি করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনা, ঢাকার নগর গবেষণা কেন্দ্র ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (নিপোর্ট) সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। লক্ষণীয় যে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ জরিপকাজে জড়িত ছিল। ২০০৬ সালে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে তৎকালীন ঢাকা মহানগরীতেই প্রায় ৫০০০ (পাঁচ হাজার) বস্তিতে বসবাসকারী বস্তিবাসীর সংখ্যা ছিলো ৩৪ লাখ।

সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে পাওয়া গেল বৃহত্তর ঢাকা জেলায় বিস্তৃত ৬,৯২, ৬২৮ (ছয় লাখ বিরানব্বই হাজার ছয় শ আটাশ) জন বস্তিবাসী বসবাস করছেন! তাহলে কি নগর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আবাসনক্ষেত্রে এতটাই সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছে যে ঢাকা মহানগরীতে স্বল্প আয়ের মানুষেরা খুব অল্পই এখন বস্তিতে থাকেন? যদিও ঢাকা মহানগরীর কথা সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি, তথাপি এ তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে তা পাঁচ–ছয় লাখের বেশি হবে না। ‘সারণি ২.৯–এ বসবাসের ধরন অনুযায়ী খানার সংখ্যা ও জনসংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। সারণিটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বস্তিখানা ও ভাসমান খানায় বসবাসরত জনসংখ্যা যথাক্রমে ১,৮০০,৪৮৬ জন ও ২২,১৮৫ জন (আঠারো লাখ চার শ ছিয়াশি ও বাইশ হাজার এক শ পঁচাশি)। দেখা যাচ্ছে, বস্তিতে বসবাসরত জনসংখ্যা এবং ভাসমান লোকের জনসংখ্যা ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ। যথাক্রমে ৮,৮৪,৪৯৬ (আট লাখ চুরাশি হাজার চার শ ছিয়ানব্বই) জন ও ৯,৪৭০ (নয় হাজার চার শ সত্তর) জন। (সারণি ২.৯, পৃ: ১১)।

দু–তিনটি সূত্র থেকে সংগৃহীত কিছু তথ্য–উপাত্তের পর্যালোচনা করলে দেখা যায়:
১. ঢাকায় প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। (প্রথম আলো, ১৫ নভেম্বর ২০১৬)।

এখানে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘দেশে বছরে ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ হারে মানুষ বাড়ছে, কিন্তু ঢাকা মেগা সিটিতে বাড়ছে ৩ দশমিক ৮২ শতাংশ হারে। আর মেগা সিটির আশপাশে কোথাও কোথাও এই হার প্রায় ২০ শতাংশ বেশি।’

২. ঢাকা মেগা সিটিতে প্রতিবছর অন্তত পক্ষে যুক্ত হচ্ছে ৬,০০,০০০ (ছয় লাখ) মানুষের ঢল। (দেখুন, ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান, পরিচ্ছেদ ৬.৩, পৃষ্ঠা-১১২, প্রকাশনা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ২০১৫)

এ কথা তো সর্বজনবিদিত, ছিন্নমূল মানুষেরা শহরমুখী হয় প্রধানত কাজের তাগিদে। এরা মুটে-মজুর-কুলি বা রিকশা–ভ্যান চালনা, বাসাবাড়িতে খণ্ডকালীন কাজ করা প্রভৃতি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। এতে করে বেঁচে থাকার জন্য অন্ন, বস্ত্রের মৌলিক প্রয়োজনের আংশিক নিরাপত্তা খুঁজে পান তাঁরা। অরক্ষিত ও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় আরও অনেক মৌলিক চাহিদা। সবার আগে, বাসস্থান। একটা ‘মাথা গোঁজার ঠাঁই’। তাঁরা কেন নিজের বাস্তুভিটা ছেড়ে, ভয়াবহ অনিশ্চয়তার ওপর ভর করে যান্ত্রিক এই শহরের অন্ধকার গলি-ঘুপচিতে প্রবেশ করেন, তা–ও আমাদের অজ্ঞাত নয়।

এখন প্রশ্ন হলো, এই যে প্রতিদিন ১ হাজার ৭০০ জন, যাঁরা ঢাকা মহানগরীতে আসছেন অথবা প্রতিবছর যুক্ত হওয়া ওই ৬ লাখ মানুষ যাঁরা ঢাকায় জীবনযাপনের তাগিদে ছুটে আসছেন, তাঁরা আশ্রয় নিচ্ছেন কোথায়? নিশ্চয়ই বস্তিতে। তাহলে নিঃসন্দেহে বস্তির সংখ্যা বেড়েছে। শুধু তা–ই নয়, প্রতিবছরই যুক্ত হচ্ছে নতুন বস্তিঘর ও বস্তিবাসী।

অথচ ২০১৪ সালে প্রণীত হয়েছিল যে বস্তিশুমারি, সেখানে দেখানো হয়, সারা দেশে সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলাসহ বিস্তৃত এলাকায় বস্তিবাসীর সংখ্যা ২২ লাখ ৭৭ হাজার ৭৫৪ এর মধ্যে ঢাকা বিভাগ এলাকায় বসবাসকারী বস্তিবাসীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ লাখ ৬১ হাজার ৬৯৯। (বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোকগণনা, ২০১৪)

এখানেই বিভ্রান্তির সূত্রপাত। ৯ বছর আগে ঢাকা মেগা সিটিতে যে ৩৪ লাখ মানুষ থাকতেন বস্তির জীবনে। তাঁরা কমে গিয়ে ২০১৪ সালে হলেন মাত্র ১০ লাখ ৬১ হাজার, তা–ও আবার ঢাকা বিভাগজুড়ে বিস্তৃত হয়ে। হ্রাস পাওয়ার এই ধারা বজায় থাকলে আরও কয়েক বছর পর হয়তো দেখা যাবে মেগা সিটি ঢাকাতে আর বস্তি বলতে কিছু নেই।

সুদৃশ্য এই মহানগরীর উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত মাত্র পাঁচ-ছয়টি রাজপথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে গগনচুম্বী অট্টালিকার সারি। সেই অট্টালিকার অবয়ব, চকমকে শার্সিতে আকাশপারের মেঘের ছায়া খেলা করে ফেরে। যানজটে আটকে থাকা দীর্ঘ যানবাহনের সারিতে ধৈর্যচ্যুত ঘর্মাক্ত সাধারণ মানুষের আবদ্ধ দৃষ্টি সেই ছিন্নমূল মানুষগুলোর বসতি বা বস্তিগুলো খুঁজে পাবে কী করে। তাই কি বস্তিগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়? হয়ে যায় লাপাত্তা?

নয়তো এযাবৎ প্রকাশিত আগের তথ্য–উপাত্তগুলো সত্যের অপলাপ মাত্র। সঠিক তথ্য–পরিসংখ্যানের মাধ্যমে একটি সমস্যার স্বরূপ উদ্‌ঘাটিত হয়। যদি সেখানে বিভ্রান্তি থাকে, তাহলে নীতি নির্ধারণে ভুল সিদ্ধান্ত প্রণীত হতে বাধ্য। অন্য কথায়, ডায়াগনসিস ভুল হলে প্রেসক্রিপশন নির্ভুল হবে, এমন আশা করা আহাম্মকি।

মনে রাখতে হবে, পরিসংখ্যান, তথ্য–উপাত্ত নিয়ে ভুলভ্রান্তির সূত্রপাত হতে পারে। তবে তা যদি আকাশ–পাতাল পর্যায়ে উপনীত হয়, তাহলে সৃষ্টি হয় সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব।
আজ উদ্‌যাপিত হচ্ছে ‘বিশ্ব বসতি দিবস’। সবার জন্য বাসস্থান সদৃশ স্লোগানে সেমিনার সিম্পোজিয়াম, রাজনৈতিক সমাবেশস্থল হয়তো আবার মুখর হবে। বস্তিবাসীর জন্য বাসস্থান জোগান দেওয়া সহজতর হবে। কারণ, সংখ্যায় এখন যে তাঁরা অনেক কম!

  • ড. মো. শহীদুল আমিন সাবেক অধ্যাপক, স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: ameen@arch.buet.ac.bd