গত মাসে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান যখন ২০ হাজার ফিলিস্তিনি হত্যার জন্য ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করলেন, তখন ইসরায়েলজুড়ে একটা হইচই পড়ে গেল।
নেতানিয়াহুর উদ্দেশে এরদোয়ান বলেন, ‘হিটলারের সঙ্গে আপনার পার্থক্য কী?...হিটলার যা করেছেন, আপনি কি কোনো অংশে তার কম কিছু করেছেন?’
এরপর নেতানিয়াহু পাল্টা এরদোয়ানের দিকে অভিযোগের তির ছুড়ে দেন। কুর্দিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালনার জন্য এরদোয়ানকে দায়ী করেন। আর ওয়াশিংটনে অনেকে এরদোয়ানকে সেমেটিকবিরোধী বলতে থাকেন। কিন্তু কূটাভাস এই যে এরদোয়ানের সঙ্গে সহমত পোষণ করা অনেক আন্দোলনকর্মী মনে করেন এরদোয়ান নেতানিয়াহুর দিকে কড়া বাক্যবাণ ছুড়ে দিয়েছেন, সেটা তাঁর ভণ্ডামো ছাড়া কিছু নয়।
এই আন্দোলনকর্মীরা বলছেন, এরদোয়ান একদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন আর অন্যদিকে বাক্যবাণ বর্ষণ করছেন। অনেকে এটাও বলছেন যে আজারবাইজানের তেলবাহী কার্গো ইসরায়েলি বন্দরে প্রবেশে এখনো সহায়তা করে চলেছে তুরস্ক। এরপর এরদোয়ানের বক্তব্যের কী যুক্তি থাকতে পারে?
ইসরায়েল প্রশ্নে তুরস্ক চরম অবস্থান নেবে, এই প্রত্যাশাটা সবার মাঝে তৈরি হয়েছে। অনেকে বলতে পারেন, এরদোয়ান তাঁর অগ্নিবর্ষী বক্তব্যের মাধ্যমে এই প্রত্যাশাটা জাগিয়ে তুলেছেন। কিন্তু এটা অযৌক্তিক বিশ্লেষণ।
১৪ জানুয়ারি ছিল গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের ১০০ দিন। এদিনে আঙ্কারা ইসরায়েলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আগে থেকে নির্ধারিত আঙ্কারা সফর বাতিল করেন। তেল আবিবে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে দেশে ডেকে আনেন। পাইপলাইনের মাধ্যমে ইসরায়েলে গ্যাস সরবরাহের যে আলোচনাটি থেমে আছে, সেটা কীভাবে চালু করা যাবে, তা নিয়ে সলাপরামর্শ করা হয়।
এর আগের কলামে আমি লিখেছিলাম, এই সংঘাতে তুরস্ক ভারসাম্যমূলক অবস্থান নেবে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। নেতানিয়াহু কোনো চুক্তিতে আসতে চান, গাজাকে তিনি ধুলায় মিশিয়ে দিতে চান—এ ধারণা যত স্পষ্ট হয়েছে, এরদোয়ানের বাক্যবাণ ততই কড়া হয়েছে।
ন্যাটো জোটের মিত্রদের থেকে পুরোপুরি ভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন এরদোয়ান। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর নিন্দা জানানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন তিনি। গাজায় বেসামরিক জনগণকে নৃশংস হত্যাকাণ্ড, যেটিকে বিশেষজ্ঞরা গণহত্যা বলছেন, তাতে নির্লজ্জের মতো নিশ্চুপ পশ্চিমা বিশ্ব। এ অবস্থায় এরদোয়ানের সমালোচনার ওজনটা বেশ ভারী।
এই যুদ্ধে তুরস্কের কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিছক কথার যুদ্ধ হয়ে থাকছে না। ইসরায়েল নিয়ে আঙ্কারার হিসাব-নিকাশ পরস্পর সম্পর্কিত দুটি মূল ইস্যুর সঙ্গে যুক্ত। তা হলো দুই রাষ্ট্র সমাধান এবং ক্ষমতা থেকে নেতানিয়াহুর সরে যাওয়া।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান যুদ্ধের একেবারে শুরু থেকেই দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো ও আরব দেশগুলো রক্ষাকবচের ভূমিকায় থাকবে, এমন একটি চুক্তির প্রস্তাব তিনি দিয়ে চলেছেন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদেশগুলো ও পশ্চিমা দেশগুলোতে তিনি সফর করে চলেছেন, যাতে করে ইসরায়েল-হামাসের মধ্যে একটা অস্ত্রবিরতি করা যায়।
এসব প্রচেষ্টা ফলবতী হতেও দেখা গেছে। গত ২৬ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে জর্ডানের উত্থাপিত একটি অস্ত্রবিরতি প্রস্তাবে ১২০টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। ১৪টি দেশ বিপক্ষে ভোট দেয়। ৪৫টি দেশ ভোট দিতে বিরত থাকে। কিন্তু এরদোয়ান, ফিদান ও আরব দেশগুলোর নিবিড় কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে থাকা দেশের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ডিসেম্বরে আরেকটি ভোটাভুটিতে ১৫৩টি দেশ অস্ত্রবিরতির পক্ষে ভোট দেয়। বিপক্ষে ভোট দেয় ১০টি দেশ। আর ভোটদানে বিরত থাকে ২৩টি দেশ।
এটা অবশ্যই একটা বড় অর্জনই। কিন্তু একটা বিষয় হচ্ছে, গাজায় যে ধরনের মানবিক বিপর্যয় ঘটে চলেছে, তাতে করে এই অর্জনের স্বীকৃতি দেওয়া যায় না।
ফিলিস্তিনিদের দুটি প্রধান উপদল হামাস ও ফাতাহকে এক করার চেষ্টাও করে যাচ্ছে তুরস্ক। এরদোয়ান বলেছেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র নিয়ে ঘটনাচক্রেই যে বিতর্ক আসবে, তার প্রস্তুতি হিসেবে হামাস ও ফাতাহকে তিনি একত্রে বসানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ফাতাহ এরই মধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা এ ধরনের আলোচনায় বসতে রাজি।
এরদোয়ানসহ তুরস্কের কর্তাব্যক্তিরা বারবার করে বলে আসছেন, গাজা যুদ্ধের মূল দায়টা নেতানিয়াহুকে নিতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হতে চলেছে। এ কারণেই এরদোয়ান এখন ইসরায়েলি সমাজকে দায়ী না করে সরাসরি নেতানিয়াহুকে টার্গেট করছেন। এরদোয়ান তাঁর বক্তব্যে প্রায়ই বলছেন, ইসরায়েলের জনগণ নেতানিয়াহুর শাসনের বিরোধী।
একই সঙ্গে তুরস্কের নেতারা এখন আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার করা গণহত্যা মামলায় সমর্থন দিয়ে চলেছেন। সম্প্রতি তুরস্কে অবস্থানরত ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহকালে ২৪ জনের বেশি সন্দেহভাজন গুপ্তচরকে আটক করেছে।
বাণিজ্যের প্রশ্নে ইসরায়েলের সঙ্গে পুরোপুরি সম্পর্ক ছেদে বিশ্বাসী নয় আঙ্কারা। এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে তা ফিলিস্তিনিদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এমনকি ২০১০ সালে ইসরায়েলি সেনারা মাভি মারমারা গণহত্যা করার পরও আঙ্কারা তেল আবিবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুরোপুরি ছেদ করেনি।
যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে তুরস্ক-ইসরায়েলের বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে অপতথ্য ছড়াচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের ৩৫ শতাংশ বাণিজ্য বেড়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা মৌসুমি বৃদ্ধি, প্রকৃত বৃদ্ধি নয়। কেননা, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের তথ্য তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে এ সময়ে ইসরায়েলে তুরস্কের রপ্তানি কমেছে ৩০ শতাংশ।
ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য না করার জন্য অনেকে আহ্বান জানাচ্ছেন। কিন্তু আঙ্কারা সেই আহ্বানে সাড়া দেবে বলে মনে হয় না।
তুরস্কের সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে আমার কাছে মনে হয়েছে, আঙ্কারা দুই রাষ্ট্র সমাধানকে সামনে রেখে শান্তি স্থাপকের ভূমিকায় থাকতে চায়। শান্তি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর, বৈধ ফিলিস্তিন সরকারের অধীনে গাজা পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখতে চায়।
ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলে তুরস্কের সেই অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন হবে না।
রাগিপ সয়লু তুরস্কের সাংবাদিক
মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত