রাশিয়ার বহু সেনা ইতিমধ্যে মারা গেছেন এবং ইউক্রেনের অবিচলিত ন্যাটো মিত্ররা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে—এই বাস্তবতার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে, ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। এ যুদ্ধের কারণে ইতিমধ্যে ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রল ও খাদ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। এ ধারা যদি আগামী শীত পর্যন্ত চলতে থাকে, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর অনেক পরিবারকে তখন ঘর গরম করা ও রান্না করার উনুন জ্বালানো—এ দুটোর যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হতে পারে ।
যুদ্ধের নতুন এ পর্ব আমার ভাষায় ভ্লাদিমির পুতিনের ‘শীতকালীন কৌশল’ বনাম ন্যাটোর ‘গ্রীষ্মকালীন কৌশল’। জ্বালানিসংকট ও খাদ্যের দাম আরও বেড়ে গেলে ন্যাটো জোটের মধ্যে ফাটল ধরবে—এ আশায় পুতিন নিশ্চিতভাবে ইউক্রেনে হামলার মাত্রা আরও বাড়ানোর জন্য তৈরি হয়ে আছেন।
মনে হচ্ছে, পুতিন ভেবে রেখেছেন আগামী শীতে যদি ইউরোপে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঠান্ডা পড়ে, বৈশ্বিক তেল ও গ্যাসের সরবরাহে যদি টান পড়ে এবং দাম স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়, জ্বালানি ঘাটতির কারণে যদি ব্যাপক অঞ্চলজুড়ে বিদ্যুৎ–বিভ্রাট শুরু হয়, তাহলে ভুক্তভোগী ইউরোপীয় ন্যাটো দেশগুলো ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে রাশিয়ার যেকোনো শর্তে রাজি হয়ে যুদ্ধ থামাতে চাপ দিতে পারেন।
তাই পুতিন নির্ঘাত তাঁর নিজের ক্লান্ত সেনা এবং জেনারেলদের বলছেন, ‘তোমরা শুধু আমাকে ক্রিসমাস পর্যন্ত নিয়ে যাও। শীত আমাদের বন্ধু।’
এটিকে পুতিনের খামখেয়ালি কৌশল বলা যাবে না। দ্য টাইমস পত্রিকা গত সপ্তাহে একটি প্রতিবেদনে বলেছে, এ বছরের শেষের দিকে রাশিয়া তেল ও গ্যাসের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় জ্বালানির দাম আরও এক দফা অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে পারে এবং তখন ইউরোপকে নতুন করে মূল্য দিতে হবে বলে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা মনে করছেন। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য বড় অর্থনীতিগুলোর ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। একই সঙ্গে তীব্র খাদ্যসংকটও দেখা দিতে পারে।
পুতিন এখনই কোনো যুদ্ধবিরতিতে যাবেন বলে কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ন্যাটো দেশগুলো যদি শীত আসার আগেই ইউক্রেনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে রাশিয়াকে চাপে ফেলতে পারে, তাহলে তিনি হয়তো যুদ্ধবিরতিতে যেতে পারেন। সেটি হলে জ্বালানি ও খাদ্য বাজার মুক্তি পাবে। অন্যদিকে পুতিনের প্রাণপণ চেষ্টা থাকবে লড়াইটাকে শীত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ন্যাটো ও ইইউ ইউরোপে রাশিয়ার তেল রপ্তানি কমানোর যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তার ফল হিসেবে শিগগিরই তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ২০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এ অবস্থায় ন্যাটো, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের কর্মকর্তারা নিশ্চয়ই বলছেন, হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে শীত আমাদের শত্রু। তবে গ্রীষ্ম ও শরৎকাল আমাদের বন্ধু। এই সময়টাতে আমরা যদি পুতিনের ক্লান্ত হয়ে পড়া সেনাদের কাবু করে ফেলতে পারি, তাহলে পুতিন নিদেনপক্ষে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হবেন। তাঁদের এ কৌশলকেও হঠকারী কৌশল বলা যাবে না।
পূর্ব ইউক্রেনে পুতিন কিছুটা অগ্রগতি হয়তো পেয়েছেন, কিন্তু তার জন্যও তাঁকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। অসংখ্য সামরিক বিশ্লেষক বলেছেন, পাঁচ মাসের কম সময়ে সেখানে কমপক্ষে ১৫ হাজার রুশ সেনা মারা গেছেন এবং দ্বিগুণের বেশিসংখ্যক সেনা আহত হয়েছেন। সেখানে রাশিয়ার এক হাজারের বেশি ট্যাংক ও কামান খণ্ডবিখণ্ড ভাঙারিতে পরিণত হয়েছে।
মার্কিন কর্মকর্তারা আমাকে বলেছেন, পূর্ব ইউক্রেন থেকে বেরিয়ে আসার এবং ইউক্রেনকে ভূমি পরিবেষ্টিত করে আর্থিকভাবে শ্বাসরোধ করতে ওডেসা বন্দর দখল করার জন্য প্রয়োজনীয় সেনা পুতিনের কাছে এখন নেই। এখন পর্যন্ত পুতিন ইউক্রেনের যতটুকু ভূখণ্ড কবজা করেছেন, তা নিজের আয়ত্তে ধরে রাখাই তাঁর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পুতিন এখনই কোনো যুদ্ধবিরতিতে যাবেন বলে কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ন্যাটো দেশগুলো যদি শীত আসার আগেই ইউক্রেনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে রাশিয়াকে চাপে ফেলতে পারে, তাহলে তিনি হয়তো যুদ্ধবিরতিতে যেতে পারেন। সেটি হলে জ্বালানি ও খাদ্য বাজার মুক্তি পাবে। অন্যদিকে পুতিনের প্রাণপণ চেষ্টা থাকবে লড়াইটাকে শীত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া।
এ কারণে আমি মনে করছি, গত ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত যে লড়াই চলছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর পর্যায় সামনে আসছে। কারণ, উভয় পক্ষ সামনের শীত মাথায় রেখে প্রাণপণ লড়াই শুরু করবে। এর লক্ষণও শুরু হয়ে গেছে। ইউক্রেনের উপপ্রধানমন্ত্রী ইরিনা ভেরেশচাক ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় রুশ অধিকৃত এলাকা থেকে রুশ নাগরিকদের অবিলম্বে সরে যেতে বলেছেন, যাতে ওই লোকদের পুতিন মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার না করতে পারেন। তিনি তাঁদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনারা সরে যান। কারণ, আমাদের সেনারা এলাকা পুনরুদ্ধার করতে আসছেন এবং সেখানে প্রচণ্ড লড়াই হবে।’
ফলে আমি মনে করছি, ইউক্রেন যুদ্ধ সহসা শেষ বা স্তিমিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
টমাস এল ফ্রিডম্যান পুলিৎজারপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও নিউইয়র্ক টাইমস–এর নিয়মিত কলাম লেখক