ভারতে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন অগণিত। তবে তারা যৌথ পরিবারের মতো। এই পরিবারের ‘কর্তা’ নিশ্চিতভাবে আরএসএস। লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকে মনে হচ্ছিল, আরএসএসের ‘প্রচারকেরা’ বিজেপির মোদি-অমিত শাহ জুটির ওপর সন্তুষ্ট নয়। তখন সেটা ছিল কেবলই আঁচ-অনুমান।
নির্বাচনে ৬৩টি আসন কমে যাওয়ার পর সেই অনুমান প্রকাশ্যে সত্য হিসেবে হাজির হলো। আরএসএসের অনেকে বিজেপির নেতৃত্ব নিয়ে অসন্তোষের কথা জানাচ্ছেন এখন।
প্রশ্ন উঠেছে, কর্তা কি তবে পরিবার পুনর্গঠনের দিকে যাবেন? এটা কি তবে নাগপুর বনাম আহমেদাবাদ দ্বন্দ্ব?
ভারতের সমাজজীবনে হিন্দুত্ববাদের কাঠামোগত শক্তির জায়গায়টা যাঁরা টের পান, সে রকম অনেকের কাছেই নরেন্দ্র মোদির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা আরএসএসের প্রধান।
এখনকার সেই পদাধিকারী মোহন ভগত নির্বাচনী প্রচারকালেই বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে ‘অসম্মানের’ অনুযোগ তুলেছিলেন। বিশেষ করে যখন বিজেপির সভাপতি জগৎ প্রকাশ নাড্ডা বলছিলেন, তাঁদের দল ‘একা একা চলতে সক্ষম’ এবং ‘একাই চলছে’।
নাড্ডার মতে, আরএসএস হলো বিজেপির সাংস্কৃতিক ‘গণসংগঠন’। অর্থাৎ ‘পার্টি’ হলেন তাঁরা। গুরুত্ব বেশি তাঁদেরই। এ রকম ব্যাখ্যার মানে হলো হিন্দুত্ববাদীদের এত দিনের পুরো সাংগঠনিক কাঠামো উল্টিয়ে দেখাতে চাওয়া। মোহন ভগতের এটা সহ্য করতে পারার কথা নয়।
অমিত শাহ-মোদি জুটি মণিপুরের গন্ডগোল যেভাবে মোকাবিলা করেছেন, সেটি নিয়েও গেরুয়া শিবির অসন্তুষ্ট। সেখানকার হিন্দু মেইতেইরা চলমান ওই দাঙ্গার বড় এক শিকার। কিন্তু মোদি দাঙ্গার ১৩ মাস পরও ওদিকে যাননি। সেখানকার আরএসএস কর্মীরা তাই ক্ষুব্ধ।
এ রকম বিবিধ পটভূমিতেই নির্বাচনের পরপর ১০ জুন নাগপুরে আরএসএস সদরে মোহন ভগত প্রথম বক্তৃতায় বলছিলেন, ‘যে কাজ করে...কিন্তু কাজ নিয়ে নির্মোহতার আবেগ তৈরি হয়নি; যার ভেতর অহং রয়ে গেছে-অন্যদের প্রতি সম্মানের ঘাটতি রয়েছে, তাকে কোনোভাবে আমরা জনগণের সেবক বলতে পারি না।’
এ রকম কথাবার্তার শ্রোতাদের স্পষ্টই মনে হচ্ছিল, এসব বলা হচ্ছে বিজেপির হর্তাকর্তাদের উদ্দেশ্যে। ভগত আরও বলছিলেন, নির্বাচনী প্রচারে মর্যাদা ও সংযমের ব্যাপার লঙ্ঘিত হয়েছে। নির্বাচনকে যুদ্ধ ভাবা ঠিক নয়। আরএসএস এ রকম ‘যুদ্ধের’ জন্য নয়। শত্রু নয়, নির্বাচনে থাকে প্রতিপক্ষমাত্র।
বলা বাহুল্য, বিজেপির নির্বাহীরা এটাকে যুদ্ধ হিসেবেই নিয়েছিলেন। মোদি ভোটারদের মন বিষিয়ে তুলতে মুসলমান তোষণের বহু প্রমাণবিহীন অভিযোগ তুলেছেন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। মুসলমানদের তিনি বলেছেন ‘অনুপ্রবেশকারী’। কখনো কখনো ‘বেশি বাচ্চা উৎপাদনকারী’ বলেও তাঁদের সম্বোধন করা ৩.০হয়েছে।
এসবের বিপরীতে মোহন ভগতের বক্তব্য বেশ বিস্ময় তৈরি করেছে। নাগপুর ভাষণে তাঁর আরও সুপারিশ ছিল, ‘আরএসএস কর্মীদের ভারতের বহুত্বকে মেনে নিতে হবে; সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে থাকার অভ্যাস লাগবে।’ তিনি নির্বাচনকালে ‘প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে মিথ্যাচারেরও’ নিন্দা করেন।
এ রকম একটা ভাষণ ভারতজুড়ে যে ব্যাপক মনোযোগ কেড়েছে এবং সেটা যে নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে মিলিয়ে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, তা অস্বাভাবিক নয়।
ইতিমধ্যে নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় মন্ত্রিসভা আগের মতোই কাজকর্মে নেমে পড়েছে। কিন্তু দলের সর্বত্র একটা চাপা অস্বস্তি লুকানো যাচ্ছে না। হিন্দুত্ববাদী গণসংগঠনগুলোতেও নানা গুঞ্জন। গত এক দশকে এই প্রথম বিজেপি কর্মীদের অস্বস্তির কারণ কোনো বিরোধী দল নয়, খোদ তাদের প্রাণপ্রিয় আরএসএস।
নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি কর্মীদের ৪০০ আসন পাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাও পেল না। সংঘ পরিবারের দুর্গ বলে খ্যাত উত্তর প্রদেশে ৮০টির মধ্যে ৭৫টি আসনে দাঁড়ানো তাদের প্রার্থীদের ভোট ৭২টি আসনেই কমল। কেবল কমেছে বললেও পুরোটা বলা হয় না। আগেরবার যেখানে তারা ৫০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, এবার পেল ৪১ শতাংশ।
খোদ মোদির আসনেও প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে তার ভোটের ব্যবধান কমেছে। বিজেপি তাঁকে অবতারের মতো তুলে ধরলেও মোদির বিপরীতে কংগ্রেস প্রার্থী ৪ লাখ ৬০ হাজার ভোট পেয়েছেন। আগে মোদি এই আসনে ৬৪ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতলেও এবার ৫৪ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতলেন।
মোহন ভগত এ ‘সুযোগ’ই নিলেন নাগপুরে। বিজেপির সূক্ষ্ম সমালোচনার ভেতর দিয়ে তাঁর সংগঠন একদিকে পরাজয়ের দায় এড়িয়ে গেল, অন্যদিকে বিজেপিতে শুদ্ধি অভিযানের প্রয়োজনীয়তার কথাও হয়তো জানাল। নির্বাচনের আগে আগে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে যেভাবে বন্ড কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়, তার সাফাই গাওয়া আরএসএস প্রচারকদের জন্য যে স্বস্তিকর ছিল না, তারও ইন্ধন হয়ে থাকতে পারে মোহন ভগতের চলতি বিরক্তি।
আরএসএসের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এও নির্বাচনের পর বিজেপি নেতৃত্বের স্পষ্ট সমালোচনা দেখা গেছে। তবে এটা এখনো অস্পষ্ট, আরএসএস মোদি-অমিত শাহ জুটিকেই বলি দিতে চাইছে কি না।
চারবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী এবং তিনবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারায় হিন্দুত্ববাদী শিবিরে অবশ্যই নরেন্দ্র মোদির জন্য একটা বিশিষ্ট জায়গা ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। তারপরও এই ধারার রাজনীতিতে আরএসএস প্রধানের কথাই শেষ কথা। নাড্ডা যা–ই বলুন, শতাব্দীপ্রাচীন দল আরএসএস কর্মীরাই হলো বিজেপির প্রচার মেশিন ও ভোটশক্তি। এ কারণে মোহন ভগতের নাগপুরের বয়ান বিজেপি শিবিরের উৎকণ্ঠা সৃষ্টি না করে যায়নি।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, মোদি-অমিত শাহ-আদিত্যনাথ-হিমন্ত শর্মা-নাড্ডারা এখন কী করবেন?
টিম মোদির সামনে পথ তিনটি—মোহন ভগতদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ানো অথবা নিজেদের টিম থেকে দু–একজনের পদত্যাগ কিংবা নাগপুরের মুরব্বিদের সঙ্গে একটা আপস–মীমাংসায় আসা, আরএসএসকে শক্তির ভরকেন্দ্র হিসেবে মেনে নেওয়া। এ তিন বিকল্পের তৃতীয়টি সবার আগে শুরু হওয়ার মতো এবং সেটা দ্রুতই হতে হবে। কারণ, আপসের উদ্যোগ সফল না হলে এই দ্বন্দ্ব মাঠপর্যায়ে ছড়াবে এবং তার একটা প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে সামনের রাজ্য নির্বাচনগুলোয়।
আগামী আট মাসের মধ্যে চারটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হবে। এসব রাজ্যে গত নির্বাচনে প্রায় ৮০টি লোকসভা আসন ছিল। হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড, দিল্লির পাশাপাশি এ তালিকায় আছে মহারাষ্ট্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ও।
এ চার রাজ্যের কোথাও কংগ্রেস, কোথাও বিজেপি ভালো করলেও সব মিলে আসনের হিসাবে উভয় পক্ষের প্রায় সমান আসন ছিল। বিধানসভা নির্বাচনে হবে প্রকৃত জয়-পরাজয়ের মীমাংসা।
যদিও রাজ্য নির্বাচনের ফল কেন্দ্রীয় সরকারের উত্থান-পতনে কোনো প্রভাব রাখে না, কিন্তু এবার খেলার আমেজ একদম ভিন্ন। কংগ্রেস এসব রাজ্যের নির্বাচনে এ রকম বার্তা দিতে মরিয়া যে মোদির জনপ্রিয়তা প্রকৃতই পড়ছে। বিজেপিও দেখাতে চায় তারা ফুরিয়ে যাচ্ছে না। দেখার বিষয় হলো, আরএসএস কী করে? তাদের কর্মীরা কি অমিত শাহ ও নাড্ডার মনোনীত প্রার্থীদের জন্য ভোট চেয়ে যথারীতি ঘরে ঘরে যাবেন? ভারতের তাবৎ রাজনৈতিক ভাষ্যকার এখন এ বিষয়ে নজর রাখছেন।
ইতিমধ্যে নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় মন্ত্রিসভা আগের মতোই কাজকর্মে নেমে পড়েছে। কিন্তু দলের সর্বত্র একটা চাপা অস্বস্তি লুকানো যাচ্ছে না। হিন্দুত্ববাদী গণসংগঠনগুলোতেও নানা গুঞ্জন। গত এক দশকে এই প্রথম বিজেপি কর্মীদের অস্বস্তির কারণ কোনো বিরোধী দল নয়, খোদ তাদের প্রাণপ্রিয় আরএসএস।
জুন মাসের আগেও এ রকম একটা মুহূর্তের কথা ভাবা যেত না। কিন্তু এখন অবস্থা এমন, আরএসএস নির্বাহী পরিষদের সদস্য ইন্দ্রেশ কুমার প্রকাশ্যে এ–ও বলে ফেলেছেন, ‘যারা ভগবান রামের পূজা দেয়, কিন্তু অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, তারা ২৪১-এ এসে আর এগোতে পারে না।’
এ রকম বক্তব্যে যে তিরস্কার ঝরে পড়ছে, মোদি ও অমিত শাহ তাকে অগ্রাহ্য করবেন কীভাবে?
আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক