দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত কাছে আসছে, রাজনৈতিক অচলাবস্থা তত বাড়ছে। এর মধ্যেই ‘ভোট দিতে চাই’—তরুণদের এই দাবি জোরালো হচ্ছে। এই দাবিতে ঢাকায় ছাত্র ও তরুণদের সংগঠনগুলো নিয়মিত কর্মসূচি পালনও করছে। কখনো সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে, কখনো মিছিলে গলা মিলিয়ে, আবার কখনো প্ল্যাকার্ড তুলে ‘ভোট দিতে চাই’ দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। গত মাসের প্রথম দিকে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ভোট দিতে চাই’ ব্যানারে শাহবাগে সমাবেশ ও মিছিল করে। এরপর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ১৯টি ছাত্রসংগঠনের ফ্যাসিবাদবিরোধী যে জোট আত্মপ্রকাশ করেছে, সেখানেও তরুণদের ভোটাধিকারের বিষয়টি অন্যতম দাবি হিসেবে উঠে এসেছে।
দেশে এখন তরুণ ভোটারের সংখ্যা আড়াই কোটির বেশি। তাঁদের বেশির ভাগেরই জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়নি। অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একেবারে গোড়ার আলাপ হলো, নির্দিষ্ট সময় পরপর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোটাররা তাঁদের পছন্দের দল বা প্রার্থীকে বেছে নেওয়ার অধিকার পাবেন। প্রথম ভোট ঘিরে তরুণদের আবেগ যেমন থাকে তুঙ্গে, আবার ভোটের ফলাফল নির্ধারণে তাঁদের ভূমিকাও থাকে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তরুণ ভোটারদের মন জয় করে নেওয়ার নানা উপায় খুঁজতে হয় রাজনৈতিক দলগুলোকে।
বাংলাদেশে কে কোন দলের সমর্থক হবে, সেটা অনেকটা নির্ধারিত হয় পারিবারিক সূত্রে। কিন্তু তরুণদের বড় একটা অংশ আবার পারিবারিক ঐতিহ্য ভেঙে ভিন্ন দল কিংবা নতুন রাজনীতি বেছে নিতে পিছপা হন না। তাঁরা অনেকটাই স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক মত বেছে নেন। সে কারণেই আমরা দেখি, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয় বছরের মাথায় মুসলিম লীগ পরিবারের সন্তানেরা সেই দলের রাজনীতিকে নাকচ করে দিয়ে আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন।
তরুণদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাতাবরণ নিশ্চিত করেই একটা জোরালো ভূমিকা পালন করে। সে কারণেই কখনো বামপন্থী জোয়ারে, আবার কখনো জাতীয়তাবাদী জোয়ারে, কখনো ধর্মীয় ও জাতিগত আত্মপরিচয়ের রাজনীতিতে গত কয়েক প্রজন্মের তরুণেরা প্রভাবিত হয়েছেন। কিন্তু তরুণদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আন্টি–ইনক্যাম্বেন্সি বা বিদ্যমান শাসনের প্রতি অনাস্থাটা প্রবলভাবে কাজ করে। সে কারণেই সুষ্ঠু ও অবাধ পরিবেশে নির্বাচন হলে তরুণদের ভোট জয়-পরাজয় নির্ধারণে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে।
ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ভিত্তি গড়ে তুলেছেন ছাত্র-তরুণেরাই। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরপরই কলকাতা থেকে আসা ছাত্র নেতৃত্ব ও ঢাকার ছাত্র নেতৃত্ব মিলে গড়ে তোলেন গণতান্ত্রিক যুবলীগ। বলা চলে, এ ভূমির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গোড়াপত্তন। এরপর ১৯৫২ থেকে শুরু করে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সব কটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে পথ দেখিয়েছেন তরুণেরা। এমনকি ২০০৮ সালের আগস্টে জরুরি অবস্থা অবসানের আন্দোলনে (এতে রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছিল) নেতৃত্ব দেন ছাত্র-তরুণেরা। অথচ দেড় দশকের মধ্যে রাজনীতিতে তরুণেরা এতটাই প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন যে ‘ভোট দিতে চাই’ দাবি জানিয়ে তাঁদের আন্দোলন করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশে জনমিতির হিস্যায় তরুণেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু ইতিহাসে তরুণেরা সবচেয়ে বেশি অসংগঠিত, স্বপ্নহীন ও রাজনৈতিকভাবে অক্রিয়। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল কিংবা অন্যান্য ছাত্রসংগঠনে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী যুক্ত থাকলেও প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণেরা রাজনীতিতে আগ্রহী নন। বাংলাদেশে তরুণদের নিয়ে খুব একটা জরিপ হয় না। ‘২০১৯ সালে তরুণেরা কী ভাবছেন’—এই শিরোনামে প্রথম আলো যে জরিপ করেছিল, তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৫৭ শতাংশ তরুণ রাজনীতির প্রতি অনাগ্রহী।
রাজনীতি জাগতিক সমস্যার সমাধান করে। কিন্তু সেই রাজনীতিই যখন একটা স্বজনতোষী গোষ্ঠী তৈরি করে এবং দলের ভেতরেও গণতন্ত্রচর্চার বদলে অভিজাত একটি গোষ্ঠী সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে, তখন নিশ্চিতভাবেই তরুণদের রাজনীতিতে আগ্রহী হওয়ার কিছু থাকে না। আর ছাত্ররাজনীতির হালহকিকতও তা–ই। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, সেই দল তাদের ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে। ‘সবাই নেতা হতে চাওয়ার’ প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত দু-একজনের ভাগ্যের শিকেই ছেঁড়ে।
বাদবাকি অনুসারী বা সহমত ভাইবোনদের জীবন হয় বরবাদ। না তাঁরা পড়াশোনা করে চাকরিবাকরি পান, না রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন। ফলে এর কাছ থেকে ওর কাছ থেকে চাঁদাবাজি, একে–ওকে পেটানো, বছরের পর বছর ধরে আদু ভাই হয়ে হলে থেকে ফাউ খাওয়া, বড় ভাইদের পক্ষ হয়ে মাস্তানি করতে গিয়ে মার খেয়ে দাঁত হারানোর মতো ঘটনায় তাঁরা জড়িয়ে পড়েন। এর চেয়ে বড় মানবিক অপচয় কি আর হতে পারে?
‘ভোট দিতে চাই’—রাস্তায় নেমে তরুণদের এই দাবি তুলতে হচ্ছে। অথচ আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের গৌরবজনক ইতিহাস অনেকের চেয়ে সমৃদ্ধ। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের বয়সও ৫২ বছর পেরিয়েছে। এতগুলো বছরেও ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো একটা নির্বাচনী ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। অথচ রাজতন্ত্র থেকে সবে গণতন্ত্রে পা দেওয়া নেপাল এবং কয়েক লাখ মানুষের দ্বীপদেশ মালদ্বীপও একটা গ্রহণযোগ্য ও স্বস্তিদায়ক নির্বাচনী সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে।
সদ্য শেষ হওয়া মালদ্বীপের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ পরাজিত হন মালের মেয়র মোহামেদ মুইজ্জুর কাছে। সলিহ পরাজয় স্বীকার করে মুইজ্জুকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানান। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের এটাই তো স্বাভাবিক চর্চা। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো দিল্লি বা ওয়াশিংটনের দিকে মুখ চেয়ে না থেকে কিংবা আমলাতন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল না হয়ে কবে গণতন্ত্রের চর্চা করতে শিখবে? তরুণদের যদি প্রান্তিক করেই দেওয়া হয়, তাহলে রাজনীতিবিদেরা কাদের জন্য রাজনীতি করেন?
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী