আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার একটা গল্প বলেন। তিনি বলেন যে তিনি কখনো স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় কোনো ইভেন্টে জয়লাভ করেননি। কোনো দিন তিনি কোনো খেলায় জিতে কোনো পুরস্কার পাননি। একবারই পেয়েছিলেন। পেছনে হাঁটা প্রতিযোগিতা হয়েছিল। স্কুলে পেছনের দিকে হাঁটার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তিনি সগৌরবে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন।
পুরস্কার হিসেবে বালক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ লাভ করেন একটা চামচ। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বলেন, সেই চামচটা নিয়ে আমি পৃথিবীকে মাথায় তুলতাম। যখন তাঁর শিক্ষক পিতার কাছে কোনো মেহমান আসতেন, তিনি সেই ঘরে ঢুকতেন। হাতে থাকত একটা গেলাস আর সেই চামচ। তারপর তিনি সেই চামচটা গেলাসে নেড়ে নেড়ে যতটা পারা যায় তীব্রভাবে শব্দ উৎপাদন করতেন। কেন? কারণ, মেহমান যেন তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, খোকা, তুমি চামচ নাড়ছ কেন?
যদি অতিথি এই প্রশ্ন করেই বসেন, তাহলে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ উত্তর দেবেন, হে হে হে, এই চামচ যে-সে চামচ নয়, এ-ই হলো সেই চামচ, যা আমি প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করে পুরস্কার হিসেবে পেয়েছি।
কাজেই পুরস্কার খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। পুরস্কারসামগ্রী যত সামান্যই হোক না, এটা পেতে ভালো লাগে। তবে হুমায়ুন আজাদ একটা মহামূল্যবান কথা বলে গেছেন, পুরস্কার হলো প্রেমের মতো, জীবনে কিছু আসা ভালো, কিন্তু বেশি এলে তা লাম্পট্য বলে পরিগণিত হয়।
এখন এই যে পুরস্কার হিসেবে কী পেলাম, যেমন একটা প্লাস্টিকের চামচ দিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ জগৎটাকে মাথায় তুলেছিলেন, তা নিয়ে আমাদের কিছু বলবার আছে।
আমার কাছে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার হলো বই। আপনি চামচ দেন, ক্ষয়ে যাবে, জগ-মগ দেন, ভেঙে যাবে, বাটি-গেলাস দেন, ফুটো হয়ে যাবে, কিন্তু বইখানা অনন্তযৌবনা, রয়ে যাবে। আপনি কাউকে ১০০ টাকার কিছু একটা দিলেন, তা ১০০ টাকাই। আপনি ১০০ টাকার একটা বই কিনে দেন, সেই বই প্রাপকের হৃদয় চিরদিনের জন্য পাল্টে দিতে পারে, বই হলো আলোর পরশমণি, বইয়ের ছোঁয়ায় সবকিছু আলোকিত হয়ে ওঠে, সবচেয়ে বেশি আলোকিত হয় হৃদয়।
আজকাল যেখানেই যাই, একটা করে ক্রেস্ট ধরিয়ে দেয়। এ এক ভয়াবহ আপদ আপনি সেধে গিয়ে ডেকে আনলেন। লোকে ভালোবেসে দিয়েছে, ফেলে দিতে পারছেন না, কিন্তু এটা রাখবেন কোথায়? আপনার বাড়িতে তো জায়গা নেই যে আপনি ক্রেস্ট রাখবেন। আপনার দোহাই লাগে, আপনি আমাকে বই দিন।
ক্রেস্ট নয়, বই। ভয় পাবেন না, সৈয়দ মুজতবা আলীর সুন্দরীর মতো আমি বলব না, বই, ও তো ওর একটা আছে! আপনি আমাকে যে বই দেন, তা যদি আমার কাছে আগে থেকেই থেকে থাকে, আমি তবুও ওই বই পরম আগ্রহে গ্রহণ করব। অনেকগুলো বইয়ের একাধিক কপি আমার কাছে আছে। সঞ্চয়িতা, সঞ্চিতা, জীবনানন্দ দাশ, গল্পগুচ্ছ, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, আনিসুজ্জামান স্যারের বইগুলোর দুটো-তিনটে করে কপি আমি রেখে দিই। কোনোটা বইয়ের তাকে, কোনোটা টেবিলে, কোনোটা বিছানার পাশে। এরপরেও যদি বই বেশি হয়, তা লাইব্রেরিকে দান করে দেয়া যায়।
আরেকটা কথা বলি, বই কিনুন। পড়তে হবে না। প্রতি মাসে ঝাঁকা ভরে বই কিনে আনুন। বই আমরা সব সময় পড়ি না। কিন্তু অনন্তযৌবনা বই কুড়ি বছর পরে হাতে নিলেও তা বুড়ি হয় না। দিব্যি আগের মতোই পড়া যায়।
দেখা গেছে, বহু বই আমি ১০ বছর পড়ি না, একদিন কাজে লাগছে, গোগ্রাসে গিলছি। এরপরেও যদি জীবনে পড়া না হয়, আমি মারা যাওয়ার পর উত্তরসূরিরা পড়বে। আর উত্তরসূরি না থাকলে পাড়ার লাইব্রেরিকে বই দান করে যাব।
এইবার একটা সত্যিকারের গল্প বলি। বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক লেভেলে চাকরি করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক লেভেলে উপদেশ দেন। বিতর্ক করতেন। তখন তাঁর বয়স ৩০-এর কোঠায়। একদিন শাহবাগে এক ফুলের দোকানে তাঁর সঙ্গে দেখা হলো, সেই নব্বইয়ের দশকে। বললাম, আপনি কেন এসেছেন এই দোকানে? তিনি একটা রজনীগন্ধার স্টিক দেখিয়ে বললেন, আমি রোকেয়া হলে বিতর্কের বিচারক হিসেবে গিয়েছিলাম। ওরা আমাকে ভালোবেসে এই ফুল দিয়েছে। এটা তো আমি রাস্তায় ফেলে দিতে পারি না। আবার এটা আমি বাসাতেও নিয়ে যেতে পারব না, কারণ আপনার ভাবি এই ফুল দেখে কী বলবে ভাবতে পারছি না, রোকেয়া হলের মেয়েরা দিয়েছে তো। তাই এটা বিক্রি করতে এসেছি। তিনি সত্যি সত্যি তিন টাকা দিয়ে সেই রজনীগন্ধার স্টিকটা বিক্রি করে দিলেন।
তা-ই বলি, ফুল নয়, ক্রেস্ট নয়, বই দিন। স্কুলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়, বার্ষিক পুরস্কার বিতরণীতে, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের বই দিন। ক্রেস্ট নয়, থালাবাসন নয়, বই। বই মানুষের ভাগ্য চিরদিনের জন্য ইতিবাচকভাবে বদলে দিতে পারে। বিল গেটস সব সময় বই পড়েন। বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে লেখা চিঠিতে টুথপেস্ট চাননি, সাবান চাননি, কয়েল চাননি, চেয়েছেন বই। আমার ছোটবেলায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলাম নাসির আলীর লেখা শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা। ক্লাস এইটে পেয়েছিলাম সঞ্চয়িতা, গল্পগুচ্ছ, দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন। বুয়েটে শহীদ স্মৃতি হলে পুরস্কার পেয়েছিলাম মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচনাবলী। এসব না পেয়ে ক্রেস্ট বা ফ্লাস্ক পেলে কী হতো?
ক্রেস্ট নয়, বই। ঘটি-বাটি নয়, বই। পুরস্কার হিসেবে বই দিন। উপহার হিসেবে বই দিন। আর কেউ বই দিলে খুলে দেখবেন। আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটাকে নিয়ে যখন কবিতা লিখলাম, সে পাত্তা দিল না, আমাকে একটা বই দিয়েছিল, এনালাইটকাল মেকানিকস। খুলে দেখিনি। বহুদিন পরে সে এসেছিল, বলেছিলাম, পাত্তা দাওনি কেন। সে বলল, কেন পাত্তা দেব না। বই দিয়েছিলাম না? হ্যাঁ। ও বই আমি খুলে দেখিনি।
দেখোনি ভালোই করেছ। বইয়ের মধ্যে একটা চিঠি ছিল।
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমি দেখলাম, তার বয়স হয়ে গেছে, দাঁত পড়ে গেছে। কিন্তু যদি সে আমাকে একটা গীতবিতান দিত, তার কি আর বয়স হতো। বই যে অনন্তযৌবনা!
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক