চীন-যুক্তরাষ্ট্র কেউ কি কারও কথা শোনে?

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন
ছবি : রয়টার্স

একটি দৃশ্য কল্পনা করুন: চীন ও মেক্সিকো সামরিক জোট গড়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর মধ্য দিয়ে যাওয়া ৩১৪৫ কিলোমিটারের সীমান্তে সেই জোট সামরিক প্রশিক্ষণ ও মহড়া দিচ্ছে। 

এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি বটে; কিন্তু বাস্তবেই সেই ধরনের দৃশ্যের অবতারণা হতে হয়তো খুব বেশি দেরিও নেই। কারণ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও রাশিয়া মেক্সিকোতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে (বিশেষ করে খনি, জ্বালানি ও প্রযুক্তি খাতে) বহুগুণ। এই মুহূর্তে চীন ও রাশিয়া মেক্সিকোর প্রধান দুটি বাণিজ্যিক অংশীদার। 

এ অবস্থায় ওয়াশিংটনের প্রতিক্রিয়া কী হবে? কিউবায় চীন একটি সামরিক ঘাঁটি গড়তে পারে বলে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে যেসব খবর বেরিয়েছে (যদিও এ খবরের সত্যতা হাভানা অস্বীকার করেছে), সেগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বেশ কিছু সূত্র মিলবে। 

 তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে জন্ম নেওয়া রাশিয়া বেশ কিছু দেশে আগ্রাসন চালিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে, ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায়, ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে অভিযান চালিয়েছে। এরপর রাশিয়া ২০০৮ সালে জর্জিয়ায় এবং ২০১৪ সালে একবার এবং ২০২২ সালে আবার ইউক্রেনে হামলা করেছে। এ ছাড়া তারা সিরিয়াসহ অন্য দেশগুলোতে ঘৃণ্য ভূমিকা পালন করেছে। 

যুক্তরাষ্ট্রও একইভাবে বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে বা সরকার পরিবর্তনের জন্য রাশিয়ার চেয়ে নিকৃষ্ট ভূমিকা পালন করেছে। প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রবান্ধব শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার বা বৈরিভাবাপন্ন দেশগুলোতে সরকার ফেলে দেওয়ার দিকে মনোনিবেশ করেছে। আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, চিলি, গুয়াতেমালা, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র, নিকারাগুয়া, পানামা এবং ওই অঞ্চলের আরও ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র এই নীতি অনুসরণ করে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্র সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার আগে ১৯৫০–এর দশকে পশ্চিম গোলার্ধের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ছিল কিউবা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে শেষ করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তাঁর প্রভাব কীভাবে আরোপ করে একটি দেশকে বিপদে ফেলতে পারে, কিউবা তার বড় উদাহরণ। 

প্রভাব বলয় বিস্তার প্রশ্নে দুই দেশই আপসহীন রয়ে গেছে। আসলে সাম্রাজ্যবাদী নেতারা দার্শনিক মার্টিন বুবারের ভাষায় ‘সংলাপের নামে স্বগতোক্তি’ করে থাকেন। বুবার এ ধরনের আলাপকে সংলাপ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে, ‘দুই বা ততোধিক ব্যক্তি কোনো একটি স্থানে বৈঠক করেন; প্রত্যেকে অদ্ভুতভাবে কটূক্তিপূর্ণভাবে ও ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে একই কথা বলেন এবং শেষ পর্যন্ত তা নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলার মতো করে কথা শেষ করেন।’ অর্থাৎ কেউ কারও অবস্থান থেকে সরেন না। 

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কারণে শিল্পায়ন ভেঙে পড়া ও ভাষাগত বিলুপ্তির শিকার হওয়া দেশের আরেকটি বড় উদাহরণ হলো হাওয়াই। ১৯৫৯ সালের ২১ আগস্ট আমেরিকা হাওয়াইকে তার ৫০তম অঙ্গরাজ্য বানানোর আগে সেখানে যে সমৃদ্ধি ছিল, তা পরবর্তীকালে শেষ হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশের আগে হাওয়াইয়ের আইওলানি প্রাসাদে বৈদ্যুতিক বাতি ছিল, যা তখন হোয়াইট হাউসে ছিল না। সে সময় হাওয়াইতে বিদ্যুৎ ছিল, সরকারি গণপরিবহন ছিল, রেলপথ ছিল। সে সময় হাওয়াই ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ সাক্ষরতার হারবিশিষ্ট দেশ। 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর দৃষ্টি ফেলে ইউনিভার্সিটি অব বার্কলের একটি ব্লগে প্রকাশ করা ইউরি গোরোদনিচেঙ্কো ও অন্য অর্থনীতিবিদদের একটি বহুল আলোচিত খোলা চিঠিতে লেখকেরা বলেছেন, ‘প্রভাববলয়’ গড়ে তোলার ধারণা একটি প্রাচীনপন্থী ধারণা। তঁাদের মতে, ‘রাজা-বাদশাহ বা সাম্রাজ্যের আমলে এই ধারণা উপযুক্ত ছিল। এই ধারণা আধুনিক যুগের জন্য নয়।’ সেই ধারণা মেনে নিয়ে, সেটি বেছে বেছে রাশিয়া ও চীনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে তা অনেকাংশেই তার নিরপেক্ষতা হারায়। কেননা যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের ৮০টি দেশে সাড়ে সাত শ সামরিক ঘাঁটি বসানোর সুবাদে যে প্রভাব বলয় গড়ে তুলেছে, তা তার ‘নিজ গোলার্ধ’কেও ছাড়িয়ে গেছে। 

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও ন্যাটোর আদলে পশ্চিমা সামরিক তৎপরতা বাড়ানো হচ্ছে, যা অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের জোট অকাস গঠনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। এই জোট যে চীনকে নিশানা করে করা হয়েছে, তা সবার কাছে স্পষ্ট। এ ছাড়া আছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট কোয়াড, যেটি হংকং ও তাইওয়ানের ওপর চীনের প্রভাবকে প্রতিহত করে যাচ্ছে। অথচ হংকং ও তাইওয়ানকে চীন ঐতিহাসিকভাবে নিজের এলাকা বলে মনে করে। এ অবস্থায় যখন চীন ও আমেরিকার নেতারা এই দুই ভূখণ্ড নিয়ে কথা বলেন, তখন তাঁরা কি পরস্পরের কথা শোনেন? গত ১৯ জুন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও চীনের নেতা সি চিন পিংয়ের বৈঠকে তাঁদের মধ্যে যে আলাপ হয়েছিল, সেখানে কি তঁারা হংকং ও তাইওয়ান নিয়ে সমঝোতার মনোভাব নিয়ে আলাপ করেছিলেন? 

প্রভাব বলয় বিস্তার প্রশ্নে দুই দেশই আপসহীন রয়ে গেছে। আসলে সাম্রাজ্যবাদী নেতারা দার্শনিক মার্টিন বুবারের ভাষায় ‘সংলাপের নামে স্বগতোক্তি’ করে থাকেন। বুবার এ ধরনের আলাপকে সংলাপ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে, ‘দুই বা ততোধিক ব্যক্তি কোনো একটি স্থানে বৈঠক করেন; প্রত্যেকে অদ্ভুতভাবে কটূক্তিপূর্ণভাবে ও ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে একই কথা বলেন এবং শেষ পর্যন্ত তা নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলার মতো করে কথা শেষ করেন।’ অর্থাৎ কেউ কারও অবস্থান থেকে সরেন না। 

বুবার এই কথা লিখেছিলেন ১৯৪৭ সালে। সেটি ছিল ভিন্ন প্রেক্ষাপট। আজ প্রায় আট দশক পরে এসে ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং বিশ্বরাজনীতি ইস্যুতে তাঁর সেই কথা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। 

 আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত

লরেঞ্জো কামেল গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইওআইয়ের রিসার্চ স্টাডিজের পরিচালক