খরার প্রভাবে শুষ্ক হয়ে মাটি ফেটে গেছে। নানচ্যাং অঞ্চল, জিয়াংশি প্রদেশ, চীন।
খরার প্রভাবে শুষ্ক হয়ে মাটি ফেটে গেছে। নানচ্যাং অঞ্চল, জিয়াংশি প্রদেশ, চীন।

মতামত

বিলীন ভূমি পুনরুদ্ধার আর খরা মোকাবিলায় কতটা এগোলাম

দুই মেরুর বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে। নাসার তথ্য বলছে, অ্যান্টার্কটিকার বরফ প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন টন এবং গ্রিনল্যান্ডের বরফ প্রতিবছর গড়ে প্রায় ২৭০ বিলিয়ন টন হারে গলে যাচ্ছে। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং জীবিকা উন্নয়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ, যার জলজ্যান্ত উদাহরণ।

জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর আন্তসরকারি প্যানেলের (আইপিসিসি) ভাষ্যমতে, কম ফসল উৎপাদনশীলতার পরিস্থিতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।

বর্তমান হারে বৈশ্বিক উষ্ণতা অব্যাহত থাকলে দেশের ১৭ শতাংশ মানুষকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করতে হবে। ঢাকার বস্তিতে ৮১ শতাংশ অভিবাসী বাস্তুচ্যুত হওয়ার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন-সম্পর্কিত কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।

শুধু তা-ই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে আগামী ৪০ বছরে বাংলাদেশে ৩ মিলিয়ন থেকে ১০ মিলিয়ন মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে স্থানান্তরিত হবেন বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ২০০৫ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা বার্ষিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হবে।

যদিও বর্তমান সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ২০০৯ সালে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের ‘জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন’ করেছে, যার মাধ্যমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের নানামুখী সাফল্য অর্জনের দাবি করা হচ্ছে।

বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির ভবিষ্যদ্বাণীগুলো একের পর এক ফলে যাচ্ছে।

২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরের ক্ষত শুকানোর আগেই বাংলাদেশের সমগ্র উপকূলীয় এলাকা ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে আবারও লন্ডভন্ড হয়ে যায়।

এরপর বেশ কয়েক বছর বিরতি দিয়ে সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানার পর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ১৯টি জেলার ১১৯টি উপজেলা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

রিমালের তাণ্ডবে সরকারিভাবে যে ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাতে উপকূলীয় ১১৯টি উপজেলার ৯৩৪টি ইউনিয়নের প্রায় ৪৬ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

এ ছাড়া রিমালের পরপর দুই দিনের তাণ্ডবে প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।

এর মধ্যে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৫২৮টি ঘরবাড়ি আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ৪০ হাজার ৩৩৮টি। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঢাল সুন্দরবন না থাকলে এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কী হতো, তা কল্পনার বাইরে।

এসব পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে ‘আমাদের জমি, আমাদের ভবিষ্যৎ’ স্লোগান সামনে রেখে এ বছর সৌদি আরবের রিয়াদে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদ্‌যাপিত হচ্ছে।

দেশটি ২০২৪ সালের পরিবেশ দিবসটির মূল থিম ‘ভূমি পুনরুদ্ধার এবং খরা ও মরুকরণের বিরুদ্ধে অভিযোজন’-এর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে, যা সমগ্র বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে।

একইভাবে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির মূল থিম ঠিক রেখে বাংলাদেশ এবার ‘করব ভূমি পুনরুদ্ধার, রুখব মরুময়তা—অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা’ স্লোগান সামনে রেখে দেশব্যাপী পালন করছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস।

ক্রমবর্ধমান ভূমির অবক্ষয়, মরুকরণ এবং খরার সম্মুখীন একটি জাতি হিসেবে সৌদি আরব বহুবিধ সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন খাতে গভীরভাবে বিনিয়োগ করছে।

সৌদি গ্রিন ইনিশিয়েটিভ এবং মিডল ইস্ট গ্রিন ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে সৌদি আরব জাতীয়, আঞ্চলিক ও বিশ্বব্যাপী কাজ করে চলেছে।

যেমনটি আমরা দেখেছি, যখন ২০২০-এর জি-২০ সম্মেলনে ‘সৌদি প্রেসিডেন্সি গ্লোবাল ল্যান্ড রিস্টোরেশন ইনিশিয়েটিভ’ গৃহীত হয়েছিল।

মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই এখন জি-২০ দেশগুলোর, যারা বিশ্ব জিডিপির ৮৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে এবং পৃথিবীর মোট ভূমি এলাকার প্রায় অর্ধেক দখল করে রেখেছে।

এ বছর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসের পর ১৭ জুন পালিত হবে ৩০তম ‘মরুকরণ এবং খরা দিবস’, সেখানে আমাদের উত্তরাধিকার ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভূমি রক্ষার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে ৪টি ফুটবল মাঠের সমান জমি ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে, যা যোগ হয়ে বছরে প্রায় ১০০ মিলিয়ন হেক্টরে পরিণত হচ্ছে।

তার মানে, এ বছর পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য বা ভূমি পুনরুদ্ধারের দাবিটি মরুকরণ এবং খরা দিবসেরও জোরালো দাবিতে পরিণত হয়েছে।

মোটকথা, জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট এখন আর নির্দিষ্ট কোনো সমস্যা হিসেবে সীমাবদ্ধ নেই, এটি এখন বিশ্বসংকট হিসেবে স্থায়ী রূপ নিচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে আইপিসিসি উল্লেখ করেছে যে বাংলাদেশ কতটা অর্থনৈতিক ও অ-অর্থনৈতিক ক্ষতি বহন করছে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে প্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার পরিবার এবং ২ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি নষ্ট হয়ে গেছে।

এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর আন্তসরকারি প্যানেল (আইপিসিসি) ঐকমত্য যে ১৯৫০-এর দশক থেকে ইতিমধ্যেই উল্লেখযোগ্য জলবায়ু পরিবর্তন ঘটেছে এবং সম্ভবত এই শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্বব্যাপী গড় পৃষ্ঠের বায়ুর তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৪ থেকে ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে আইপিসিসি উল্লেখ করেছে যে বাংলাদেশ কতটা অর্থনৈতিক ও অ-অর্থনৈতিক ক্ষতি বহন করছে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে প্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার পরিবার এবং ২ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি নষ্ট হয়ে গেছে।

কৃষিজমির ক্ষয়ক্ষতির ফলে ফসল উৎপাদন ব্যর্থ হওয়ার ফলে ২০১৪ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে চালের দাম ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়।

একই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, নদীভাঙন, লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ এবং খরার ফলেও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ফসলের বিপর্যয় ঘটছে।

এ ছাড়া মৎস্য ও সামুদ্রিক প্রজাতির বিলুপ্তি, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধন, ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং জীবিকার বিকল্প উৎসগুলোও হ্রাস পেয়েছে; যা উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলছে।

অন্যদিকে মরুকরণকে যেহেতু কোনো একক মেট্রিক দ্বারা চিহ্নিত করা যায় না, তাই ভবিষ্যতে কীভাবে এর অবনতির হার পরিবর্তিত হতে পারে, তার অনুমান করাও কঠিন।

এ ছাড়া এর অসংখ্য আর্থসামাজিক চালিকা শক্তি রয়েছে, যা এই পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে। উদাহরণস্বরূপ, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মরুকরণের দ্বারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা সম্পূর্ণভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

২০৫০ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে শুষ্ক ভূমিতে বসবাসকারী জনসংখ্যা ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৪ বিলিয়ন হবে বলে অনুমান করা হয়েছে।

মরুভূমির দেশ সৌদি আরব, বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী আয়োজিত এবারের ৫২তম বিশ্ব পরিবেশ দিবসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সফল হোক।

পাশাপাশি জীবিকা ও ভূমিহারা সংকটাপন্ন মানুষেরা তাঁদের অধিকার ফিরে পাক এবং জলবায়ু দুর্যোগ মোকাবিলায় আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হোক।

  • এম এম মাহবুব হাসান ব্যাংকার ও উন্নয়ন-গবেষক
    ই-মেইল: mmmahbubhasan111@gmail.com