ইসরায়েলের দর্প যেভাবে চূর্ণ করল ফিলিস্তিনিরা

হামাসের রকেট হামলার পর ইসরায়েলের রেহবত শহর থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়
ছবি: রয়টার্স

ফিলিস্তিনিদের আচমকা জ্বলে ওঠাকে ইসরায়েলের জন্য বিশাল সামরিক ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক বিপর্যয় বলা যেতে পারে। মাত্র কদিন আগেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দম্ভভরে বলে এসেছেন, ইসরায়েলকে কেন্দ্র করে তাঁরা আরব অংশীদারদের নিয়ে নতুন একটি মধ্যপ্রাচ্য গড়বেন। 

বেনিয়ামিন তাঁর কল্পিত নতুন মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র থেকে ফিলিস্তিনকে পুরোপুরি মুছে ফেলেছিলেন। কিন্তু সেই দম্ভোক্তির রেশ কাটতে না কাটতেই ফিলিস্তিনিদের আকস্মিক আক্রমণ তাঁর ও ইসরায়েলের ওপর রাজনৈতিক ও কৌশলগত বড় আঘাত হয়ে নেমে এসেছে। 

মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস শেষ পর্যন্ত ইসরায়েল ও তার বদমেজাজি নেতাদের ভড়কে দিয়েছে। এসব নেতা বহুদিন ধরে নিজেদের অজেয় ভেবে এসেছেন এবং বারবার তাঁরা তাঁদের শত্রুপক্ষকে অবজ্ঞার চোখে দেখে এসেছেন।

ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিতভাবে গাজা থেকে অগ্নিবাণের মতো রকেট ছুড়েছে। জল-স্থল-অন্তরিক্ষ থেকে একযোগে হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের সামরিক ও বেসামরিক অবস্থান নিশানা করে তারা হাজার হাজার রকেট ছুড়েছে। এতে দুই শতাধিক ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হয়েছেন। হামাসের হাতে কয়েক ডজন ইসরায়েলি সেনা ও বেসামরিক লোক বন্দী হয়েছেন। হামাসের এই হামলার উদ্দেশ্য মোটেও গোপন কিছু নয়।

প্রথমত, এই হামলার মধ্য দিয়ে হামাস ইসরায়েলের দখলদারি, উৎপীড়ন, অবৈধ বসতি এবং ফিলিস্তিনিদের ধর্মীয় প্রতীক, বিশেষ করে আল–আকসা মসজিদকে অপবিত্র করার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই অঞ্চলে বর্ণবাদী শাসন জারি রাখা ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিরোধিতার একটি জোরালো বার্তা দিতে চেয়েছে হামাস। 

হামলার সর্বশেষ লক্ষ্য হলো, ইসরায়েলি কারাগার থেকে যতটা সম্ভব ফিলিস্তিনি রাজবন্দীদের মুক্ত করার জন্য আরেক দফা বন্দিবিনিময় নিশ্চিত করা। 

স্মরণ করা যেতে পারে, গাজা উপত্যকার হামাস নেতা ইয়াহিয়া আল সিনওয়ার ইসরায়েলের কারাগারে দুই দশকের বেশি বন্দী থাকার পর বন্দিবিনিময়ের মাধ্যমে ছাড়া পেয়েছিলেন।

এর আগে ইসরায়েলের হামলায় অন্য অনেক ফিলিস্তিনির মতো হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মাদ দেইফ অনেক স্বজন হারিয়েছেন। দেইফের স্ত্রী, তিন বছরের শিশুকন্যা ও বছরখানেক বয়সী এক পুত্র সন্তানকে ইসরায়েলি সেনারা হত্যা করেছিল। ফলে এই হামলার পেছনে শাস্তিমূলক ও প্রতিশোধমূলক দিকও রয়েছে। সেই দিক থেকে দেখলে হামাসের হামলাটি অবিশ্বাস্য রকম মর্মান্তিক হওয়া সত্ত্বেও তা খুব কমই আশ্চর্যজনক ছিল।

মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস শেষ পর্যন্ত ইসরায়েল ও তার বদমেজাজি নেতাদের ভড়কে দিয়েছে। এসব নেতা বহুদিন ধরে নিজেদের অজেয় ভেবে এসেছেন এবং বারবার তাঁরা তাঁদের শত্রুপক্ষকে অবজ্ঞার চোখে দেখে এসেছেন।

১৯৭৩ সালের ‘আকস্মিক’ আরব হামলার পর থেকে ইসরায়েল তার দ্বারা নিপীড়িত শক্তিগুলোর প্রত্যাঘাতে বারবার ধাক্কা খেয়েছে এবং ভয় পেয়েছে। ১৯৮২ সালে ইসরায়েল লেবাননে হামলা চালানোর পর লেবাননের দিক থেকে প্রচণ্ড প্রত্যাঘাত আসায় তারা ঠিক এমনিভাবে হকচকিত হয়ে পড়েছিল। ১৯৮০ ও ২০০০ সালের ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদার সময় ইসরায়েল ধাক্কা খেয়েছে।

ইসরায়েলি দখলদারি–পরবর্তী ৫০ বছরের বেশি সময় গাজা যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে ইসরায়েল অনেকবারই ধাক্কা খেয়েছে। এটি এখন সবার কাছে স্পষ্ট, ইসরায়েলের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্ব হামাসের এই হামলার কথা ভাবতেই পারেনি। এটি ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও সামরিক ব্যর্থতার প্রতিনিধিত্ব করে। 

ইসরায়েলের হাতে সুদক্ষ গুপ্তচর, সর্বাধুনিক ড্রোন ও নজরদারি প্রযুক্তির নেটওয়ার্ক থাকা সত্ত্বেও তারা আক্রমণের বিষয়টি আগেভাগে জানতে পারেনি। তাই প্রতিরোধও করতে পারেনি। তবে এই ক্ষতি ইসরায়েলের সামরিক ও গোয়েন্দা পরিসর ছাপিয়ে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় বয়ে এনেছে। স্বঘোষিত অপরাজেয় রাষ্ট্রটি যে ভেতরে-ভেতরে কতটা অরক্ষিত, দুর্বল ও শৌর্যবীর্যহীন এবং মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক নেতৃত্বদানে কতটা অযোগ্য, তা হামাসের হামলা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। 

ভয়ে-আতঙ্কে বাড়িঘর ও শহর ছেড়ে পতঙ্গের মতো ইসরায়েলিদের ছুটে পালানোর ছবি আগামী বহু বছর সামগ্রিকভাবে ইসরায়েলিদের স্মৃতিতে চেপে বসে থাকবে। আজ যেটি ঘটে গেছে, তা সম্ভবত ইসরায়েলিদের ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ দিন। এটিই সম্ভবত তাদের সবচেয়ে অপমানের দিন। 

ফিলিস্তিনিরা আজ পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের অপমানের উত্তর দিতে পারে। ইসরায়েলকে এই সত্য থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত

মারওয়ান বিশারা আলজাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক