ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে ঢোকার জন্য ভোর থেকে বিসিএস পরীক্ষার্থীরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। গ্রন্থাগার খোলে সকাল আটটায়; কিন্তু গভীর রাত থেকে লাইনে ব্যাগ রাখার প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া নতুন শিক্ষার্থীরা প্রথম প্রথম এই দৃশ্য দেখে হকচকিয়ে যান। তবে কিছুদিন বাদে তাঁরাও বুঝতে পারেন, আবাসিক হলগুলোয় পড়াশোনার পরিবেশ নেই। হলের রিডিংরুমগুলোয় বসে পড়াশোনা করতেও কষ্ট হয় অতিরিক্ত গরমের কারণে। এর ফলে বিসিএস ও অন্যান্য চাকরির পড়াশোনার জন্য গ্রন্থাগারে আসন দখলের প্রতিযোগিতা চলে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার কী করে চাকরির প্রস্তুতির কেন্দ্র হতে পারে?
বর্তমানে সরকারি চাকরিতে অনুমোদিত পদ আছে ১৯ লাখের ওপরে। এর মধ্যে কর্মরত আছেন প্রায় ১৪ লাখ। অর্থাৎ, প্রায় পাঁচ লাখ পদ এখন শূন্য। বিসিএস ও অন্যান্য চাকরির পরীক্ষা অনিয়মিত হয়ে পড়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এসব পরীক্ষা তুমুল প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চাকরির পড়াশোনাকে বেশি গুরুত্ব দেন। তাঁদের ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট চাকরির নিশ্চয়তা দেয় না। এর ফলে স্নাতক পাস করার আগেই একাডেমিক পড়াশোনা ছেড়ে বিসিএস প্রস্তুতির দিকে ঝুঁকে পড়ছেন অধিকাংশ শিক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এটি যে একটি সংকট, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা আমলে নিচ্ছে না। বরং এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, যেগুলো সমস্যা আরও বাড়াতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাপরিকল্পনায় আছে—কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার হবে ২০ তলাবিশিষ্ট। এই গ্রন্থাগারের দ্বিতীয় তলায় বিসিএস ও অন্যান্য চাকরিপ্রার্থীদের বসার ব্যবস্থা রাখা হবে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আরেকটি উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিটি বিভাগের সেমিনার, লাইব্রেরিগুলো শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও খোলা রাখা হচ্ছে। এ দুদিন শিক্ষার্থীরা কেবল তাঁদের সঙ্গে নিয়ে আসা বই পড়তে পারবেন, সেমিনারের বই নিতে পারবেন না। ধারণা করা যায়, শিক্ষার্থীরা এ দুদিনও সেমিনারে বসে বিসিএসের প্রস্তুতি নেবেন। এসব দেখে মনে হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাকরির প্রস্তুতি নেওয়ার উপযোগী একটি পরিবেশ নিশ্চিত করতে চাচ্ছে!
শিক্ষকেরা প্রায়ই লক্ষ করেন, তাঁদের লেকচার দেওয়ার সময় কিছু শিক্ষার্থী ক্লাসে বসে চাকরির গাইড বই পড়েন। গ্রন্থাগারকেও শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করছেন বিসিএস পরীক্ষার নোট-গাইড পড়ার কাজে। হেন কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়, চাকরি নিশ্চিত করার জন্য নোট-গাইড মুখস্থ করা তরুণদের প্রধান কাজ।
গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা কী কিংবা একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার কীভাবে উচ্চশিক্ষার জন্য সহায়ক হতে পারে, এ যুগের শিক্ষার্থীরা তা ঠিকমতো জানেন বলে মনে হয় না। কারণ, গবেষণা ও শিক্ষার কাজে তাঁদের গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে প্রায় দেখাই যায় না। প্রতিটি ব্যাচে যেসব শিক্ষার্থী একটু পড়াশোনা করেন, তাঁরা পুরোনো প্রশ্ন আর নোটনির্ভর হয়ে পড়ছেন। এর মানে শিক্ষকেরা গতানুগতিক ধারায় প্রশ্ন করছেন এবং সেই প্রশ্ন দিয়ে শিক্ষার্থীদের মেধার যথাযথ স্ফুরণ ঘটানো সম্ভব হচ্ছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষার অনুপযোগী পরিবেশ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরিবেশ নেই, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে এ অভিযোগ করে আসছেন। নতুন ভর্তির সময়ে কেবল আসনসংখ্যা কমিয়ে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। আবাসিক হলগুলোয় ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতাদের খবরদারি আগে থামাতে হবে।
শিক্ষকেরা প্রায়ই লক্ষ করেন, তাঁদের লেকচার দেওয়ার সময় কিছু শিক্ষার্থী ক্লাসে বসে চাকরির গাইড বই পড়েন। গ্রন্থাগারকেও শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করছেন বিসিএস পরীক্ষার নোট-গাইড পড়ার কাজে। হেন কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়, চাকরি নিশ্চিত করার জন্য নোট-গাইড মুখস্থ করা তরুণদের প্রধান কাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১০ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে ৬০ শতাংশের বেশি পাঠক কমেছে। আবার আগে যেখানে প্রতিদিন গড়ে আড়াই হাজার বই নেওয়া হতো, এখন সেখানে এক হাজার বইও নেওয়া হয় না। গ্রন্থাগারকে যদি বিসিএস প্রস্তুতির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়, তবে গ্রন্থাগার তার প্রকৃত প্রয়োজন হারিয়ে ফেলবে।
দুই–তিন দশক আগেও বিভিন্ন এলাকায় তরুণদের উদ্যোগে পাঠাগার তৈরি করতে দেখা যেত। সেখানে বসে বিভিন্ন বয়সী পাঠকেরা বই ও পত্রিকা পড়তেন। বই পড়া অনেকের কাছেই ছিল নেশার মতো এবং স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই এই নেশা তৈরি হয়ে যেত। শিক্ষার্থীরা সুযোগ পেলেই স্কুলের পাঠ্যবইয়ের বাইরে গল্প-উপন্যাসসহ নানা ধরনের বই হাতে তুলে নিত। এখন স্কুল, কোচিং আর প্রাইভেট টিউটরের চাপে বাড়তি বই পড়ার সময় তাদের হাতে আর থাকে না। এখনকার পড়াশোনা হয়ে পড়েছে সম্পূর্ণভাবে ফলাফলমুখী। শিক্ষার লক্ষ্য জিপিএ ফাইভের মধ্যে বন্দী হয়ে পড়ায় শিক্ষার মহৎ ও আদর্শগত দিক শিক্ষার্থীদের উপলব্ধির বাইরে থেকে যাচ্ছে।
সারা দেশে সরকারের গ্রন্থাগারের সংখ্যাও অপ্রতুল। সরকারি গ্রন্থাগার আছে ৭২টি। এর বাইরে সরকারিভাবে নিবন্ধিত বেসরকারি ও ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার আছে দেড় হাজারের মতো। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো সম্ভব হলে গ্রন্থাগারকে একটি আন্দোলনে রূপ দেওয়া যেত। পাঠাভ্যাস বাড়াতে হলে পাড়ায়-পাড়ায় মহল্লায়-মহল্লায় গ্রন্থাগার তৈরির বিকল্প নেই। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ের বড় বড় গ্রন্থাগারের বইগুলোকে সম্ভাব্য ক্ষেত্রে স্ক্যান করে ই-বুক করতে হবে এবং এসব বই অনলাইনে সহজলভ্য করতে হবে। এসব গ্রন্থাগারের বইয়ের তালিকাও অনলাইনে দেখার সুযোগ করে দিতে হবে, যাতে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে বইয়ের খোঁজ করা যায়।
চাকরির পরীক্ষাকে সামনে রেখে বিভিন্ন কোচিং সেন্টার রিডিংরুম তৈরি করেছে। ভাবতে অবাক লাগে, এই একই ধরনের লক্ষ্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও গ্রন্থাগার ও সেমিনার–লাইব্রেরিগুলোকে বিসিএস প্রস্তুতির উপযোগী করে তুলছে। এই সংকটের গোড়ায় আছে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নের ধারা। মুখস্থনির্ভর প্রশ্নপদ্ধতি শিক্ষার্থীদের গাইড ও কোচিং–মুখী করেছে এবং একই সঙ্গে একাডেমিক পড়াশোনার আগ্রহ কমিয়েছে। গ্রন্থাগারে বসে তথ্য মুখস্থ করার জন্য তাঁদেরকে এখন গভীর রাতে ব্যাগ রেখে সিরিয়াল দিতে হয়! অন্যদিকে নিচতলার এমফিল-পিএইচডি সেকশনে শিক্ষার্থী ও গবেষকদের দেখা পাওয়া যায় না। ওপরতলার বইগুলোতেও জমে থাকে ধুলার স্তর।
কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে চাকরিপ্রার্থীদের ভিড় অন্তত তিনটি দিক নির্দেশ করে—১. বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ নেই, ২. চাকরি পাওয়াই তরুণদের প্রধান লক্ষ্য এবং ৩. নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন হয় মুখস্থনির্ভর। এগুলোকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে গ্রন্থাগারগুলো পুরোপুরি চাকরিপ্রার্থীদের দখলে চলে যাবে।
সংকট উত্তরণের জন্য সবার আগে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নের ধরন পাল্টানো দরকার। প্রশ্ন এমন হবে, যাতে প্রার্থীর মুখস্থবিদ্যা নয়, বরং অনুধাবন, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা যাচাই করা যায়। তা ছাড়া শিক্ষকদের একমুখী লেকচার দেওয়ার পদ্ধতি থেকে সরে আসতে হবে। শ্রেণি কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে অ্যাসাইনমেন্ট, শ্রেণি-উপস্থাপনা, দলগত কাজ, একক কাজ, গবেষণা ইত্যাদি কাজের মধ্যে মোট নম্বর ভাগ করে দিতে হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে আসন অনুপাতে মেধার ভিত্তিতে নতুন শিক্ষার্থীদের জায়গা দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশকে শিক্ষা ও গবেষণার উপযোগী করে তুলতে হবে।
তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক