আসলে রাজধানী ঢাকায় জলাবদ্ধতা নতুন কোনো বিষয় নয়। মাত্র ঘণ্টাখানেকের ভারী বৃষ্টিতেই পরিণত হয় পানির নগরীতে।
আসলে রাজধানী ঢাকায় জলাবদ্ধতা নতুন কোনো বিষয় নয়। মাত্র ঘণ্টাখানেকের ভারী বৃষ্টিতেই পরিণত হয় পানির নগরীতে।

ঢাকার রাস্তাগুলো কেন নদী হয়ে যায়

‘টানা বৃষ্টি হলেই মহানগরীগুলোতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। পথ-ঘাটগুলো কূলকিনারাহীন নদী হয়ে যায়। যাঁরা বাড়িঘর, মার্কেট নির্মাণ করেন, তাঁরা কি রাজউকের নির্দেশ শতভাগ মানেন?’ জলাবদ্ধতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্টে এভাবেই লেখেন চন্দ্রশিলা। জলাবদ্ধ এলাকার ছবি জুড়ে দিয়ে তিনি আরও লেখেন, ‘দেশের মানুষেরা কি যত্রতত্র পলিথিন, পানির বোতল, ময়লা ফেলা বন্ধ করেছেন? দায় কিন্তু সব রাষ্ট্রের একার হয় না, প্রতিটি মানুষের দায়দায়িত্ব থাকতে হয়। কারণ, সমস্যা হলে ভোগ করতে হয় প্রতিটি মানুষকেই।’

হাসিব বাবু ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘জলাবদ্ধতা নিয়ে গত দুই দিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ স্ট্যাটাস দেখলাম! আচ্ছা, ঢাকায় যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা তাহলে ফেলে কারা?’ এই পোস্টে দুই ঘণ্টার মধ্যে নিচে মন্তব্য পড়েছে ৩৬টি এবং দুজন শেয়ার করেছেন। নাজমুস শাহাদাত নামের এক ব্যক্তি মন্তব্য করেন, ‘রাস্তার পাশে যতগুলো দোকান, সব দোকানের ময়লা ঝাড়ু দিয়ে রাস্তায় ফেলে, মনে হয় রাস্তাটা একটা ডাস্টবিন! আর অলিগলিতে তো মূর্খ ভাড়াটিয়ারা প্যাকেটভর্তি ময়লা-আবর্জনা ছুড়ে ফেলে, পরে সেগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কি যে অবস্থা হয়, বলে বোঝানো সম্ভব না।’

আসলে রাজধানী ঢাকায় জলাবদ্ধতা নতুন কোনো বিষয় নয়। মাত্র ঘণ্টাখানেকের ভারী বৃষ্টিতেই পরিণত হয় পানির নগরীতে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত শুক্রবার সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় ঢাকায় বৃষ্টি হয়েছে ৬০ মিলিমিটার। এরপরও অবশ্য হয়েছে, তবে তা ভারী বৃষ্টি ছিল না। কিন্তু সকালের বৃষ্টিতেই ধানমন্ডি, গ্রিন রোড, নিউমার্কেট, মতিঝিল, আরামবাগ, কাজীপাড়া, রোকেয়া সরণি, দক্ষিণখান, কল্যাণপুর, বিজয় সরণি, মালিবাগ, মৌচাকসহ রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকার সড়ক ডুবে যায়। অনেক বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকেছে। কোথাও পানি ছিল হাঁটুসমান, কোথাও প্রায় কোমরসমান। রাস্তায় গাড়িগুলোকে দেখা যায় রীতিমতো সাঁতরাতে।

আর এ জলাবদ্ধতার জন্য আমরা সরকার, মেয়র তথা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সবচেয়ে বেশি দায়ী করে থাকি।

ফেসবুক থেকে শুরু করে এ দুর্ভোগ নিয়ে মিডিয়া নানা আলোচনা-সমালোচনা করি, লেখালেখি করি।

এত এখন ফেসবুক কিংবা মিডিয়ায় আলোচনা হচ্ছে, গত চার বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে কমপক্ষে ৭৩০ কোটি টাকা খরচ করেছে। কিন্তু এর সুফল কতটা পাওয়া গেছে, তা শুক্রবার সকালের তিন ঘণ্টার বৃষ্টি দেখিয়ে দিয়েছে। গত ২৬ জুন ঢাকায় ৩ ঘণ্টায় ৬১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। সেদিনের বৃষ্টিতে ঢাকার অনেক এলাকার সড়কে পানি জমে থাকতে দেখা গেছে।

আমি মনে করি, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যতই দায়ী করি না কেন, এটা মানবসৃষ্ট বেশি। কারণ, আমাদের প্রতিদিন ব্যবহৃত ময়লা, প্লাস্টিক, পলিথিন ডাস্টবিনে না ফেলে ফেলছি রাস্তার। এ ময়লা, প্লাস্টিক, পলিথিন বৃষ্টির পানি সঙ্গে ড্রেনে পড়ে আবর্জনায় পূর্ণ হচ্ছে। গত কয়েক দিনে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, এর পানি যদি যথাযথভাবে ড্রেন দিয়ে না সরতে পারে, তাহলে তো রাস্তাগুলো নদী হবেই। আমি স্বীকার করি, ঢাকার মেয়রদের আরও বেশি সচেতন হওয়ার দরকার ছিল।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টা মাথায় নিয়ে এখন পরিকল্পনা করতে হবে। কেননা এখন ঘন ঘন বৃষ্টি হচ্ছে, অসময়েও। এ ছাড়া হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, অনতিবিলম্বে ঢাকার নদীগুলোর সীমানা নির্ধারণ করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। সংসদ সদস্য ও ওয়ার্ড কাউন্সিলররা তাঁর এলাকার জলাভূমি রক্ষার দায়িত্বে থাকবে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোর কাছে তাঁরা দায়বদ্ধ থাকবে।

এবার আসি আমাদের কথায়। এই জলাবদ্ধতার জন্য আমরা কতটা দায়ী? আমাদের করণীয় কী? শুধু সরকার আর মেয়রকে দোষ দিয়ে যাচ্ছি, আমরা কি সরকার বা মেয়রদের কথা মানছি? আমরা কি আইন মানি? আমাদের ওপর কি আইনের প্রয়োগ করা হয়? দায়িত্বরত কর্মকর্তারা কি দায়িত্ব পালন করছেন? নাহ! কেউ কিছুই মানছি না। শুধু একে ওপরের ওপর দোষ দিয়ে যাচ্ছি।

আপনি স্টুডেন্ট, অথচ আপনি ক্লাসে শিখছেন একটা, ক্লাসের বাইরে এসে করছেন আরেকটা! তেমনি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সৌন্দর্য বর্ধনের সঙ্গে যুক্ত ডেপুটি রেজিস্ট্রার ইব্রাহিম খলিল তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘আমরা কবে সভ্য হব? বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত পরিমাণ ময়লার বিন স্থাপন এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের দ্বারা নিয়মিত পরিষ্কার করার পরও ক্যাম্পাসকে ময়লা-আবর্জনা থেকে মুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।’ আপনি নিজেই আপনার ক্যাম্পাসকে সুন্দর রাখতে পারেন না।

ময়লা-আবর্জনায় সব সিঁড়ি থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের ফুলগাছের টবে পর্যন্ত ফেলে রাখেন। কেউ কিছু বললে বলেন, ‘মামা (ক্লিনার) আছে পরিষ্কার করার জন্য!’ হুম, বলতে পারেন, তার সঙ্গে ঢাকার জলাবদ্ধতার সম্পর্ক কোথায়? লেখাটা ছোট হলেও গভীরতা অনেক বেশি। শুধু সেবা সংস্থাগুলোই নয়, নাগরিক হিসেবে প্রতিটি মানুষের কিছু দায়িত্ববোধ রয়েছে। আমরা ময়লা-আবর্জনাগুলো নিজ দায়িত্বে নির্দিষ্ট জায়গা ফেলতে পারি। কিন্তু সেটা না করে রাস্তার এখানে-সেখানে কিংবা ড্রেনের মধ্যে ফেলে দিই। ড্রেন ছাড়া তো এলাকার পানি নিষ্কাশনের বিকল্প কিছু নেই।

নগর-পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ সবুজ এলাকা এবং ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাশয়-জলাধার থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) গবেষণার দেখা গেছে, ১৯৯৫ সালে ঢাকা শহরে সবুজ এলাকা ও ফাঁকা জায়গা ছিল ৫২ বর্গকিলোমিটারের বেশি। এখন সেটি প্রায় ৪৩ শতাংশ কমে ৩০ বর্গকিলোমিটারের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ১৯৯৫ সালে ঢাকা শহরের মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি ছিল জলাভূমি। এখন তা মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ। গত তিন দশকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট জলাভূমির প্রায় ৮৬ শতাংশ ভরাট করা হয়েছে। বিআইপি গবেষণাটি করেছে গত বছরে, অর্থাৎ ২০২৩ সালে। এই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে একদিকে সবুজ আচ্ছাদিত এলাকা ও জলাশয় কমেছে, অন্যদিকে কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ বেড়েছে। গত তিন দশকে (১৯৯৫ সালের পর থেকে) ঢাকায় কংক্রিটের আচ্ছাদন প্রায় ৭৬ শতাংশ বেড়েছে।

এ তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, আমাদের জলাভূমি অধিকাংশ ভরাট হয়ে আছে। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই বিভিন্ন সড়কে পানি জমে যায় হাঁটুসমান। ওয়াসা থেকে সিটি করপোরেশন খালগুলো বুঝে পাওয়ার পর কিছু এলাকায় সমস্যার সমাধান হলেও এখনো জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পায়নি মানুষ। দুই সিটি করপোরেশন বলছে, কিছু কিছু এলাকায় এখন বিভিন্ন উন্নয়নকাজ চলমান। যার কারণে ড্রেনগুলো দিয়ে পানি সড়তে না পারায় পানি জমে থাকছে। অন্যদিকে স্থায়ীভাবে কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে পরিকল্পিত সড়ক ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকার কারণে। তবে এসব এলাকায় কুইক রেসপন্স টিম কাজ করে যাচ্ছে বলে সিটি করপোরেশন থেকে জানানো হয়।

ভাবতে কষ্ট লাগে, যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী ‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’-এর জরিপে বসবাসযোগ্য শহর হিসেবে বিশ্বের ১৭৩টি শহরের মধ্যে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান ১৬৮। এ দায় কার? একবার ভেবে দেখুন, পলিথিন, খাবারের প্যাকেট ও প্লাস্টিকের বোতলগুলো আমরা কোথায় ফেলছি? গৃহস্থালি বর্জ্য আমরা কোথায় ফেলছি? এ ব্যাপারে আমাদের ভাবতে হবে।

আপনি আমি যখন ঘুরতে বেড়াতে যাই, তখন পানি পান করে বোতলটা রাস্তায় ফেলতে দ্বিধা বোধ করি না। আবার চিপস খেয়ে খালি প্যাকেট কোথায় ফেলতে হবে, তা জানি না। সত্যি কথা, আমরা এখন উন্নত দেশে পরিণত হতে পারিনি। কিন্তু আপনি কিন্তু প্রতিনিয়ত উন্নত দেশের কার্যকলাপ ফলো করেন। তবে কেন তা আপনার দেশের বা আপনার শহরের বেলায় নয়? ঢাকার ড্রেনগুলো কি আপনার ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বোতল ও প্যাকেটে ব্লক হয়ে যায় না? অনেকেই বলেন, সবাই ফেলে আমি একা এতটা সচেতন হয়ে কি হবে! কিছু হবে? আমার জবাব, অবশ্যই হবে, পরিবর্তন ও অভ্যাসটা একজন একজন করেই করতে হয়।

ঢাকায় নদী রয়েছে, এটা আমাদের ভাগ্যের ব্যাপার। বিশ্বের অনেক দেশের রাজধানী ঘিরে কোনো নদীই নেই। কিন্তু আমরা ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে নষ্ট করে ফেলেছি। ঢাকা শহরের মধ্যেও অতীতে খাল, বিল-ঝিল, দীঘি, পুকুর ও জলাভূমি ছিল। বৃষ্টির পানি ওই সব খাল দিয়ে নিষ্কাশিত হয়ে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশে নদী ও অন্যান্য জলাভূমিতে জমা হতো। মানুষ অপরিকল্পিত দালানকোঠা ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করে সেগুলোর নাম-নিশানা মুছে গেছে আজ।

আমাদের হিসাব করে দেখা দরকার, জলাবদ্ধতার কারণে সরকারি বা ব্যক্তি পর্যায়ে যে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, তা কি কোনোভাবেই জলাভূমি ভরাট করে নগরায়ণকে সমর্থন করে? তাহলে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কেন রক্ষা করতে পারছে না খাল আর জলাধার। এখানেই প্রশ্নবিদ্ধ হয় আমাদের আইন ব্যবস্থা এবং আইন প্রয়োগে সদিচ্ছা। সভা-সেমিনারে সহজেই দায়ী করা যায় কিছু ব্যক্তিকে। অবশ্যই জলাবদ্ধতায় নাকাল নগরবাসীর কাছে তাঁদের দায়বদ্ধতা আছে। তবে নগরবাসী বুঝতে পারে সমস্যার মূল, শাখা-প্রশাখা অনেক গভীরে। যত দিন পর্যন্ত নগরায়ণে অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট প্রাধান্য পাবে, কতিপয় গোষ্ঠীর অর্থলিপ্সার কাছে উপেক্ষিত হবে মানুষ, সামাজিক মূল্যবোধ ও পরিবেশ, তত দিন প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে আমরা বারবার বিপর্যস্ত হব।

প্রতিদিন সকাল হওয়ার আগে ঢাকা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ঢাকাকে চকচকে করে রাখেন। বিশ্বাস না হলে একদিন ভোরে এই প্রাণের শহরকে একটু ঘুরে দেখুন। অথচ আমরা ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাই রাস্তায় ময়লা ফেলতে ফেলতে, স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে বিদ্যা অর্জন করতে যাই রাস্তায় ময়লা ফেলতে ফেলতে। পরিবেশবাদী মিটিং করতে যাই রাস্তায় ময়লা ফেলতে ফেলতে! আমরা তো সবাই জমিদার! সবকিছুই দুই মেয়র করবে! আমার ভাষায়, আমরা হচ্ছি এক টাইপের অভদ্র জমিদার।

ঢাকায় প্রতিদিন হাজার হাজার নতুন মানুষ প্রবেশ করে, তারা বেশির ভাগই মফস্‌সল থেকে আসে।

তাদের মধ্যে এখনো ওই অভ্যাস নেই। কিন্তু তারা যদি ঢাকায় প্রবেশ করে দেখে সবাই নির্দিষ্ট স্থানে (ডাস্টবিন) ময়লা ফেলে, যেখানে-সেখানে ময়লা ফেললে পুলিশ জরিমানা করে। অথবা কেউ একজন ময়লা ফেললেই আরেকজন পাশ থেকে বলছে, ‘প্লিজ, ময়লাটা কষ্ট করে একটু ডাস্টবিনে ফেলুন। না হয় পুলিশ আপনাকে জরিমানা করবে।’ এটাও বলতে পারেন, ‘আমরা সবাই নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলি, প্লিজ, আপনিও ফেলুন।’ আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, মানুষ কখনোই অখুশি হবে না। আমাদের দেশের একজন শ্রমিক উন্নত দেশে গিয়ে কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে সেই দেশের আইনকানুন এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেন। শুধু উন্নত দেশে কেন? এ তো আমরা যখন ক্যান্টনমেন্টের ভেতর প্রবেশ করি, তখন সব আইনকানুন এবং পরিবেশের সঙ্গেও মানিয়ে চলি।

একটু গভীরভাবে জলাবদ্ধতার কারণ যদি আমার খুঁজতে যাই, তবে কয়েকটি বিষয় উঠে আসে। যেমন জলাশয়, খাল-বিল, নদী-নালা ভরাট, পানি নিষ্কাশন তথা বৃষ্টির পানি বেরিয়ে যাওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে নগরীর খালি জায়গা কমে গেছে। অত্যন্ত ঘনবসতি হওয়ায় পয়োনিষ্কাশন ক্ষমতা অকার্যকর হয়ে গেছে, ডাস্টবিন ছাড়া যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা হয়। তাই পাড়া-মহল্লার পানি নিষ্কাশনের ড্রেন বন্ধ হয়ে যায়। বর্ষায় অতিরিক্ত খোঁড়াখুঁড়ি, কাজেই একটু বৃষ্টি হলেই পুরো রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়।

একসময় পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলেও বেশ কয়েক বছর ধরে এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। যার কারণে কাঁচাবাজার, হাটবাজার ও দোকানপাটে এর ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। পলিথিনগুলো ড্রেন, খাল এমনকি নদ-নদীর তলদেশের গভীরতা কমিয়ে দিচ্ছে। ড্রেন পরিষ্কার করে ময়লা ড্রেনের পাশেই ফেলে রাখা হয়। সামান্য বৃষ্টিতে সে ময়লা আবার ড্রেনে গিয়েই পড়ে। সময়মতো বর্জ্য পরিষ্কার করা হয় না। নগরীতে ছোট-বড় অনেক ডাস্টবিন দেওয়া হলেও সেগুলোর ব্যবহার নেই বললেই চলে। জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পেছনে আরেক অভিশাপ বলা যেতে পারে নির্মাণাধীন ভবনগুলো থেকে তৈরি উপজাতগুলোকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভবন তৈরির কাঁচামাল এনে জড়ো করা হয় রাস্তার ওপর। তারপর সেখান থেকে নিয়ে তৈরি করা হয় স্থাপনা।

ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানে গণসচেতনা সৃষ্টি করতে হবে। এ সমস্যা এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। তাই রাতারাতি নিরসন করাও যাবে না। তবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপগুলো স্বচ্ছতার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। বিদ্যমান খালগুলো দখলমুক্ত ও খনন করে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। খাল, ড্রেন পরিষ্কার রাখতে হবে। কোথায়ও যেন পলিথিন, প্লাস্টিক বা আবর্জনা আটকে না থাকে সেদিকে নাগরিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং তা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। বিল্ডিং কোড অনুযায়ী বাড়িঘর, অফিস, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথম পর্যায়ে সরকারি স্থাপনার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টা মাথায় নিয়ে এখন পরিকল্পনা করতে হবে। কেননা এখন ঘন ঘন বৃষ্টি হচ্ছে, অসময়েও। এ ছাড়া হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, অনতিবিলম্বে ঢাকার নদীগুলোর সীমানা নির্ধারণ করে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। সংসদ সদস্য ও ওয়ার্ড কাউন্সিলররা তাঁর এলাকার জলাভূমি রক্ষার দায়িত্বে থাকবে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোর কাছে তাঁরা দায়বদ্ধ থাকবে।

আপনি আমি সচেতন হলেই ঢাকা বাঁচবে। অবশ্যই এই জলাবদ্ধতা দূর হবে। আলো আসবেই। আশাবাদী।

কৃষিবিদ মো. বশিরুল ইসলাম
উপপরিচালক
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়