মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যে পরিবেশের বিপর্যয় খালি চোখেই দেখা যায়। দানবাকৃতির খননযন্ত্র মাটি খুঁড়ে মূল্যবান বিশ্বের বিরল উপাদান বের করে আনছে। আর পেছনে ফেলে আসছে বিষাক্ত পানির আধার আর পরিত্যক্ত মাটি।
এটা নিছক পদ্ধতিগতভাবে ধ্বংসের মাধ্যমে সম্পদ আহরণের ঘটনা নয়। মিয়ানমারের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মূল্যবান এসব খনিজের বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার খুব হিসাবি পথ এটি।
মিয়ানমারে চীনের বিরল খনিজ আহরণের মাত্রা অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে। চীনের রাজস্ব বিভাগের এক পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে মিয়ানমার থেকে বিরল খনিজের আমদানি ৭০ শতাংশ বেড়েছে। মেট্রিক টনের হিসাবে বেড়েছে ৩৪ হাজার ২৪১ মেট্রিক টন।
এটা এই ইঙ্গিত করে যে বেইজিং মজুত করার যে আগ্রাসী কৌশল নিয়েছে, সেটা তার অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনীয়তার বাইরের বিষয়। এখানে বার্তাটি পরিষ্কার। চীন ভবিষ্যতের সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার কথা মাথায় রেখে বিরল খনিজ মজুত করছে, যাতে সেটিকে তারা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
মিয়ানমারকে বিরল খনিজের মজুত ভান্ডার হিসাবে ব্যবহারের চীনা ধরনটি অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক। সেটি ঘটেছেও দ্রুতগতিতে। কাচিন অঞ্চলটি একসময় আদিম বনভূমি ও সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের জন্য পরিচিত ছিল। খনি খননের কারণে কাচিনকে এখন দূর থেকে দেখা চন্দ্রপৃষ্ঠের মতো মনে হবে।
কাচিনে স্থানীয় প্রক্সি ও ছায়া অংশীদারদের একটা জটিল নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে কর্মকাণ্ড চালায়। চীনা কোম্পানিগুলো কাচিনে তাদের কাজ ৪০ শতাংশ বাড়িয়েছে।
মিয়ানমার এখন চীনের ভারী খনিজের প্রাথমিক উৎস। ডিসপ্রোসিয়াম, ইট্রিয়াম ও টার্বিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ খনিজের প্রায় ৪০ শতাংশ আছে মিয়ানমার থেকে।
এর পরিবেশগত বিপর্যয়ও বিশাল। বেসরকারি সংস্থা গ্লোবাল উইটনেস-এর তদন্তে বেরিয়ে এসেছে বাস্তুসংস্থানের বিস্তৃত ধ্বংসের চিত্র। খনি থেকে খনিজ উত্তোলন ও নিষ্কাশন প্রক্রিয়ায় পানির উৎস ও কৃষিজমিতে বিষাক্ত রাসায়নিক মিশে সেগুলোকে বিষিয়ে দিচ্ছে।
স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যের ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। চর্মরোগ, ফুসফুসের অসুখ, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে যাওয়ার মতো অসুস্থতায় তাঁরা ভুগছেন।
পশ্চিমা কোম্পানিগুলোকে জোর করে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ফলে চীনের কোম্পানিগুলো কোনো প্রতিযোগিতা আর নিরীক্ষা ছাড়াই সেখানে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যায়। আন্তর্জাতিকভাবে বাণিজ্যের যে নীতিমালা আছে, সেটাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এবং পরিবেশ মানদণ্ডের তোয়াক্কা না করে তারা এটা করে চলেছে। এই শূন্যতায় মিয়ানমারকে বিরল খনিজের ভান্ডার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে চীনকে।
চীনের এসব খনির কার্যক্রমে সুরক্ষা দেয় মিয়ানমারের জান্তা সরকার। ফলে তাদের বধির কানে এসব কিছু পৌঁছায় না। আর মিয়ানমারের জান্তা সরকারের অস্তিত্ব চীনের সমর্থনের ওপর টিকে আছে।
সময় বিবেচনায় বেইজিংয়ের কৌশলটি একেবারেই ছল। বিশ্ব নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও অগ্রসর প্রযুক্তিতে রূপান্তরের প্রতিযোগিতার মধ্যে আছে। সবারই এখন বিশ্বের এসব বিরল খনিজ দরকার। চীন নিজেকে বিরল খনিজের দ্বাররক্ষী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
খনি থেকে খনিজ উত্তোলন ও সেগুলোর প্রক্রিয়াজাতকরণ—বিশ্বের ৯০ শতাংশ বিরল খনিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ করার মধ্য দিয়ে চীন একচ্ছত্র একচেটিয়াকরণ করেছে।
এই আধিপত্য নিছক বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য থেকে নয়। এটা পশ্চিমাদের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একেবারে হৃৎপিণ্ডে আঘাত হানার জন্য কৌশলগত অস্ত্র।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জান্তা সরকারকে চাপে ফেলার জন্য মিয়ানমারকে বয়কট করেছে। কিন্তু বিরল খনিজের এই পটভূমি বিবেচনা করলে গুলি তাদের দিকেই ঘুরে গেছে।
পশ্চিমা কোম্পানিগুলোকে জোর করে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ফলে চীনের কোম্পানিগুলো কোনো প্রতিযোগিতা আর নিরীক্ষা ছাড়াই সেখানে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যায়। আন্তর্জাতিকভাবে বাণিজ্যের যে নীতিমালা আছে, সেটাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এবং পরিবেশ মানদণ্ডের তোয়াক্কা না করে তারা এটা করে চলেছে।
এই শূন্যতায় মিয়ানমারকে বিরল খনিজের ভান্ডার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে চীনকে।
বিরল খনিজের বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় গভীর প্রভাব পড়বে। অনেক দেশ তাদের নিজস্ব সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের বিকাশ ঘটাচ্ছে, সবুজ প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। চীনের এই মজুত তাদের জন্য বিশাল অর্থনৈতিক বাধা তৈরি করবে।
বিরল খনিজ রপ্তানিকে চীন ভূরাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দেখেছি। উদাহরণ হিসেবে, ২০১০ সালে তারা জাপানের বিরুদ্ধে ১০টি বিধিনিষেধ দেয়। এটা থেকে প্রমাণিত হয়, চীন আরও বড় সংঘাতের প্রস্তুতি নিয়েছে।
মানবিক মূল্যও সমানভাবে ধ্বংসাত্মক। কাচিনের আদিবাসীরা তাদের মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেছে। তাদের প্রথাগত কৃষিকাজের এলাকা বিষাক্ত খনি অঞ্চলে রূপান্তরিত হয়েছে।
রাইটস রিসোর্চ সেন্টার অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। এর মধ্যে জোর করে স্থানান্তর, শ্রমিকদের অধিকার হরণ এবং সাংস্কৃতির স্থাপনা ধ্বংসের মতো দৃষ্টান্ত রয়েছে। মিয়ানমার বিচ্ছিন্ন থাকায় এসব অপরাধের বেশির ভাগই বাইরের বিশ্বে আসতে পারে না।
যতক্ষণ পর্যন্ত না বিশ্বসম্প্রদায় ও দায়িত্বশীল শক্তিগুলো মিয়ানমারে চীনের বিরল খনিজ সম্পদ লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে নির্ধারক সিদ্ধান্ত না নিতে পারছে ততক্ষণ পর্যন্ত সেটা বিরল খনিজের সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর হুমকি তৈরি করবে না, ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির বিকাশেও বাধা তৈরি করবে। এখানে বিশ্বের নীরবতা বেইজিংয়ের কৌশলকেই শুধু উৎসাহিত করে।
অঙ্কিত কে স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন, সিকিউরিটি অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক ল্যাঙ্গুয়েজ, আরআরইউ, ভারতের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে সহকারী অধ্যাপক
দ্য ইরাবতী থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত