১৯৫০ সালে আমাদের র্যাঙ্কিন স্ট্রিটের বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলে তাঁদেরকে দাদার বলতে হতো যে এই বাড়িটি ‘ডিস্ট্রেস সেল’ বা বিপদকালে বিক্রির সময় কেনা নয়।
পূর্ব পাকিস্তানের নতুন মুসলমান অভিজাতদের জন্য এই একটা বিড়ম্বনা ছিল। সারাক্ষণ তাঁদের প্রমাণ দিতে হতো যে বিতাড়িত হিন্দুদের দুর্দশার সময় কোনো জমি তাঁরা দখল করেননি বা কম দামে কেনেননি।
ব্রিটিশ আইসিএস থেকে ১৯৪৭ সালে পিসিএসে (পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস) স্থানান্তরিত সরকারি কর্মচারীদের নতুন পাকিস্তান সরকার ধানমন্ডিতে জমি বরাদ্দ করে।
‘শিয়াল আমার বাচ্চাকে নিয়ে যাবে!’—এই ভয়ে দাদি পুরান ঢাকা থেকে আসতে চাননি। ছোটবেলায় গল্পটা শুনে মজা পেতাম। এখন দ্বিতীয় পঠনে বুঝি, বয়ানটির সারমর্ম হলো ধানমন্ডিতে (বাজারে) কোনো মানুষের বসতি ছিল না। কিছু আদি বাসিন্দা সেখানে ছিল নিশ্চয়। তবে তারা সরকারের কাছে গণনার যোগ্য ছিল না। ‘জমি আমাদের চাই’, সেই চাওয়া পূরণ করতে আগের যেকোনো রেশ অস্বীকার করা প্রয়োজন।
অন্যায্য আইনের ধারাবাহিকতাই ‘শত্রু’ ক্যাটাগরি বারবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। এসব আইন এবং অন্যায়ভাবে এসবের প্রয়োগকারী সংস্থার ক্ষমতা ভেঙে না দিলে এই বিষচক্র আরও ৭৫ বছর ধরে চলতে থাকবে
দেশভাগের সাহিত্য—টোবা টেক সিং (সাদাত হাসান মান্টো, ১৯৫৫), ওয়াতন আউর দেশ (যশপাল সিং, ১৯৬০) এবং কালো বরফ (মাহমুদুল হক, ১৯৭৭)—ভাঙনের সময় পারিবারিক ভাগ্যের নাটকীয় পরিবর্তনের কথা বলে।
এই ভূমিস্বল্পতার ভূগোলে প্রতিবেশীর মন্দির বা মসজিদের আচার-অনুষ্ঠানের চাইতে তার পায়ের নিচের জমির ওপর ছিল আসল নজর। দাঙ্গার মাধ্যমে মানুষকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে তাদের জমির দখল হচ্ছে আমাদের সব মন্বন্তরের ইতিহাসের আসল খেলা। অন্নদাপ্রসাদ রায় তাঁর ‘খুকি ও খোকা’ ছড়ায় একই বিষয় তুলে ধরেন, ‘ভাঙছ প্রদেশ ভাঙছ জেলা/ জমিজমা ঘরবাড়ি।’
পূর্ব পাকিস্তানের নতুন কর্মচারীদের বাসস্থান—যেমনটা আমার দাদার ক্ষেত্রে জুটেছিল—এবং অফিস স্থাপনের জন্য সম্পত্তি অধিগ্রহণের আইন প্রয়োজন হয়। ‘সম্পত্তি রিকুইজিশন আইন’ (১৯৪৮) বিবর্তিত হয়ে আসে ‘ইস্ট বেঙ্গল ইভাকিউজ অ্যাক্ট’ (১৯৫১)। ১৯৬৪ সালে কাশ্মীরে হযরতবাল ঘটনার পর নতুন দাঙ্গার পরে আসে ‘পূর্ব পাকিস্তান বিতাড়িত ব্যক্তি পুনর্বাসন অধ্যাদেশ’। এই নতুন আইনে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্থাবর সম্পত্তি’ হস্তান্তর সীমাবদ্ধ করা হয়। এর পর থেকে বাঙালি হিন্দুরা যেকোনো কারণে পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করতে চাইলে তারা তাদের সম্পত্তির বৈধ বিক্রির ক্ষেত্রেও বাধার সম্মুখীন হয়।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ মাত্র ১৭ দিন চলে; কিন্তু বহু দশক পরও রয়ে যায় তার বিষাক্ত ফল—‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ (১৯৬৫)। জবাবে ভারতও ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ (১৯৬৮) চালু করে। দুই দেশই ‘ওরা তো করে’ খেলায় মেতে ওঠে।
১৯৬৯ সালের নিখিল-পাকিস্তান বিদ্রোহের সফলতার পর সামরিক জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হয়, কিন্তু সরকার সঙ্গে সঙ্গে ‘শত্রু সম্পত্তি (জরুরি বিধানের ধারাবাহিকতা) অধ্যাদেশ’ (১৯৬৯) পাস করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও এ আইন অলৌকিকভাবে টিকে যায় ‘অবিচ্ছিন্নতা প্রয়োগের আদেশ’ (১৯৭১)–এর মাধ্যমে। সব যুগেই এ ধরনের আইন নতুন সরকারের কাজে আসে। যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ।
১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর নতুন এক ‘শত্রু’ জনগোষ্ঠীর পয়দা হয়। ভারত থেকে উদ্বাস্তু ও স্থানান্তরিত পূর্ব পাকিস্তানের উর্দুভাষীরা হয়ে যায় ‘বিহারি’ শত্রু। তাদের অনেকে অবশ্য বিহার থেকে আসেওনি। স্বাধীনতার গৌরব-মুহূর্তের উল্টো পিঠে ছিল উর্দুভাষীদের জমি লুট-দখল। সে দখল বৈধ করতে প্রথমে আসে ‘ভেস্টিং অব প্রোপার্টি অ্যান্ড অ্যাসেটস অর্ডার’ (১৯৭২), তারপর আসে ‘বাংলাদেশ পরিত্যক্ত ভূমি অর্ডার’ (১৯৭২), সবশেষে আসে পরিবর্ধিত ‘অর্পিত এবং অনাবাসী সম্পত্তি আইন’ (১৯৭৪)।
পাকিস্তানে চলে যাওয়া উর্দুভাষী এবং ভারতে চলে যাওয়া হিন্দু বাঙালিদের ‘পরিত্যক্ত’ সম্পত্তি আইনের চোখে একীভূত করা হয়।
অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারি, এসব আইনের মাধ্যমে হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি দখল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আমলে অনেকটা সমানতালে হয়েছে। অবশেষে অর্পিত সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার প্রকল্প শুরু হয় ২০০১ সালে, কিন্তু এই আইনের মন্থরগতি (মূল আইন ২০০১, সংশোধন ২০১১ ও ২০১৩) দেখে বোঝা যায় জমি ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে সব সরকারেরই অনীহা ছিল।
১৯৬০-এর দশকেই পাকিস্তান রাষ্ট্র আরও একটি দুর্বল জনগোষ্ঠীর সন্ধান পায়, যাদের জমি ‘উন্নয়ন’-এর জন্য দখল করা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা জমির মালিকানার জন্য প্রথাগত অধিকারের ওপর নির্ভর করে। সেই রেওয়াজ আধুনিক রাষ্ট্রের হিসাবের খাতায় আসে না। ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি-সমর্থিত কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মিত হওয়ার সময় আদিবাসী গ্রাম এবং চাকমা রাজপ্রাসাদ ডুবে যায়। শুরু হয় আরেক বাস্তুহারার কাহিনি।
আদিবাসীরা তাদের সংকটকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ দেখেছিল, কিন্তু ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে নতুন দেশটির বাসিন্দা শুধু ‘বাঙালি’ বলে সংজ্ঞায়িত করা হলে তারা নতুন ধাক্কা খায়।
১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সরকারের বিপক্ষে প্রথম বিদ্রোহ ছিল সংসদে মানবেন্দ্র লারমার বক্তব্য, ‘কোনো সংজ্ঞা বা যুক্তির অধীনে চাকমা বাঙালি হতে পারে না, বা বাঙালি চাকমা হতে পারে না।’
ক্রমাগত জমিবঞ্চিত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা শান্তিবাহিনীর নেতৃত্বে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ শুরু করে। বিপুলসংখ্যক আদিবাসী এরই মধ্যে ১৯৬৫ সালে কাপ্তাই বাঁধের প্লাবনের পরে ভারতে প্রবেশ করে। শান্তিবাহিনীর গেরিলাযুদ্ধের সময় আরও একগুচ্ছ আদিবাসী ভারতে উদ্বাস্তু হয়, ঠিক যেভাবে ১৯৭১ সালে বাঙালি উদ্বাস্তুর তরঙ্গ এক বিশাল শরণার্থী-সংকট তৈরি করেছিল।
আদিবাসীদের জমি বেদখল দুই প্রধান রাজনৈতিক দল এবং সামরিক আমলে ঘটেছে। সেই অতি পরিচিত স্লোগান ‘তুমি কে? আমি কে? বাঙালি, বাঙালি!’ জোশের তাড়নায় আদিবাসী ও উর্দুভাষীদের মুছে যায়।
২০২৪ সালের ‘রক্তাক্ত জুলাই’-এর ছাত্র অভ্যুত্থান-পরবর্তী ক্ষমতার সাময়িক শূন্যস্থানে সুযোগসন্ধানীদের তাণ্ডব আমরা দেখেছি। প্রতিটি মন্বন্তরের সময় হিংসাত্মক ঘটনার পাশাপাশি আমরা শুনি ‘পাশে দাঁড়ানো’র কাহিনি। পাড়ার মুসলমান নেতা, মাদ্রাসার ছাত্র বা অন্য কোনো একটা গোষ্ঠী তাদের আতঙ্কিত প্রতিবেশীকে রক্ষা করেছে। এই বয়ান শুনে আমরা আশা পাই মানুষ মানুষের জন্য। কিন্তু ক্ষমতালঘু জনগোষ্ঠীকে শুধু ব্যক্তিগত উদ্যোগে রক্ষা করা তো চিরস্থায়ী সমাধান হতে পারে না।
বাঙালি হিন্দু, আদিবাসী, উর্দুভাষী, আহমদিয়া, শিয়া—ক্ষমতায় গৌণ সব সম্প্রদায় এখানকার ৭৫ বছরের ইতিহাসে সবলের ক্ষমতার শিকার হয়েছে। এসব ঘটনা ঘটে থাকে তাদের জমির ওপর নজর রেখেই। অন্যায্য আইনের ধারাবাহিকতাই ‘শত্রু’ ক্যাটাগরি বারবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। এসব আইন এবং অন্যায়ভাবে এসবের প্রয়োগকারী সংস্থার ক্ষমতা ভেঙে না দিলে এই বিষচক্র আরও ৭৫ বছর ধরে চলতে থাকবে।
নাঈম মোহায়মেন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
naeem.mohaiemen@gmail.com
তথ্যসূত্র: ব্লাস্টের সারা হোসেন এবং তোবারক হোসাইন