গত এক–দেড় সপ্তাহ ধরে শিশু-কিশোর নিখোঁজের খবরাখবর ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। দেখা যাচ্ছে, ‘২৪ ঘণ্টায় ১০ শিশু নিখোঁজ’, ‘৪৮ ঘণ্টায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৩৫ শিশু নিখোঁজ’-পোস্টগুলো আসছে এভাবে। সেসব পোস্টে আছে অনেকগুলো নিখোঁজ সংবাদের ছবিসহ স্ক্রিনশট।
বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপসহ পরিচিত-অপরিচিত সবাই এমন অনেক পোস্ট শেয়ার দিচ্ছেন এবং আলাদাভাবে কোনো শিশুর নিখোঁজ সংবাদও শেয়ার হচ্ছে ব্যাপক হারে।
পুলিশ সদর দপ্তরের দেওয়া একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘শিশু নিখোঁজ’-সংক্রান্ত পোস্ট পুলিশের নজরে এসেছে। এ ধরনের পোস্ট নিছক গুজব। এমন গুজবে বিভ্রান্ত বা আতঙ্কিত না হতে সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হয় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে।
পুলিশের এমন বক্তব্যের আতঙ্ক থেকেই যায় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা প্রকাশ পায়। অনেকে সন্দেহ করছেন, এসব ছেলেধরার কাণ্ড।
ফেসবুকের পোস্টগুলোতে দেওয়া নিখোঁজ শিশুদের অভিভাবকদের ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হয়। গত সোমবার ৭ জনকে ফোন দিয়ে ১৩ জনের নিখোঁজের বিষয়ে জানা গেল। তাদের সবাইকেই এক দিন থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে ফেরত পাওয়া গেছে। তার মানে শিশু-কিশোর নিখোঁজের বিষয়টি গুজব বা ভুয়া নয়।
দেখা যাচ্ছে, সব ঘটনাই গত ১০ দিনের। নিখোঁজ হওয়া সবাই শিশু-কিশোর, যাদের বয়স ৯ থেকে ১৬ বছর। নিখোঁজ শিশুদের মধ্যে দুজন স্কুলশিক্ষার্থী মেয়ে।
অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী নিজ জেলা শহর থেকে বাসে করে ঢাকায় চলে এসেছিল। বাসচালকের সন্দেহ হলে তাকে থানায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে পরিবার তাকে উদ্ধার করে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায় নয় বছরের এক মেয়ে ভিখারিকে চাল দেওয়ার সময় তার পিছে পিছে চলে যায়। পরে একটি ট্রেনে উঠে পড়লে যাত্রীরা তাকে উদ্ধার করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
স্কুলপড়ুয়া দুই মেয়ে ছাড়া নিখোঁজ হওয়া বাকি ১১ জন সবাই ছেলে এবং মাদ্রাসাশিক্ষার্থী। তার মধ্যে চারজন হেফজ মাদ্রাসার (যেখানে কোরআন মুখস্থ করা হয়) বলে নিশ্চিত করা গেছে। আটজন শিক্ষার্থী পড়াশোনার চাপ বা পড়া না শেখায় শাস্তির ভয়ে মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে যায় বলে তাদের অভিভাবকেরা জানিয়েছেন।
বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার একটি ঘটনার ক্ষেত্রে জানা গেছে, মাদ্রাসা থেকে শিক্ষার্থী হারিয়ে গেলে অভিভাবক বা পরিবারকে তা জানানো হয়েছে এক সপ্তাহ পর। জিডি করতে গেলে স্থানীয় থানা-পুলিশকে টাকাও দিতে হয়েছে তাঁদের।
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার এক মাদ্রাসা থেকে একসঙ্গে চারজন পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কয়েক দিন পর একই উপজেলার আরেকটি মাদ্রাসায় তাদের পাওয়া যায়।
নীলফামারী সদরের এক শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় যাবে বলে ঘর থেকে বের হয়ে একটি হোটেলে কাজ নেয়। কয়েক দিন পর বিষয়টি হোটেলমালিক বুঝতে পারেন এবং তাকে ঘরে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সাত-আট বছরের দুই মাদ্রাসাশিক্ষার্থীকে উদ্ধার করে স্থানীয় এক তরুণ নরসিংদীর মাধবদী থানায় নিয়ে আসেন। পরে থানা থেকে অভিভাবকেরা তাদের নিয়ে যান।
৭ জুলাই দৈনিক আজকের পত্রিকার এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, নিখোঁজদের মধ্যে মাদ্রাসাশিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। ২৫ জনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিখোঁজ ১৯ জনই ঘরে ফিরেছে। ২৫ জনের মধ্যে ২১ জনই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। যারা মূলত মাদ্রাসায় থাকতে অনীহা ও লেখাপড়ার প্রতি ভীতি থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছিল।
কিশোরগঞ্জের একটি ঘটনায় দুই হেফজ শিক্ষার্থী ছেলেধরার খপ্পরে পড়েছিল বলে তাদের অভিভাবক ধারণা করছেন। হারিয়ে যাওয়ার এক দিন পর নারায়ণগঞ্জের একটি এলাকা থেকে স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে তাদের উদ্ধার করা হয়।
তাদের একজনের অভিভাবক প্রতারণার শিকারও হয়েছেন। তাদের ছেলেকে লাকসাম হাসপাতালে পাওয়া গেছে বলে পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি আট হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
ফেসবুকে ছড়িয়ে যাওয়া নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তির ফোন নম্বর থেকে ওই অভিভাবককে ফোন দেওয়া হয়। পরে মুঠোফোন নম্বর ট্রেস করে জানা যায়, রাজধানী ঢাকা থেকে পুলিশের নাম ব্যবহার করে কোনো প্রতারক তাঁকে ফোন দিয়েছিল।
প্রথম আলোর ই-মেইলে এক সংবাদকর্মী জানান, গত সোমবার তাঁর আত্মীয় স্থানীয় এক কামিল মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কসবা থানা এলাকা থেকে জোর করে রিকশায় তুলে নেন দুজন ব্যক্তি। এ সময় তার নাকের সামনে কিছু একটা দিলে সে অচেতন হয়ে যায়।
মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকা থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। জানা যায়, অপহরণকারীরা তাকে একটি গুদামে আটকে রেখেছিল। সেখান থেকে সে পালিয়ে আসে। তবে এ ঘটনায় অভিভাবকেরা থানায় কোনো অভিযোগ বা মামলা করেননি।
ফেসবুক পোস্টগুলোতে বলা হচ্ছে, ঢাকা-চট্টগ্রামেই বেশির ভাগ শিশু হারানো গেছে; কিন্তু বিষয়টি তেমন নয়। অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, নিখোঁজের ঘটনাগুলো ঘটেছে গোটা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। যেমন বরিশালের বাকেরগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া, নরসিংদীর মাধবদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর ও আখাউড়া, নীলফামারী সদরসহ নানা জেলা-উপজেলায়।
অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও নিখোঁজ সংবাদ নিয়ে এমন কাণ্ড দেখা গেছে। ফেসবুকে গত এপ্রিলে খোলা একটি পেজে শুধু নিখোঁজ সংবাদ নিয়েই সব পোস্ট করা হয়েছে। নিখোঁজেরা প্রায় সবাই দেশটির সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের। বেশির ভাগ ঘটনা গত এক মাসের।
এর মধ্যে গত সপ্তাহে নদীয়ার একটি মাদ্রাসা থেকে একসঙ্গে ৯ শিক্ষার্থী নিখোঁজ হয়। পরে একজন ছাত্রের বাড়িতে তাঁদের খোঁজ পাওয়া যায়। মাদ্রাসায় থাকা অবস্থায় নানান অভিযোগে অভিভাবক ডাকার কথা বলা হলে ভয়ে তারা পালিয়ে যায় বলে ওই পেজেই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ দাবি করে। এ ঘটনা সেখানে বেশ আলোড়ন তৈরি করে।
১৭ কোটির দেশে প্রতিদিন অনেক শিশুই হারিয়ে যায়। তবে শিশু নিখোঁজ-সংক্রান্ত আলাদাভাবে কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে চলতি মাসের প্রথম ৭ দিনে ৭৬ জন নিখোঁজের বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। জুন মাসে এই সংখ্যা ছিল ২৬০ জন।
২০২৩ সালের ৪ তারিখ দৈনিক ইত্তেফাক এক প্রতিবেদনে বলছে, গেল বছর শুধু রাজধানী থেকেই নিখোঁজ হয়েছে প্রায় ছয় হাজার মানুষ। এর মধ্যে কত জন ফিরে এসেছে, সেই তথ্য নেই। শুধু ঢাকা শহরের চিত্রই বলে দেয়, গোটা দেশে কত মানুষ দিনে বা সপ্তাহে বা মাসে নিখোঁজ হয় এবং এখানে বড় একটি সংখ্যার শিশু-কিশোর হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
সাম্প্রতিক নিখোঁজ সংবাদ নিয়ে এক প্রতিবেদনে বিবিসি বাংলা জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচারকালে প্রায় ৭৭৮ জনকে উদ্ধার করে দেশটির পুলিশ। তাদের মধ্যে প্রায় ১৫৫ জন ছিল শিশু-কিশোর।
ফলে হারিয়ে যাওয়া সব শিশুই যে ফেরত আসে বা তাদের ফেরত পাওয়া, তা নয় কিন্তু। ছেলেধরা, শিশুপাচারকারীসহ নানা চক্র এখানে যুক্ত থাকতে পারে।
রাঙ্গুনিয়ায় নিখোঁজ মাদ্রাসাছাত্রদের খুঁজে পাওয়ার বিষয়টি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছিলেন এক শিক্ষার্থীর স্বজন। তিনি জানান, আগের নিখোঁজ সংবাদের খবরটিই এখনো বিভিন্ন ফেসবুক পোস্ট ছড়ানো হচ্ছে; কিন্তু ফিরে পাওয়ার পোস্টটি আগেরটির মতো শেয়ার হচ্ছে না।
এক কিশোরীকে প্রাপ্তিসংবাদও ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে বিষয়টি বেশি জানাজানি না হতে তা তুলে ফেলা হয়। তবে তার আগের নিখোঁজ সংবাদটি এখনো থেকে গেছে ফেসবুকে।
৮ জুলাই মিডিয়া গবেষণাকেন্দ্র ডিসমিস ল্যাব সাম্প্রতিক নিখোঁজ সংবাদ নিয়ে তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলছে, মে এবং জুন মাস থেকে নিখোঁজ এমন শিশুদের নিয়ে পোস্ট দেওয়া হয়েছে গত কয়েক দিনে।
নিখোঁজ সংবাদে কেন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বেশি তা জানতে সাবেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ কওমি মাদ্রাসাসংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের কাছ থেকে জানা যায়, কওমি মাদ্রাসার কিতাব (সাধারণ বিভাগ) ও হিফজ (কোরআন মুখস্থকরণ বিভাগ) উভয় বিভাগে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় হিজরি বর্ষের শাওয়াল মাস থেকে।
এ সময় মাদ্রাসায় নতুন অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, শুরুর দিকে বিশেষ করে আবাসিক মাদ্রাসার নিয়মশৃঙ্খলা বা নিয়মকানুনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে অনেকের কষ্ট হয়। ধীরে ধীরে তারা মাদ্রাসার পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
এ ছাড়া গোটা দেশে কওমি মাদ্রাসায় বছরে তিনটি পরীক্ষা হয়ে থাকে। তার মধ্যে প্রথম ও শেষ পরীক্ষাটিতে পড়াশোনার বেশ চাপ থাকে। প্রথম চার মাসের পরীক্ষাটি বছরের ঠিক এ সময়ে বা মহররম মাসে বা এর আগে পরে শুরু হয়।
কোনো কোনো মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের কঠোর শাস্তির প্রচলন আছে, যা নিয়ে নানা সময়ে সমালোচনা ওঠে। শাস্তির ভয়েও অনেক সময় শিক্ষার্থীরা পালিয়ে যায়।
নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া, পড়াশোনা ও পরীক্ষার চাপ বা শাস্তির ভয়ের কারণে শিক্ষাবর্ষের প্রথম কয়েক মাসে মাদ্রাসা থেকে শিক্ষার্থীদের পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। অতীতেও এ রকম ঘটনা দেখা গেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেসব শিক্ষার্থী ফিরেও আসে বা কয়েক দিন পর তাদের খোঁজ পাওয়া যায়।
এ ব্যাপারে কথা হয় কওমি মাদ্রাসার অন্যতম একটি শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহসভাপতি মুসলেহউদ্দীন রাজুর সঙ্গে। বোর্ডটির অধীন গোটা দেশে ২৫ হাজার মাদ্রাসা আছে।
তিনি বলেন, পড়াশোনা ও পরীক্ষার চাপে শিক্ষার্থী পালিয়ে গিয়ে থাকতে পারে, সেই সংখ্যাটা খুবই কম। বছরের এ সময়ে শিক্ষার্থীদের পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতার বিষয়টি তিনি নাকচ করে দেন। সেই সঙ্গে কোনো শিশু পাচারকারী চক্র এর সঙ্গে যুক্ত কি না, তা নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে খতিয়ে দেখার অনুরোধও করেন তিনি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিখোঁজ সংবাদ ভাইরাল হওয়া ও এ নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হওয়ার বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, শিশুদের বিষয়ে উদ্বিগ্ন কাজ করায় মানুষ এমন পোস্ট ফেসবুকে শেয়ার করে দেওয়াকে একটা দায়িত্ব বলে মনে করে। এর ফলে আতঙ্ক তৈরি হয়, যার ফলে গণপিটুনির ঘটনা ঘটারও প্রমাণ আছে।
এ ব্যাপারে মানুষের কী করা উচিত, সে ব্যাপারে তিনি বলছেন, প্রথমতঃ দ্রুত শেয়ার করার তাড়না থেকে মুক্ত হওয়া একজন দায়িত্বশীল মানুষের প্রথম কাজ। দ্বিতীয়তঃ ক্রস চেকিংয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা। যিনি সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করেন, ইন্টারনেটে কোনো বিষয় সম্পর্কে খোঁজ করে দেখা তার পক্ষে সম্ভব। তৃতীয়তঃ সত্য খবরের জন্য শুধু সামাজিক মাধ্যম নয়, নিজস্ব যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া।
গীতি আরা নাসরীন মনে করেন, ভুল তথ্যের প্রসার বা আতঙ্ক রোধ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে সঠিক তথ্য দেওয়া, তথ্য চেপে রাখা নয়। ডিজিটাল লিটারেসি ব্যতিরেকে সাধারন মানুষের পক্ষে দায়িত্বশীল হয়ে ওঠা কঠিন। এক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমকে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের পক্ষে নিজ স্থানীয় সংবাদদাতাদের মাধ্যমে সঠিক খবর পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া এ ধরনের পরিস্থিতি কী করা উচিত এবং আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করা করতে হবে সে বিষয়েও সংবাদ প্রচার করতে পারে।
বাংলাদেশের তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্টওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সুমন রহমান মনে করেন প্রতিদিন গোটা দেশে কত মানুষ নিখোঁজ হয় তা নিয়ে খুব একটা ধারণা নেই জনসাধারণের মধ্যে। বাইরের দেশে হারিয়ে যাওয়া মানুষের ডেটাবেজ উন্মুক্ত থাকে। আমাদের দেশে থানায় হয়তো এমন ডেটাবেজ থাকে, সেটিকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। মানুষের জন্য তখন বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পেতে সহজ হবে। গুজব ছড়ালেও তখন মানুষ সে ডেটাবেজে গিয়ে বিষয়টির সত্যতা যাচাই করতে পারবে।
বার্তা সংস্থা এএফপির ফ্যাক্টচেক এডিটর কদরুদ্দীন শিশির বলেন, ফেসবুকে শিশু নিখোঁজের ঘটনা দেখলে অনেক অভিভাবক অন্যদের সচেতন করতে সেখানে ইন্টার্যাকশন (লাইক, কমেন্ট, শেয়ার) করেন। ফেসবুকের অ্যালগরিদম তখন এমন অনেক পোস্ট তাঁর সামনে নিয়ে আসে। এতে তাঁর মনে হতে পারে, অনেক শিশু হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকে নিখোঁজ সংবাদ কপি-পেস্ট করে পোস্ট করেন, এতে অনেক সময় ঘটনাটি কখনের তা বোঝা যায় না। অনেক ফেসবুক গ্রুপ লাইক শেয়ারের জন্য এ ধরনের পোস্ট দিয়ে থাকতে পারে। আবার কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে আতঙ্ক ছড়িয়ে থাকতে পারে, তা রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক থাকতে হবে। অভিভাবকদেরও সচেতন থাকতে হবে।
অভিভাবক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে আরও একটি পর্যবেক্ষণ পাওয়া যায়, একটা সময় কোনো এলাকায় কোনো শিশু হারানো গেলে ওই এলাকা বা তার আশপাশে মাইকিং করা হতো। ফলে দেশের আরেক জেলা বা উপজেলার মানুষের ওই নিখোঁজ সংবাদের বিষয়টা জানার সুযোগ ছিল না। এখন আগের মতো মাইকিং করার চল নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের এ-মাথা থেকে ও-মাথা। এমনকি ভারতের নিখোঁজ সংবাদ এ দেশে ছড়িয়ে পড়ছে এমনটিও দেখা গেছে।
শিশু পাচার বা অপহরণের ঘটনা এ দেশে ঘটে থাকে। ফলে অভিভাবকদের মধ্যে ছেলেধরার আতঙ্ক তৈরি হওয়াটা অমূলক নয়। দুটি ঘটনার মধ্যে ছেলেধরা বা অপহরণের বিষয়টিও আমরা দেখলাম।
তবে এ আতঙ্ক যাতে আরও বেশি না ছড়ায় তা নিশ্চিত করতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেই। তাদের সাইবার ইউনিট আছে, ফেসবুকে কারা কোন উদ্দেশ্যে নিখোঁজ সংবাদগুলো একসঙ্গে জড়ো করে ভাইরাল করছে, তা অনুসন্ধান করা ও বিষয়টি মনিটর করার সুযোগ তাদের আছে। এ ছাড়া একেবারে গুজব বলে উড়িয়ে না দিয়ে শিশু নিখোঁজের পেছনে কোনো অপরাধচক্র কাজ করছে কী না, সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে তাদের।
গত রোববার ছেলেধরা সন্দেহে সিলেটের গোলাপগঞ্জে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী একজন যুবককে স্থানীয় লোকজন গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে দেয়। এমন ঘটনা ২০১৯ সালের জুলাই মাসে ঢাকার বাড্ডায় একটি স্কুলের সামনে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে তসলিমা বেগম রানু নামের এক অভিভাবকের মর্মান্তিক মৃত্যুর কথাই মনে করিয়ে দেয় আমাদের। যার বিচার এখনো পায়নি তাঁর এতিম শিশু। আমরা চাই না শিশু নিখোঁজের আতঙ্কে এমন কোনো পরিণতি কারও না হোক।
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: rafsangalib1990@gmail.com