প্রতিমন্ত্রীর লোকেরা ঘুষ নেন আবার ফেরতও দেন!

বাংলাদেশে ঘুষ নিয়ে ফেরত দেওয়ার ঘটনা খুব কম। যাঁরা ঘুষ নেন, তাঁরা ঘুষদাতার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাবান। কেন ফেরত দেবেন? কিন্তু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন এতটাই দয়াবান যে, তিনি ঘুষের সাড়ে নয় লাখ টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।

তবে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থার আগে তিনি আরও কিছু ‘ব্যবস্থা’ নিয়েছেন, যে কারণে ঘুষদাতাদের তিনজনের দুজন মন্ত্রীর সরকারি বাসভবন থেকে পালিয়ে সদর রাস্তার উদ্দেশে ভোঁ-দৌড় দিয়ে আত্মরক্ষা করেছেন। আরেকজন মন্ত্রীর বাড়ির প্রাচীর টপকে ডিবি অফিসে আশ্রয় নিয়েছেন। ডিবি অফিসে যাওয়া ব্যক্তির নাম আবু সুফিয়ান। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদেরও নেতা। তাঁর মাধ্যমেই মন্ত্রীর বাড়ির কেচ্ছাকাহিনি জনসমক্ষে এসেছে।

প্রথম আলোর খবরে জানা যায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের কথা বলে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাতজনের কাছ থেকে নেওয়া ঘুষের সাড়ে ৯ লাখ টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। রোববার (১০ ডিসেম্বর) প্রতিমন্ত্রীর এক প্রতিনিধি রাজধানীর মিন্টো রোডে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কার্যালয়ে গিয়ে ভুক্তভোগীর টাকা ফেরত দেন।

গত শুক্রবার একটি পত্রিকায় ‘প্রতিমন্ত্রী জাকিরের এ কেমন নির্মমতা’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেদিন প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের অধীন মন্ত্রণালয় বীর দর্পে জানিয়ে দিয়েছিল, এ রকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তার পাঠানো প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, ‘মারধরের খবর উদ্ভট, অলীক ও কল্পনাপ্রসূত। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের প্রথম পর্বের পরীক্ষা হওয়ায় ভিড় ও তদবির এড়াতে প্রতিমন্ত্রীর মিন্টো রোডের বাসায় অপরিচিত কাউকে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধ করা হয়।

তারপরও কতিপয় ব্যক্তি প্রতিমন্ত্রীর বাসভবনে প্রবেশ করতে চাইলে হাউস গার্ড বাধা দেয়। কিন্তু তারা বাধা অগ্রাহ্য করে বাসার ভেতর প্রবেশ করে এবং গার্ডদের সঙ্গে চিৎকার-চেঁচামেচি ও ধস্তাধস্তি করতে থাকে। একপর্যায়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় একজন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগ করা হয়েছে। প্রতিমন্ত্রীর সময়ে অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকসহ নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে।’

চমৎকার বয়ান। প্রতিমন্ত্রীর বাসায় জোর করে কিছু লোক প্রবেশ করতে গেলে আইনানুগ বাহিনীর সদস্যরা তাদের বাধা দেন। তবে বাধাটি এতই নির্মম ছিল যে একজনকে বাড়ির সীমানা প্রাচীর টপকে পাশের ডিবি অফিসের আঙিনায় আশ্রয় নিতে হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য অনুযায়ী যদি কোনো ঘুষ বা উৎকোচ লেনদেনের ঘটনা না ঘটে থাকে তা হলে সেখানে ফেরত দেওয়া হলো কীভাবে? সোমবার সব পত্রিকায়ই প্রতিমন্ত্রীর প্রতিনিধির ঘুষ ফেরত দেওয়ার খবর ছাপা হয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন

প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকার কয়েক ব্যক্তি আমার নামে চাকরি দেওয়ার কথা বলে কয়েকজন চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন; সেটা আমি জানতাম না। পরে জানতে পেরে একজনকে দায়িত্ব দিয়েছি সবার টাকা ফিরিয়ে দিতে।’  

গত বৃহস্পতিবার প্রতিমন্ত্রীর বাড়ির লোকজনের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে তিনজনের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও কি তিনি জানতেন না? কোনো কোনো পত্রিকায় খবর এসেছে তাঁদের মারধর করার সময় তিনিও উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রীর লোকজনই আবু সুফিয়ানকে ডেকে নিয়ে কৈফিয়ত তলব করেছেন, তাঁরা কেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করলেন?

টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ভুক্তভোগী আবু সুফিয়ান। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলে মন্ত্রীর গাড়িচালক ও এক ভাগনে টাকা নিয়েছিলেন। আমি সাতজন চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে সাড়ে ৯ লাখ টাকা তুলে তাঁদের দিয়েছিলাম।’ আবু সুফিয়ান আরও বলেন, ‘রোববার প্রতিমন্ত্রীর একজন প্রতিনিধি ডিবি কার্যালয়ে এসে টাকা ফেরত দিয়েছেন। ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার (এডিসি) ফজলে এলাহী আমাদের টাকা বুঝিয়ে দিয়েছেন।’

প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য। তাঁর গাড়িচালক ও এক ভাগনে ওই টাকা নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও টাকা ফেরত পাননি ভুক্তভোগীরা। এ কারণে গত ১৪ মে ৪৮ জনের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন আবু সুফিয়ান। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। তাঁর ধারণা, প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করার কারণেই তিনি এবার মনোনয়ন পাননি। মনোনয়ন পেয়েছেন বিপ্লব হাসান নামে ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতা।

কালবেলার খবরে বলা হয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সুপারিশ করতে যান ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ’-এর আবু সুফিয়ান বিশ্বাসসহ কয়েকজন। আবু সুফিয়ান সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ও খুলনা জেলার সভাপতি। ২০২২ সালের ৮ জুন প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের বাসায় ওই মিটিং হয়।

প্রতিমন্ত্রীর দাবি ঘুষের টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। একজন আইনানুগ নাগরিক ও মন্ত্রী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ছিল  ঘুষগ্রহণকারীকে পুলিশে সোপর্দ করা। তাঁদের নামে মামলা করা। কিন্তু সেটি না করে তিনি ঘুষের টাকা নিয়ে তাঁর প্রতিনিধিকে ডিবি কার্যালয়ে পাঠালেন কেন? তাহলে ঘুষের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা এড়াবেন কীভাবে?

আবু সুফিয়ানের অভিযোগ, ২০২২ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে চাকরির জন্য তিনিসহ ৪৮ জন মোট ৯৪ লাখ টাকা দেন। তিনি প্রতিমন্ত্রীর ভাতিজা লিটনকে সাতজনের জন্য সাড়ে ৯ লাখ টাকা দেন। কিন্তু ৪৮ জনের কেউ চাকরি পাননি। টাকাও ফেরত দেওয়া হয়নি।

এ নিয়ে তাঁরা অভিযোগ করেন। ৭ ডিসেম্বর প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী যেতে বললে তিনিসহ তিনজন প্রতিমন্ত্রীর মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে যান। সেখানে তাঁদের টাকা ফেরত না দিয়ে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে তাঁরা পালিয়ে আসেন।

আবু সুফিয়ান পালিয়ে ডিবি কার্যালয়ে গিয়েছেন বলেই হয়তো ঘুষের রহস্য ফাঁস হয়েছে। তা না হলে প্রতিমন্ত্রীর বাড়িতে সন্ত্রাসী ঘটনা বলে উল্টো তাদের ফাঁসিয়ে দিলে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।

ঘুষের অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানোয় প্রতিমন্ত্রী আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি। কিন্তু এ রকম ঘুষ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি কি মন্ত্রী পদে বহাল থাকতে পারেন?

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com