বাজার বিশ্লেষকেরা মনে করেন, প্রকৃতপক্ষে তেলের কোনো সংকটই ছিল না।
বাজার বিশ্লেষকেরা মনে করেন, প্রকৃতপক্ষে তেলের কোনো সংকটই ছিল না।

মতামত

সয়াবিন তেল নিয়ে ব্যবসায়ীদের আগের সেই তেলেসমাতি

ব্যবসায়ীরা সব পণ্য নিয়েই তেলেসমাতি কাণ্ড করে থাকেন। তবে তেল নিয়ে একটি বেশিই করেন। বাংলাদেশে গুটিকয় কোম্পানি তেল আমদানি করে থাকে। তাঁদের কাছে ভোক্তারা জিম্মি হয়ে থাকে।

কয়েক দিন ধরেই পত্রিকার খবর ছিল, বাজারে সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে বোতলজাত সয়াবিন। খোলা সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছিল এ কারণে যে সেটা বেশি দিন গুদামজাত করলে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে তেলের দাম বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু তাঁরা কাজটি সহজ পথে করলেন না। একটু ঘুরিয়ে। প্রথমে বাজারে তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হলো। সরকার বিপাকে পড়ল। ভোক্তাদের জিজ্ঞাসা ছিল, তেল গেল কোথায়? তেল নেই, এ কথাটি ব্যবসায়ীরা সরাসরি বললেন না। জানালেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে তেলের আমদানি কম। তাই বাজারে সরবরাহও কম।

কেবল ভোক্তা নয়, সরকারের জন্যও এটা বড় বিপৎসংকেত। এমনিতেই মানুষ নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে কাহিল। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন তড়িঘড়ি করে সোমবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন। তিনি জানতে চাইলেন, ‘সমস্যা কোথায়?’ ব্যবসায়ীরা বললেন, ‘এই দামে তো পোষাচ্ছে না।’ প্রতি লিটারে ১০ টাকা লোকসান হচ্ছে। আগে কত লাভ হতো তা কিন্তু তাঁরা বলেননি। শেষ পর্যন্ত সাব্যস্ত হলো প্রতি লিটারে ৮ টাকা সয়াবিনের দাম বাড়ানো হবে।

অন্তর্বর্তী সরকার বাজার স্থিতিশীল রাখতে যতগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে, তেমন কাজে লাগেনি। আমদানি শুল্ক কমিয়ে কিংবা পুরোপুরি প্রত্যাহার করেও পণ্যের দাম কমেনি। ব্যবসায়ীরা সব সময়ই আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দেন। অর্থাৎ যা কিছু ঘটুক ‘কেষ্টা বেটাই চোর।’ ক্রেতারা তো কেষ্টা বেটার দেখা পান না। তাই আমদানিকারকেরা যা বলেন, সেটাই তাঁরা মেনে নিতে বাধ্য হন।

আমদানি দাম ও পরিশোধন ব্যয় কত পড়ে আর তারা বাজারে সেটি কত দামে বিক্রি করেন, সেটা কি সরকার খতিয়ে দেখেছে? বাংলাদেশে গুটিকয় কোম্পানি ভোজ্যতেল আমদানি করে থাকে। তারাই ইচ্ছেমতো দাম ঠিক করে। এখানে সরকার ও ক্রেতা—দুই পক্ষই অসহায়।

বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠকে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে বাজারে বোতলজাত তেল ফিরে এল। সমকাল-এর শিরোনাম ছিল, ‘দাম বাড়িয়ে বাজারে ফিরল “লুকানো” সয়াবিন তেল।’ এতে বলা হয়, ‘সোমবার দাম বাড়ানোর এক ঘোষণায় আচমকা বাজার থেকে হারিয়ে যাওয়া লুকানো তেলের বোতল ফিরেছে দোকানে দোকানে; সেজেছে থরে থরে। বাজারে এখন বোতলজাত সয়াবিন তেলের অভাব নেই।’

বাজার বিশ্লেষকেরা মনে করেন, প্রকৃতপক্ষে তেলের কোনো সংকটই ছিল না। ফন্দি এঁটে কয়েক দিন ক্রেতার নাভিশ্বাস তুলে সরকারকে জিম্মি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন।

অতীতেও ঘটেছে এমন ঘটনা। ব্যবসায়ীরা যখনই মনে করেন, কোনো নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে হবে, প্রথমে তাঁরা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল এখন থেকে বিক্রি হবে ১৭৫ টাকায়, যা এত দিন ছিল ১৬৭ টাকা। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৪৯ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ১৫৭ টাকা। খোলা পাম তেলের লিটারও ১৪৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫৭ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া বোতলজাত পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৬০ টাকা, যা আগে ছিল ৮১৮ টাকা।

বাণিজ্য উপদেষ্টার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, যে সংকট তৈরি হয়েছিল, সেটি আট টাকা বাড়ানোর ফলে কাটবে কি না এবং তদারকি থাকবে কি না। এর উত্তরেও তিনি ব্যবসায়ীদেরই সাক্ষ্য মেনেছেন। তাঁরা তাঁকে বলেছেন, সোমবার থেকে সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।

যেদিন বাণিজ্য উপদেষ্টা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসলেন, সেদিনই খবর এল, চার দিনের ব্যবধানে চট্টগ্রাম বন্দরে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল নিয়ে এসেছে চারটি জাহাজ। এই চার ট্যাংকার বা তেল পরিবহনকারী জাহাজে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল রয়েছে ৫২ হাজার টন। এসব জাহাজের সয়াবিন তেল আনা হয়েছে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল থেকে।

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার এমটি আরডমোর শায়ানি ও এমটি ডাম্বলডোর নামে দুই জাহাজে বন্দরে আনা হয়েছে ২১ হাজার ৫০০ টন সয়াবিন তেল। মঙ্গলবার বন্দর জলসীমায় পৌঁছেছে এমটি সানি ভিক্টরি ও এমটি জিঙ্গা থ্রেশার নামের আরও দুটি জাহাজ। এই দুই জাহাজে রয়েছে ৩০ হাজার ৬০০ টন সয়াবিন তেল। এর মধ্যে এমটি আরডমোর শায়ানি জাহাজ থেকে তেল খালাস শেষ হয়েছে। সোমবারই জাহাজটি বন্দর ছেড়েছে। জাহাজগুলোর মধ্যে সানি ভিক্টরি এসেছে ব্রাজিল থেকে, বাকি তিনটি আর্জেন্টিনা।

তাহলে ব্যবসায়ীরা আগেই জানতেন যে ৯ ডিসেম্বর তেলের জাহাজ আসবে? এ সুযোগে তাঁরা আরেক দফা দামও বাড়িয়ে নিলেন। অর্থাৎ বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আগের সয়াবিনও বর্ধিত দামে বিক্রি করার মওকা পেলেন।

ব্যবসায়ীরা এ কাজটি সব সময় করে থাকেন। বিদেশ থেকে অপরিশোধিত সয়াবিন এনে এখানে পরিশোধন ও বোতলজাত করা হয়। আমদানি দাম ও পরিশোধন ব্যয় কত পড়ে আর তারা বাজারে সেটি কত দামে বিক্রি করেন, সেটা কি সরকার খতিয়ে দেখেছে? বাংলাদেশে গুটিকয় কোম্পানি ভোজ্যতেল আমদানি করে থাকে। তারাই ইচ্ছেমতো দাম ঠিক করে। এখানে সরকার ও ক্রেতা—দুই পক্ষই অসহায়।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি