আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একমত যে কালোটাকাকে সাদা না করলে কালো বা ছায়া অর্থনীতিকে মূলধারার অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যাবে না। তবে এটাও বুঝতে হবে, কেন আমাদের মতো দেশে কালো বা ছায়া অর্থনীতি দিন দিন এত বড় হচ্ছে? কালোটাকাকে এভাবে সাদা করার প্রক্রিয়া কত দিন থাকা উচিত? এতে কী লাভ কিংবা কবে আমাদের এই প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণ লাগাম টানতে হবে?
আমাদের আরও জানতে হবে, ছায়া বা কালো অর্থনীতির মূল কুশীলবেরা কেন অপেক্ষাকৃত কম কর দিয়েও তাঁদের লুকিয়ে রাখা আয় বা সম্পদ সামনে আনছেন না বা মূলধারায় সম্পৃক্ত হতে উৎসাহিত বোধ করছেন না। যদিও কালো আর ছায়া অর্থনীতির মধ্যে কিছুটা ফারাক আছে, তবু আমরা বিভিন্ন দেশি সমীক্ষা বা বিদেশি গবেষণায় জানতে পেরেছি, বাংলাদেশে ছায়া বা শ্যাডো অর্থনীতির আকার মূল বা সাদা অর্থনীতির ৩০ থেকে ৮৫ শতাংশ।
আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি, অন্যান্য বছরের বাজেটের মতো ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেটেও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে। স্থাবর সম্পত্তি, যেমন ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট কর এবং নগদসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করা যাবে। এমনকি দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক না কেন, এ ক্ষেত্রে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের প্রশ্ন তুলতে পারবে না। অন্যদিকে বৈধ আয়ে সর্বোচ্চ করারোপ করা হয়েছে ৩০ শতাংশ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার এ পন্থায় অতীতে খুব বেশি সাড়া পাওয়া যায়নি বা যায় না।
এনবিআরের তথ্যানুসারে, কালোটাকা সাদা করার ঘোষণার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে অপ্রদর্শিত প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা বৈধ করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ কালোটাকা সাদা হয়েছিল ২০২০–২১ অর্থবছরে—প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
ওই সময় ১০ শতাংশ করারোপ করা হয়। এক অর্থবছরে এত বিশাল অঙ্কের টাকা সাদা হওয়ার পেছনে অন্যতম একটি কারণ ছিল করোনার প্রভাব। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও যোগাযোগ শৈথিল্যের কারণে অর্থ পাচার হতে পারেনি; দেশের অভ্যন্তরেই সরাসরি বিনিয়োগ করা হয়।
কালোটাকা সাদা করার ধারাবাহিকতায় ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেটে এক বছরের জন্য পাচার করা টাকা ৭ শতাংশ হারে কর দিয়ে দেশে ফেরত আনার আইনি সুযোগ দেওয়া হয়। তবে অর্থবছর শেষে দেখা যায়, এতে কোনো লাভ হয়নি।
স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সরকার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে। কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। বরং এসব উদ্যোগ নিয়মিত করদাতাদের প্রতি অন্যায্য সিদ্ধান্তকে প্রতিফলিত করে এবং কর প্রদানে নিরুৎসাহিত করে বলে খোদ সরকারের মধ্যেও অনেকে মনে করেন।
কালোটাকা সাদা করার এমন সুযোগ পৃথিবীর অন্য অনেক দেশেও আছে। তবে সফল কেবল তারাই হতে পেরেছে, যারা এর মাধ্যমে কর ফাঁকি ও অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক আপসে যায়নি।
কালোটাকা সাদা করার বিষয়টি আমাদের এখানে সব সময়ই বিতর্কিত। এবারও এটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। তবে বিতর্ক থাকলেও নির্মম বাস্তব হচ্ছে, কালো বা ছায়া অর্থনীতি অনেক সময় আমাদের মূল বা আনুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অর্থায়নেও সাহায্য করে কিংবা আপৎকালে ভোগব্যয়ের চাকাকে সচল রাখে।
বাংলাদেশ বৈধ করদাতাদের ওপর একদিকে বেশি টাকা করারোপ করছে, অন্যদিকে বিনা প্রশ্নে কম হারে অপ্রদর্শিত অর্থকে বৈধ করার সুযোগ দিচ্ছে। আগেই বলেছি, এ উদ্যোগের পেছনে সবচেয়ে জোরালো যুক্তি হলো অপ্রদর্শিত অর্থ মূলধারার অর্থনীতিতে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া।
এ সুযোগ না দেওয়া হলে আরও অর্থ পাচার হয়ে যাবে বলে কেউ কেউ মনে করেন। কিন্তু অর্থ পাচার বন্ধ না হলে আদৌ কি সামষ্টিক অর্থনীতিতে রাজস্বপ্রবাহ বাড়ানো সম্ভব?
সব উদ্যোগেরই পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকে। তবে এটির সপক্ষে যে যুক্তি, তা কেবল সরকারের আর্থিক অব্যবস্থাপনাকে স্পষ্ট করে, তেমন সুফল বয়ে আনে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আসার বদলে অর্থ পাচারের পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) পরিসংখ্যানমতে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ২০০৯-১৫ সময়ে অন্তত ৮২৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে ৯১ হাজার কোটির বেশি। অর্থাৎ কেবল পণ্য আমদানিতে অধিক মূল্য ও পণ্য রপ্তানিতে কম দাম দেখানোর মাধ্যমে এ পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে ওই সময়।
অবশ্য টাকা পাচার পরিমাপের কোনো সর্বজনীন পদ্ধতি বা আন্তর্জাতিক মাপকাঠি না থাকায় টাকা পাচারের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরাও মুশকিল। কিন্তু সংখ্যাটি যে বেশ বড়, তাতে কারোই কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
কালোটাকা সাদা করার বিষয়টি আমাদের এখানে সব সময়ই বিতর্কিত। এবারও এটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। তবে বিতর্ক থাকলেও নির্মম বাস্তব হচ্ছে, কালো বা ছায়া অর্থনীতি অনেক সময় আমাদের মূল বা আনুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অর্থায়নেও সাহায্য করে কিংবা আপৎকালে ভোগব্যয়ের চাকাকে সচল রাখে।
২০০৭-০৮ সময়ে ও করোনাকালে, এমনকি বর্তমান সময়েও আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। তবে এই অর্থের বেশির ভাগ আন্ডার ইনভয়েসিংয়ে ব্যবহৃত হয় বলে এতে সরকার অতি প্রয়োজনীয় রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে সৎ করদাতা বা আমদানিকারকদের জন্য নীতি-গ্লানি সৃষ্টি হয়।
বিরাট কালো এমনকি ছায়া অর্থনীতির কোনো দেশ বেশি দিন তার সম্ভাবনাকে বা সম্মানের স্থান ধরে রাখতে পারে না। উন্নয়ন অর্থায়নও তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে। দেশে বৃহৎ আন্তর্জাতিক কোম্পানির বিনিয়োগও পিছিয়ে যায়।
সে ক্ষেত্রে উত্তম পথ হচ্ছে অভিনব পদ্ধতিতে এবং জোরের সঙ্গে কালো বা ছায়া অর্থনীতির বিকাশকে রোধ করা, সরকারের সব সম্পদ ক্রয়-বিক্রয়ে মূল্যের যৌক্তিকীকরণ, করহার হ্রাস করে সবাইকে কর প্রদানে উৎসাহিত করা, কর ফাঁকির বিরুদ্ধে শক্ত ও নিষ্ঠুর অবস্থান এবং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি।
মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক