মতামত

সুদানে জেনারেলদের এই যুদ্ধে কেউ কি জয়ী হবে?

বিমানে বা জাহাজে—যে যেভাবে পারছে, সুদান থেকে পালাচ্ছে। পোর্ট সুদানে জাহাজে চড়তে সারি বেঁধেছে মানুষ। শুক্রবারের ছবি
এএফপি

যে খার্তুম শহর কয়েক দিন আগেও নাগরিক জীবনযাত্রায় গমগম করছিল, সেটি এখন আতঙ্কের শহরে পরিণত হয়েছে। সেখানে এখন ঘন কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে আকাশ ছেয়ে যাচ্ছে। যেখানে-সেখানে পাল্টাপাল্টি গোলাগুলির মধ্যে পড়ে মানুষ মরছে। রাস্তাঘাটে স্কুলগামী শিশুদের আর চোখে পড়ছে না। হাসপাতালগুলো কার্যত অকেজো হয়ে আছে। দোকানপাট বন্ধ। বাসাবাড়িতে পানির সরবরাহ নেই। বিদ্যুৎ নেই। দিন যত যাচ্ছে, মানুষের জীবন তত দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।

কিন্তু হঠাৎ কেন এমন অবস্থার সৃষ্টি হলো?

সুদানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুই জেনারেলের দ্বন্দ্ব কিছুদিন ধরেই প্রকাশ পাচ্ছিল। কিন্তু সর্বশেষ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সেই দ্বন্দ্ব সংঘাতে রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে দেশটির র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) নামক আধা সামরিক বাহিনীকে নিয়মিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করতে রাজি না হওয়া নিয়ে এ দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে।

আরএসএফের নেতৃত্বে আছেন মোহাম্মাদ হামদান দাগালো, যিনি হেমেদতি নামে বেশি পরিচিত। অন্যদিকে নিয়মিত সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে আছেন আবদেল ফাত্তাহ আল বুরহান। বুরহান ও হেমেদতির আজকের এ দ্বন্দ্ব তাঁদের আগের দিনকার ঐক্যের ইতিহাসকে ঢেকে দিয়েছে।

২০২২ সালের ডিসেম্বরে সুদানের সামরিক ও বেসামরিক নেতারা একটি রূপরেখা চুক্তিতে সই করেছিলেন, যাতে উভয় পক্ষ সামরিক শাসনের অবসানে একমত হয়েছিল এবং নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বিশালসংখ্যক সেনা ও অস্ত্র জোগাড় করতে সক্ষম হওয়া আরএসএফের আগ্রাসী ভূমিকা শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি বাস্তবায়ন করার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চলতি মাসের শুরুতে খার্তুম ও অন্যান্য কয়েকটি অঞ্চলের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত মেরোবি শহরে আরএসএফ সেনা মোতায়েন করে। সুদানের সেনাবাহিনী বলছে, তাদের অনুমোদন না নিয়েই আরএসএফ সেখানে ঘাঁটি গেড়েছে।

এরপরই খার্তুমে সংঘাত-সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। বিমানবন্দর ও সেনাসদর দপ্তরের মতো কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে গোলাগুলি চলতে থাকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত দ্য ফোর্সেস অব ফ্রিডম অ্যান্ড চেঞ্জ (এফএফসি) আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় সুদানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলোচনা করেছিল। সেই আলোচনায় ঠিক হয়েছিল, ভোটের মাধ্যমে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া হবে।

চলমান এ সংঘাত সম্পর্কে এফএফসি বলছে, ‘রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করার এবং সাবেক সেনাগোষ্ঠীকে স্থায়ীভাবে পুনরায় গদিতে বসানোর পরিকল্পনা থেকে এ সংঘাতের পরিকল্পনা করা হয়েছে।’ তারা ‘এ যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং সাবেক শাসক চক্রকে পুনরায় ক্ষমতায় বসানোর পরিকল্পনার বিরুদ্ধে’ সুদানের জনগণকে এক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

ঈদের সময় সুদানি নাগরিকেরা যাতে ঈদের নামাজ আদায় করতে এবং জরুরি মানবিক প্রয়োজন মেটাতে পারে, সে জন্য আরব লিগ একটি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছিল। সেটি যদি সফল হতো, তাহলে মিলমিশের একটি গঠনমূলক আলোচনার সূত্রপাত হতে পারত। কিন্তু ঈদের দিনও সমানে গোলাগুলি হয়েছে এবং খার্তুমের বিভিন্ন জায়গায় বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে।

এখন হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত সেখানে চার শতাধিক লোক নিহত এবং সাড়ে তিন হাজারের বেশি লোক আহত হয়েছে। খার্তুমের রাস্তায় মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। গোলাগুলির কারণে লোকজন ঘর থেকে বের হতে পারছে না। মানবিক অবস্থা বিপর্যয়কর অবস্থায় চলে গেছে। কয়েক দিনের মধ্যেই দুই-তৃতীয়াংশ হাসপাতালের সেবা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ সুদান থেকে তাদের নাগরিক ও দূতাবাসকর্মীদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।

সুদানের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিবদমান পক্ষগুলোকে অস্ত্রবিরতি করতে এবং রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে যাওয়া–আসার সুযোগ করে দিতে অনুরোধ জানিয়েছে। কিন্তু কোনো পক্ষই শান্ত হচ্ছে না। খার্তুমে আটকে পড়া বাসিন্দারা পানি ও বিদ্যুতের অভাবের পাশাপাশি খাদ্যসংকটে পড়ে ভয়ানক অবস্থায় রয়েছেন। দোকানপাট, এমনকি ওষুধের দোকানও খোলা পাওয়া যাচ্ছে। গত সপ্তাহে দুই পক্ষ ২৪ ঘণ্টার একটি অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দিলেও তা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই উভয় পক্ষ লঙ্ঘন করে এবং সেই লঙ্ঘনের জন্য তারা পরস্পরকে দোষারোপ করেছে।

হেমেদতি ও বুরহান—উভয়েই নিশ্চিতভাবে জানেন, এভাবে সামরিক লড়াইয়ের মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কোনো সমাধানসূত্র বের করতে পারবেন না। তারপরও তাঁরা পরস্পরকে দুর্বল করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন, যাতে আলোচনার টেবিলে নিজেদের বড় স্বার্থ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

ভৌগোলিক ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে জটিলতা আছে, তার জন্য চলমান এ সংঘাতে সহজে জয়-পরাজয়ে পৌঁছানো খুব সহজ হবে না। এ লড়াই এমন একটি রাজধানী শহরে বেড়ে চলেছে, যার মেট্রো এলাকায় লাখ লাখ বেসামরিক লোক বসবাস করে। এই লোকদের ক্ষতি এড়ানোর চেষ্টা করে সামরিক ঘাঁটি নিশানা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ।

যুদ্ধ যত তীব্র হবে, ততই সংঘাতের কঠোর ও বহুস্তরীয় প্রভাবগুলো দৃশ্যমান হতে থাকবে। ইতিমধ্যেই খার্তুম ও অন্য শহরগুলোতে ব্যাপকসংখ্যক লোক ভিটেবাড়ি থেকে অন্যত্র পালিয়ে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতি একটি মহা অনিশ্চয়তার দিকে চলে গেছে এবং ভঙ্গুর অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সেনাবাহিনী, আরএসএফ ও সুদানি জনগণের সমন্বয়ে গঠিত একটি ত্রিপক্ষীয় শক্তি দরকার, যা তিনটি পক্ষকে একটি সমঝোতার জায়গায় আনতে ভূমিকা রাখতে পারে। এই সমীকরণ থেকে সুদানি নাগরিকদের অনুপস্থিতি একটি ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করছে বলে মনে হয়। সুদানের জনগণের পক্ষে কথা বলার মতো একটি শক্তিশালী সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদল দরকার। টেকসই শান্তির পথে পা বাড়ানোর জন্য সেটি থাকতেই হবে। আঞ্চলিক পক্ষগুলোকেও একটি ঐক্যবদ্ধ সুদানি উদ্যোগকে কাজে লাগাতে হবে এবং তা টিকিয়ে রাখতে হবে।

ঈদের সময় সুদানি নাগরিকেরা যাতে ঈদের নামাজ আদায় করতে এবং জরুরি মানবিক প্রয়োজন মেটাতে পারে, সে জন্য আরব লিগ একটি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছিল। সেটি যদি সফল হতো, তাহলে মিলমিশের একটি গঠনমূলক আলোচনার সূত্রপাত হতে পারত। কিন্তু ঈদের দিনও সমানে গোলাগুলি হয়েছে এবং খার্তুমের বিভিন্ন জায়গায় বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে।

বোঝা যাচ্ছে, অনিবার্যভাবেই এ যুদ্ধে কোনো পক্ষই জয়ী হবে না, হার হবে সুদানের জনগণের। সুদানের যে জাতীয় সম্পদ দেশটিকে ধ্বংস ও টুকরা টুকরা করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা দেশটিকে উন্নত করে গড়ে তোলার কাজে ব্যয় করা উচিত—এ বোধ দুই পক্ষ ও সাধারণ সুদানিদের মধ্যে জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত সংকট সমাধানের আশা খুবই কম।

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • ওসামা আবুজাইদ খার্তুমের উন্নয়ন ও প্রশাসনবিষয়ক গবেষক। তিনি বর্তমানে ফ্রান্সের অর্থায়নে পরিচালিত ও মিসরে কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংস্থা সিইজেডইজের হিউম্যান সিকিউরিটি প্রজেক্টের প্রকল্প সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্বরত