মানজুর-আল-মতিনের কলাম

স্বৈরাচারীর সাইবার বাহিনী, গুজব ও সামনের লড়াই

সত্যের চেয়ে মিথ্যার কাটতি বেশি। বাস্তবতার চেয়ে গুজবের চল বেশি। এটা বুঝে নেওয়ার জন্য ফেসবুকের প্রয়োজন হয় না। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে কিংবা ইতিহাস ঘেঁটে মানুষের এ অভ্যাস বুঝে নেওয়া চলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বোধ করি ব্যাপারটা আরও বেশি করে চোখে পড়ে।

ধরুন, যেকোনো একটা বিষয় নিয়ে একটা পোস্ট দেওয়া হলো। তাতে হয়তো বেশিসংখ্যক মানুষ ইতিবাচক মন্তব্য করলেন। দু–একজন করলেন নেতিবাচক মন্তব্য। তাতে আবার অন্যদের আঁতে ঘা লাগল। তাঁরা দিলেন খুব করে এই নেতিবাচক মন্তব্যের জবাব। তাতে দিন শেষে নেতিবাচক মন্তব্য নিয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনা হলো। সেটাই থেকে গেল সবার ওপরে।

এর পেছনে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর হাত কতটা, তাদের গুরুত্ব বেছে নেওয়ার যে ব্যবস্থা তার ভূমিকা কতটা, সে নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে বিশ্বজুড়েই। পাশের দেশ ভারতেই গত নির্বাচন ঘিরে ফেসবুক ঘৃণা ছড়িয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে নেতিবাচকতা, হতাশা ও ঘৃণা বেশি ছড়াবে, তাতে বোধ করি অবাক হওয়ার কিছু নেই।

জুলাই অভ্যুত্থান ঘিরে এ অভিজ্ঞতা আমাদের হাড়ে হাড়ে হয়েছে। আমরা দেখেছি, সেসময় রাতগুলোতে স্বৈরাচারী দলের লোকেরা কীভাবে গুজবের বন্যা বয়ে দিয়েছিল। যার কারণে সেসব রাতকে ‘লাইলাতুল গুজব’ নাম দিয়ে আমাদের জেন-জিরা সেই দুঃসহ সময়ের স্মৃতি ফেসবুকের দেয়ালে দেয়ালে ধরে রেখেছে।

এই উত্তাল সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে আমাদের নিঃসন্দেহে উভয়সংকটে পড়তে হয়েছে। প্রথমত, যখন মূলধারার গণমাধ্যম নির্বিচার হত্যার ঘটনাগুলো বেমালুম চেপে গিয়েছিল, তখন খবর পাওয়ার প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

সেখানে নৃশংস হত্যার ছবি যেমন আমরা দেখেছি, তেমনি ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার সুপরিকল্পিত প্রচারণাও আমাদের সামনে এসেছে। সেখানে ভয় ছড়ানো হয়েছে দুপক্ষের জন্যই। আওয়ামী লীগের সমর্থককে বলা হয়েছে, স্বৈরাচার হাসিনা সরে গলে তাদের আর রক্ষা নেই। সবাইকে কচুকাটা করা হবে। তাই বোধ করি ৫ আগস্ট বিকেলেও কিছু নরপিশাচ গুলি চালাতে কসুর করেনি।

অন্যদিকে দেশের বাকি সবাইকে ভয় দেখানো হয়েছে—হাসিনা না থাকলে দেশ রসাতলে যাবে, এত দিনের ‘উন্নয়ন’ সব শেষ হয়ে যাবে, দেশে সংস্কৃতিচর্চা বন্ধ হয়ে যাবে, মেয়েদের বোরকা পরতে বাধ্য করা হবে।

সমস্যা হলো, জুলাই অভ্যুত্থানের আগে–পরে মিলে একটা বড়সংখ্যক মানুষ তথ্যের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। মূলধারার গণমাধ্যমও যে আস্থা তৈরি করার মতো আচরণ সব সময় করছে, তা–ও নয়। ধরুন, যে টিভি এক ঘণ্টা আগেও স্বৈরাচার হাসিনার গুণকীর্তন করেছে, যে উপস্থাপক সব স্বাভাবিক বলে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছেন, তারাই যদি একটু পরে ভোল পাল্টে তারেক রহমানের ভাষণ প্রচার ও পুনঃপ্রচার শুরু করে, তাহলে লোকে ভিরমি খাবে বৈকি। এখানে আস্থা ফিরিয়ে আনা যেমন একটা আশু প্রয়োজন, তেমনি কাজটা করা বলার চেয়ে বিস্তর কঠিন।

বিজয়ের পরও এই ভয় দেখানোর লোকেরা হাল ছাড়েনি। শুনি, এই বিপুল সাইবার বাহিনীর সবাই আমাদের মতো রক্ত–মাংসের মানুষ নয়। একটু কড়ি ছড়ালে প্রযুক্তির ব্যবহারে অনেক কৃত্রিম অ্যাকাউন্ট তৈরি করে ফেলা যায়, যারা মানুষ সেজে এই ভয়, গুজব ও মিথ্যা ছড়ানোর কাজ করে চলে।

মাঝেমধ্যে মনে হয়, এই সাইবার বাহিনী মনুষ্য পদবাচ্য না হওয়ায় তাদের পলাতক স্বৈরশাসকের হালহকিকতের খোঁজ রাখতে পারেনি। তাই এখনো হাল না ছেড়ে দেদার মিথ্যা ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে।

সমস্যা হলো, জুলাই অভ্যুত্থানের আগে–পরে মিলে একটা বড়সংখ্যক মানুষ তথ্যের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। মূলধারার গণমাধ্যমও যে আস্থা তৈরি করার মতো আচরণ সব সময় করছে, তা–ও নয়।

ধরুন, যে টিভি এক ঘণ্টা আগেও স্বৈরাচার হাসিনার গুণকীর্তন করেছে, যে উপস্থাপক সব স্বাভাবিক বলে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছেন, তারাই যদি একটু পরে ভোল পাল্টে তারেক রহমানের ভাষণ প্রচার ও পুনঃপ্রচার শুরু করে, তাহলে লোকে ভিরমি খাবে বৈকি। এখানে আস্থা ফিরিয়ে আনা যেমন একটা আশু প্রয়োজন, তেমনি কাজটা করা বলার চেয়ে বিস্তর কঠিন।

এই উভয়সংকটে থেকে মাথা ঠান্ডা করে সঠিক তথ্য খুঁজে পাওয়া দুরূহ। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এর বিকল্প কিন্তু আমরা জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্যেই খুঁজে নিয়েছি। এত তাড়াতাড়ি আমাদের বিস্মৃত হওয়ার কথা নয় ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার দিনগুলোর কথা। নাকি ভুল বললাম? ইন্টারনেট তো নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল! সে সময় আমরা সবাই পথে নেমেছিলাম। যাঁরা একেবারেই নামতে পরেননি, তাঁদের খুব কাছের কেউ পথে ছিলেন।

পথে নেমেই আমরা টের পেয়েছি দেশ কোন পথে। রাস্তায় যিনি রিকশা চালান, লোকাল বাসে যে মানুষটা আমার পাশে বসে কিংবা মেট্রোরেলে যারা আমরা একসঙ্গে বাঁদরঝোলা হয়ে যাতায়াত করি, তাদের মুখের দিকে তাকালেই কিন্তু দেশের খবর আপনি পাওয়া যায়। পাসওয়ার্ড দিতে হয় না।

ফেসবুকের এমন স্বাধীনতা না চাওয়ার হতাশা থেকে ‘লগআউট’ করে যখন ভাদ্রের তপ্ত রোদে রাস্তায় হাঁটি, তখন একটা মুক্ত হাওয়ার ঝাপটা লাগে। আমি আমার দেশের মানুষের মুখে হাসি দেখি, দেখি নতুন আশায় পথ চলার সংকল্প। সমস্যা নেই, এ কথা কেউ বলবে না। শুধু ১৫ বছর কেন, এ দেশের বহু সমস্যা তার চেয়েও ঢের পুরোনো।

পুরোপুরি ভেঙে পড়া পুলিশি ব্যবস্থা থেকে বিচারব্যবস্থা মাস গড়াতে ঠিক হয়ে যাবে, এমন যদি কেউ ভেবে থাকে, তবে তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হোক। কিন্তু যখন দেখি হঠাৎ অবাক করা উপহারের মতো দূর আরবে বন্দী ভাইয়েরা আবারও সূর্যের দেখা পান, বুকটা আশায় ভরে ওঠে। যখন সংস্কারের জন্য যোগ্য আর আস্থার মানুষগুলোকে বেছে নেয় এই অভ্যুত্থান থেকে উঠে আসা সরকার, তখন নিরাশ হওয়ার কারণ খুঁজে পাই না।

এই সরকার বহু শহীদের আত্মদানের সরকার। হাজারো আহত মানুষের ত্যাগের সরকার। এই সরকার রাস্তায় নেমে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা কোটি মানুষের সরকার। তাই এই সরকারের ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। তারা ভুল করলে যেমন আমরা ধরিয়ে দেব, তেমনি নিজেরাও মাঠে থাকব। একটা সময় ছিল, যখন দেশের জন্য নতুন কিছু ভাবাও বাতুলতা মনে হতো। জুলাই বিপ্লবের বিপুল আত্মদানের মাধ্যমে আমরা আবারও স্বপ্ন দেখার অধিকার পেয়েছি। সে স্বপ্ন নতুন এক দেশের।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের হাজারো মিথ্যা প্রচারণার একটাই উদেশ্যে, আমাদের আবারও ভয় পাইয়ে দেওয়া। সেই ‘ভয় দেখানো ভূতের’ সর্বনাশ আমরা ৫ আগস্টেই করে দিয়েছি। তার কাছে ফিরে যাওয়ার বোকামি আমরা করতে পারি না। সামনের লড়াইটা দীর্ঘ, দুরূহ, সন্দেহ নেই। কিন্তু আশা ও বিশ্বাসের শক্তি তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি।

  • মানজুর-আল-মতিন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী