অভিমত

উগান্ডায় যে রকম নির্বাচন হয়

‘হামলা, মামলা, খুন, জখম ও সংঘাতের মধ্যেই উগান্ডার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।’
‘হামলা, মামলা, খুন, জখম ও সংঘাতের মধ্যেই উগান্ডার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।’

৭৭ বছর বয়সী উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইয়াওয়েরি মুসোভেনি গদি ছাড়তে চান না​। ১৯৮৬ সাল থেকে একটানা এই পদ আঁকড়ে ধরে আছেন। অথচ এই মুসোভেনিকেই একদা গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলা হতো। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে উগান্ডার ইতিহাসকে রক্তক্ষয়ী বলা চলে।

যাঁদের বয়স এখন চল্লিশের কোঠায় বা তার ওপরে, তাঁদের অনেকেই ইদি আমিনের নাম শুনেছেন। ১৯৬২ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর দুই যুগে অন্তত দুটি গৃহযুদ্ধে আট লাখ মানুষ নিহত হন উগান্ডায়। এমন সময় মুসোভেনি দেশটির জন্য ত্রাতা হয়ে আসেন। সেই ত্রাতাই একসময় গলার কাঁটা হয়ে ওঠেন উগান্ডাবাসীর। ২০০৫ সাল পর্যন্ত একদলীয় শাসনব্যবস্থা জারি রাখেন তিনি। পরে বহু দলভিত্তিক রাজনীতির সূচনা হলেও মুসোভেনিকে সরানো যায়নি। ছলে-বলে-কৌশলে তিনি থেকে গেছেন ক্ষমতায়।

১৯৮৬ সাল থেকে উগান্ডার নির্বাচন নিয়ে লিখতে হলে গোটা একটা বই লিখতে হয়। তার চেয়ে বরং ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত সব৴শেষ নির্বাচন নিয়ে আলাপ করা যাক। ওই বছর উগান্ডার নিস্তরঙ্গ রাজনীতিতেও নির্বাচন নিয়ে জমজমাট গল্পের অবতারণা হয়েছিল।

হামলা, মামলা, খুন, জখম ও সংঘাতের মধ্যেই উগান্ডার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচনে প্রতিনিধিদল পাঠাতে অস্বীকৃতি জানায়। যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের আগের দিন ঘোষণা দেয়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তারা কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারছে না। মুসোভেনির তাতে কিছুই যায়-আসেনি। নির্বাচন হয়ে যায়।

২০২১ সালে সে দেশের নির্বাচনের দিকে শুধু উগান্ডাবাসী নন, সারা বিশ্বের চোখ ছিল। নানা কারণে নির্বাচনটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রিডম হাউস সে সময় উগান্ডা সম্পর্কে বলেছিল, রাষ্ট্রীয় সম্পদের নয়ছয় করে সরকার ক্ষমতা ধরে রেখেছে। তাদের হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগ বিরোধী দলকে ভয় দেখাচ্ছে।

উগান্ডার অর্থনৈতিক অবস্থাও তখন শোচনীয়। উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে মুসোভেনি দেশের অর্থনীতিকে খাদের কিনারে নিয়ে গেছেন। সবচেয়ে বেশি টাকা ঢেলেছেন যোগাযোগ খাতে। বিদেশ থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি ঋণ করে শোধ করতে পারছিলেন না। ঋণের অঙ্ক জিডিপির ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। চীন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন—সবাই টাকা পায়।

মুসোভেনির সরকার চীনের কাছে ধরনা দিচ্ছে ঋণ পুনঃ তফসিল করতে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ তলানিতে, করের বোঝায় ন্যুব্জ সবাই। এর সঙ্গে আছে দুর্নীতি। ২০২০ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে অবস্থান ছিল ১৪২ (বাংলাদেশ ১৪৬)।

১৯৮৬ সাল থেকে উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ৭৭ বছর বয়সী ইয়াওয়েরি মুসোভেনি

মানবাধিকার রেকর্ডও তথৈবচ। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার প্রতিবেদন (২০২০) অনুযায়ী, উগান্ডায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথেচ্ছাচার চালাচ্ছে। দেশটিতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতন, অমানবিক কারা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শুধু বিরোধী দলের সমর্থক হওয়ায় জেলে পচতে হচ্ছে বহু মানুষকে। বাক্‌ ও চিন্তার স্বাধীনতা নেই, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার নেই। ইন্টারনেটও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়।

এসব নিয়ে উগান্ডার নাগরিক সমাজ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নও রুষ্ট ছিল। এমন এক টালমাটাল সময়ে মুসোভেনির ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স মুভমেন্টকে (এনআরএম) চ্যালেঞ্জ করেন ন্যাশনাল ইউনিটি প্ল্যাটফর্মের রবার্ট চাগলানি। পপস্টার রবার্ট আগে থেকেই সুপরিচিত ববি ওয়াইন নামে। তাঁর লাল বেরেট, তাঁর বিপ্লবী সংগীত তরুণদের কাছে তাঁকে তুমুল জনপ্রিয় করে তোলে।

২০১৭ সালেই পার্লামেন্টে পা রেখেছিলেন ববি। চার বছর পর মুসোভেনির বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন। যে দেশের ৭৫ শতাংশ মানুষের গড় বয়স ৩০, তাঁদের কাছে দ্রুতই পৌঁছে যান ববি ওয়াইন। গান বাঁধেন, ‘হোয়াটস অন ইজ অন/ ফ্রিডম ইজ অন দ্য জোন/ লাইফ ইজ দ্য রিজন/ টু ফাইট আনটিল ডন/ নো মোর প্রিজনস/ ভিক্টরি ইস হিয়ার সুন/ নো মোর সাফোকেশন, অল দ্যাট বি গন/ ওয়েবেরেরেমু (আমাদের জন্য আমরা), ইট ইজ টাইম টু রিবর্ন।’

এবার শুরু হয় খেলা। ববি যেখানেই প্রচারে যান, সেখানেই হামলা। এমবালাইতে হামলা, সমাবেশ ছত্রভঙ্গ। কিটগামে সমাবেশকে দাঁড়াতে দেয়নি। গুলু, আরুকানারাই, কারাইনডোঙ্গা, মাসিন্দি—সর্বত্র ত্রাসের রাজত্ব। ববি ওয়াইন গ্রেপ্তার হন। তাঁর মুক্তির দাবিতে জমায়েত লোকজনকে আবার ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ, এতে ৫৪ জন নিহত হন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলে টুমওয়াইন বলে বসেন, পুলিশের অধিকার আছে গুলি ছোড়ার। এর মধ্যে অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে বিরোধীদের গ্রেপ্তার শুরু হয়। সংবাদ প্রকাশে বাধা তো ছিলই। সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও নির্যাতন থেকে বাদ পড়েননি।

নাগরিক সংগঠনগুলোর মোর্চা পপুলেশন সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল (পিএসআই) বিবৃতি দেয়, ‘রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে আমরা উগান্ডার জনগণকে হয়রানি ও ভয় দেখানো থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানাই নিরাপত্তা বাহিনীকে। একই সঙ্গে আফ্রিকান ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানাই এ ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে।’

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আহ্বান জানান। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিবৃতি দেয়। এদিকে নির্বাচন কমিশন ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে যেতে থাকে। তারা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বদ্ধপরিকর বলে জানায়।

উগান্ডার তারুণ্যকে জাগিয়ে তুলেছিলেন ববি উয়াইন

এমন একটা সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত নাটালি ব্রাউন উগান্ডার রাজনীতিতে নাক গলাচ্ছেন, এ অভিযোগ করে উগান্ডা সরকার। উগান্ডা সরকারের মুখপাত্র ওফোনো ওপোন্ডো বলেন, ‘তিনি যা করছেন, তা হলো আমাদের রাজনীতিতে ন্যক্কারজনক অনুপ্রবেশ। বিশেষ করে নির্বাচনে। তিনি আমাদের নির্বাচন ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা বানচাল করতে চান।’

মার্কিন রাষ্ট্রদূত নাটালি ব্রাউন অবশ্য কাউকে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, কূটনৈতিক কাজের অংশ হিসেবেই তিনি বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে থাকেন।

হামলা, মামলা, খুন, জখম ও সংঘাতের মধ্যেই উগান্ডার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচনে প্রতিনিধিদল পাঠাতে অস্বীকৃতি জানায়। যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের আগের দিন ঘোষণা দেয়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তারা কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারছে না। মুসোভেনির তাতে কিছুই যায়-আসেনি। নির্বাচন হয়ে যায়।

ববি ওয়াইন ভোট চুরির কথা বলেন। তাঁর রাজনৈতিক অফিসে তালা মেরে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তিনি নিজেও নজরদারিতে পড়েন। তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী না বাড়িতে ঢুকতে দেয়, না বেরোতে। নির্বাচন কমিশন যথারীতি ভোট কারচুপির অভিযোগ অস্বীকার করে।

দিন যায়, মুসোভেনি ষষ্ঠবারের মতো প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। সেই অনুষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা বর্জন করেন, ‘গভীর উদ্বেগ’ ও ‘শঙ্কা’ প্রকাশ করেন। উগান্ডাবাসীও হতাশা ব্যক্ত করেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘উগান্ডার গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত’ সবাইকে ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হবে।

মাস কয়েক আগে তারা আফ্রিকান গ্রোথ অ্যান্ড অপরচুনিটি অ্যাক্ট (আগোয়া) চুক্তি থেকে উগান্ডাকে বের করে দেয়। এই চুক্তির আওতায় আফ্রিকার আরও কয়েকটি দেশের মতো উগান্ডার ১৮ শ পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেত। এসব নিয়ে মুসোভেনির কোনো চিন্তা নেই। তিনি আগের মতো দেশ চালাতে থাকেন। আর বিরোধী দলের লোকজনও আগের মতোই থাকেন দৌড়ের ওপর।

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক