টাইম ম্যাগাজিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সম্ভাবনার নতুন যুগ’ শীর্ষক এ বিশেষ সংখ্যার সন্নিবেশিত লেখাগুলোর ওপর ভিত্তি করে প্রথম আলোর জন্য ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ইশতিয়াক মান্নান। মূল লেখার সারাংশ, ভাষান্তর ও প্রাসঙ্গিক তথ্য-ব্যাখ্যা যুক্ত করেছেন তিনি। আজকের মূল লেখাটি লিখেছেন সিমোন শাহ ও লিন্ডা মার্সা। আগামী সপ্তাহের লেখা, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: পাল্টে যাচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞান।’
মোটামুটি সবাই আমরা বুঝতে পারছি, এআই কোনো না কোনোভাবে সামনের দিনগুলোতে বিপণন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সফটওয়্যার ডেভেলপার কিংবা আইনজীবী—প্রায় সব পেশারই কাজের সনাতন ধারাকে বদলে দেবে। ঠিক কীভাবে, কেমন করে বদলাবে, সে ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা করা যাচ্ছে না বলে আমাদের অস্বস্তিটা বেশ গভীর।
গোল্ডম্যান স্যাকস বলছে, এআই সারা পৃথিবীতে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন কাজকে চাপের মধ্যে ফেলবে, যদিও ‘বোস্টন কনসালটিং গ্রুপ’ দেখাচ্ছে যে এই প্রভাব এখন পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্বের একেবারে উঁচুতলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ৮০ শতাংশ এক্সিকিউটিভ কাজের ক্ষেত্রে নিয়মিত জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করলেও সামনের সারির কর্মীদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ এই প্রযুক্তির সাহায্য নিচ্ছেন। খারাপ খবর হচ্ছে, যে কাজগুলো এআইয়ের কারণে হুমকির মুখোমুখি, তার বেশির ভাগই এখন মেয়েরা করছেন।
বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এআইএর গতিপ্রকৃতি বোঝা ও এআই–সংক্রান্ত দক্ষতা অর্জন এবং সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত বিনিয়োগের একটা মরিয়া চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। লিংকডইন লার্নিং বলছে, কাজের ধারাগুলোকে আরও উন্নত আরও চৌকস করতে এআইএর জন্যও এটা একটা চমৎকার সুযোগ ও সম্ভাবনা।
‘ম্যাকিনজি’র জরিপ বলছে, আগে যেমনটা ভাবা হয়েছিল, তার চেয়ে দ্রুততার সঙ্গে কর্মী পর্যায়ে এআইয়ের প্রভাবজনিত পরিবর্তনগুলো দেখা যাবে। একজন কর্মীর মোট কর্মসময়ের প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রেই এআই টুলগুলোর ব্যবহার প্রচলিত হবে এবং ২০৪৫ সালের মধ্যে কর্মীদের দৈনন্দিন কাজের প্রায় অর্ধেকই এআই নিয়ে নিতে পারে।
এআই প্রভাবিত এই পরিবর্তন, মানবসভ্যতা বিকাশের ইতিহাসে এর আগে যেসব বড় ধরনের প্রযুক্তিগত বিপ্লব ঘটেছিল (যেমন স্টিম ইঞ্জিন), সেগুলোর চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ, এখন এআই সেসব কাজকে বেশি প্রভাবিত করছে, যেগুলো জ্ঞান বা বুদ্ধিবৃত্তিক এবং স্বভাবতই এই কাজগুলোতে শিক্ষাগত যোগ্যতার দরকার এবং পারিশ্রমিকও তুলনামূলকভাবে বেশি।
এই প্রভাবের লক্ষণটা আমরা এখনই দেখতে পাচ্ছি। এত দিন যেমন করে ইন্টারনেটে সার্চ ইঞ্জিন (যেমন গুগল) বা ওয়ার্ড প্রসেসর (যেমন মাইক্রোসফট ওয়ার্ড) ব্যবহার করতাম, এখন বেশি বেশি জেনারেটিভ এআই টুল (যেমন চ্যাটজিপিটি) ব্যবহার করা হবে বা করতে হবে। কারণ, এআইভিত্তিক টুলগুলো কাজের বিস্তৃতি ও কার্যকারিতা—দুইই বাড়িয়ে দিচ্ছে। জেনারেটিভ এআই আসার আগে ইন্টারনেট ঘেঁটে তথ্য জোগাড় করে, বিশ্লেষণ করে তারপর আপনাকে যে লেখা দাঁড় করতে হতো, এখন চ্যাটজিপিটিকে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেই সে নিমেষে আপনাকে সব কটি কাজ প্রায় নির্ভুলভাবে করে দিচ্ছে।
এমআইটির গবেষণা বলছে, চিঠিপত্র বা গুরুত্বপূর্ণ ই–মেইল লেখা যাঁদের কাজের উল্লেখযোগ্য অংশ, চ্যাটজিপিটি ব্যবহারের ফলে তাঁদের কাজ করতে পারার পরিমাণ ও ক্ষমতা বেড়ে গেছে। চ্যাটবট সহকারী ব্যবহার করে সময় বেঁচে যাচ্ছে ৪০ শতাংশ এবং কাজের গুণগত মানও বেড়েছে ১৮ শতাংশ।
‘স্ট্যানফোর্ড ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান সেন্টার্ড এআই’–এর গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সামনের সারির অপেক্ষাকৃত তরুণ কর্মীদের জন্য এআই বেশ উপকারী এবং তাঁদের মধ্যে দ্রুত কাজ বদলানোর প্রবণতাও কমেছে। নিয়মিত বা পুনরাবৃত্তি হয়, আগে থেকে ধারণা করা যায় কিংবা সুনির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ড মেনে চলে—এ ধরনের কাজগুলো দ্রুত নিয়ে নিচ্ছে এআই।
গবেষকেরা বলছেন, ব্যাপারটা এমন না যে এআই মানুষের জায়গা নিয়ে, মানুষকে প্রতিস্থাপিত করে পুরোপুরি একটা যন্ত্রনিয়ন্ত্রিত কর্মস্থল তৈরি করে ফেলছে। কেন্দ্রীয় ভূমিকায় মানুষের উপস্থিতি ও প্রয়োজনীয়তা এখনো মুখ্য। এআই বরং মানুষের সঙ্গে মানুষের জন্য কাজ করে তার উৎপাদন ও উদ্ভাবনক্ষমতা বহু গুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
একটা বিষয় বোঝা জরুরি, এআইএর ব্যবহার এখন শুধু খুব প্রাগ্রসর সামরিক মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম বা জিন প্রযুক্তিতেই সীমাবদ্ধ নয়; যেকোনো প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ বিভাগের সামনের সারির যে কর্মীর কাজ শত শত চাকরিপ্রার্থীর জীবনবৃত্তান্ত বাছাই করা কিংবা কল সেন্টারের যে কর্মী সারা দিন ফোনকলের জবাব দেন, তাঁরাও সমানতালে তাঁদের নিজ নিজ কাজে এআই ব্যবহার করতে পারেন।
একটা কল সেন্টারের প্রায় পাঁচ হাজার কাস্টমার সাপোর্ট এজেন্টের মধ্যে করা গবেষণায় দেখা গেছে, এআই পেছনে থেকে কাস্টমারদের সঙ্গে এজেন্টদের সব কথাবার্তা শুনে, তার প্যাটার্ন নির্ধারণী দক্ষতা দিয়ে কার্যকর ও অকার্যকর আলাপগুলোর কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো নতুন বা অনভিজ্ঞ কর্মীদের জন্য খুবই উপকারী। কারণ, এআই এ–ও বলে দিচ্ছে, কাস্টমারের কোনো সমস্যার সবচেয়ে ভালো সমাধান কী, কোন শব্দ ব্যবহার করলে সহজবোধ্য হবে, এমনকি কোন কণ্ঠে কিংবা স্বরপ্রক্ষেপণে কথা বললে বেশি কাজ হবে বা কাস্টমার খুশি হবে। এআই ছাড়া লক্ষাধিক ঘণ্টার এই সব আলোচনা ঘেঁটে মানুষের পক্ষে এই প্যাটার্ন বোঝা অসম্ভব।
চাকরিদাতাদের মধ্যেও এআই ক্রমশ একটা প্রয়োজনীয় দক্ষতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ওয়েবভিত্তিক ক্যারিয়ার সাইটগুলো লক্ষ করেছে, প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে নিয়োগকারীরা চ্যাটজিপিটি ব্যবহারের দক্ষতাকে একটা কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা হিসেবে দেখছেন। এগুলোর সব কটিই যে প্রযুক্তিবিষয়ক কোম্পানি, তা নয়; তারপরও এআই–বিষয়ক দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা আপনার জীবনবৃত্তান্তকে আকর্ষণীয় করবে।
যত তাড়াতাড়ি এআই ব্যবহার শিখতে পারবেন, সামনের দিনের কাজের বাজারে আপনি ততো কম ভুগবেন, সে যেকোনো ধরনের কাজই হোক না কেন। এই দৌড়ে আপনাকে অংশগ্রহণ করতেই হবে, নইলে সভ্যতার অগ্রযাত্রা থেকে ছিটকে পড়তে পারেন।
সারা বিশ্বেই এআই নিয়ে নানা ধরনের ডিগ্রি, ডিপ্লোমা, স্বল্পমেয়াদি নানা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কোর্স চালু হয়েছে এবং নিত্যনতুন চালু হচ্ছে। এর মধ্যে ফিনল্যান্ডভিত্তিক ‘মিন্নালার্ন’–এর ‘এলিমেন্টস অব এআই’ খুব জনপ্রিয়। এটা ছক বা প্রবণতা (প্যাটার্ন) ও সম্ভাব্যতার (প্রবাবিলিটি) মতো এআইয়ের মৌলিক বিষয়গুলো বোঝার ওপর জোর দেয়।
তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেহেতু এআই প্রযুক্তি দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তাই শিক্ষার্থীরা যদি বনিয়াদি বিষয়গুলো বোঝেন, তাহলে প্রযুক্তির ক্রমাগত পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে দক্ষতাকে ব্যবহার করতে পারবেন। শুধু যেকোনো একটা অ্যাপ্লিকেশনকেন্দ্রিক দক্ষতা অর্জন করলে তা দীর্ঘ মেয়াদে প্রাসঙ্গিক না–ও থাকতে পারে।
‘মিন্নালার্ন’–এর কোর্সগুলো করতে কোনো খরচ নেই এবং কোনো প্রাগ্রসর গণিত বা প্রোগ্রামিংয়ের অভিজ্ঞতাও দরকার নেই। এখন পর্যন্ত ১৭০টি দেশ থেকে ১০ লাখের বেশি মানুষ এই অনলাইন কোর্সগুলোতে যুক্ত হয়েছেন। আপনি যদি কাজের জন্য কোনো বিশেষায়িত কোর্স করতে চান, সেগুলো অবশ্য পয়সা দিয়ে করতে হবে।
কেউ যদি এএআইএর কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয় শিখতে চান, তাহলে ‘লিংকডইন লার্নিং’ দেখতে পারেন (সচরাচর আমরা যে লিংকডইন ব্যবহার করি, তারই শিক্ষা শাখা)। তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক মিলিয়ে শতাধিক কোর্স আছে এখানে।
মাসিক মাত্র ২০ মার্কিন ডলারে আপনি এর সদস্য হতে পারেন কিংবা কোনো একটা কোর্সের জন্যও পয়সা দিতে পারেন। আপনি যেন আপনার সময়–সুযোগমতো কোর্স করতে পারেন, তাই এগুলোকে খুব ছোট ছোট (যেমন পাঁচ মিনিট) অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে।
‘অ্যালফাবেট’ ও তাদের ‘গুগল ক্লাউড স্কিলস বুস্ট প্ল্যাটফর্ম’–এর মাধ্যমে অনেকগুলো কোর্স চালু করেছে।
এসবের পাশাপাশি হার্ভার্ড বা পেনসিলভানিয়ার মতো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ডেটাবিজ্ঞানী নন, এমন মানুষদের জন্য খুব কম খরচে বা বিনা পয়সায় ভালো ভালো কোর্স চালু করেছে। ‘কোরসেরা’ বা ‘অ্যাডেক্স’–এর কোর্সগুলো করলে আপনি এআই–বিষয়ক সার্টিফিকেটও পেতে পারেন।
হয়তো আপনার কাজের জায়গায় এখনো এআইএর ব্যবহার শুরু হয়নি কিংবা আপনার সংস্থার নেতৃত্বের মধ্যে এআইয়ের ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে ধারণা পরিষ্কার নয়। এ ধরনের কোর্সগুলো আপনার কাজের জায়গায় এআই ব্যবহারের সুযোগগুলো খুঁজে বের করতে এবং সে সম্ভাবনার ব্যাপারে নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে আলোচনার সূচনা করতে ও তাঁদের বুঝিয়ে রাজি করাতে আপনাকে সাহায্য করবে।
প্রায় প্রতিটি কাজেই এআই ব্যবহার করা যেতে পারে। ধরা যাক, একটা মাধ্যমিক স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষকেরা আলোচনায় বসেছেন, ছাত্রছাত্রীদের কী ধরনের উদ্ভাবনী পরীক্ষা দেওয়া যেতে পারে, যেগুলো তাদের বিজ্ঞানের নির্দিষ্ট জ্ঞান অর্জন হলো কি না, তা যাচাই করবে।
অনেকে মিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা না করে ‘চ্যাটজিপিটি’কে জিজ্ঞেস করলেই ভালো ভালো প্রস্তাব পাওয়া যাবে কিংবা হয়তো কোনো কিছু প্রচার–প্রসারের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেওয়া দরকার, এআই আপনাকে চাহিদামতো ৫০টা পোস্ট নিমেষেই তৈরি করে দিতে পারে। আপনি চাইলে সে আপনার জন্য কোম্পানির নিউজলেটারগুলোও তৈরি করে দিতে পারে।
বাংলাদেশেই এখন বইয়ের প্রচ্ছদসহ অন্যান্য নকশা করা হচ্ছে ‘টেক্সট টু ইমেজ’ অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে। লেখক নিজেই চাইলে তাঁর বইয়ের বিষয়বস্তু বা চাহিদা এআইকে বলে দিয়ে মনমতো প্রচ্ছদ করিয়ে নিতে পারেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমরা এখন যেমন কোনো চিন্তা না করেই ক্যালকুলেটর ব্যবহার করি, সামনে এআইও এমনি নিত্যব্যবহার্য প্রযুক্তিতে পরিণত হবে।
এআইকে নির্দেশ দেওয়ার সময় একটা পার্থক্য মাথায় রাখা দরকার। গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিনকে আপনি যেভাবে নির্দেশ দেন, এআইকে সেই নির্দেশ দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না।
তথ্য চাইলে যেকোনো সার্চ ইঞ্জিনই তা আপনাকে দিতে পারে। যে কাজে আপনাকে চিন্তা করতে হবে, মাথা খাটাতে হবে, এআইকে সে ধরনের কাজ করতে ব্যবহার করুন। শেষে কী ফলাফল চান, সেটা মাথায় রেখে এআইকে নির্দেশ দিন।
যাঁরা জেনারেটিভ এআই নিয়ে আগ্রহী, তাঁদের জন্য পরামর্শ হচ্ছে, ‘চ্যাটজিপিটি’, ‘ডাল.ই’ বা ‘বার্ড’–এর মতো বিনা খরচের অ্যাপ্লিকেশনগুলো নাড়াচাড়া করতে শুরু করুন। এভাবেই আপনি নিজের মতো করে নিজের জন্য এগুলোর সম্ভাবনার প্রাথমিক ধারণা পেয়ে যাবেন।
‘মিন্নালার্ন’–এর কোর্স করেছেন, এমন একজন বলছেন, তিনি এখন মিটিংয়ের আলোচ্যসূচি তৈরি করা, কোনো লেখার ব্যাকরণ ঠিক আছে কি না, এ ধরনের কাজ এআইকে দিয়ে দিচ্ছেন, ‘আমি আমার অনেক কাজের ৮০ শতাংশ করে ফেলতে পারছি মাত্র ২০ শতাংশ সময়ে।’
ইশতিয়াক মান্নান আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বিশেষজ্ঞ