১০ ডিসেম্বর নামক ‘ঘটনা’ শুরু হয়ে গেছে ৭ ডিসেম্বর থেকেই। ওই দিন নয়াপল্টন থেকে পুলিশের গুলিতে রক্তের যে ধারা নতুন করে বইতে শুরু করেছে, তা কি আর পেছনে গড়াবে? একটি প্রতিবাদী জনসভা ঠেকাতে যদি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে, তাহলে বাধাহীন নির্বাচনের বেলায় কী করবে সরকার? আরও প্রাণহানি দেখতে হবে? জেলখানায় জায়গা হচ্ছে না, বলেছেন জেলার। আদালত চত্বর থেকে পুলিশের চোখে মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে জঙ্গিরা পালাতে পারে ঠিকই, কিন্তু পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে বিএনপির কর্মীদের ওপর হামলা করা সন্ত্রাসীটিকে পুলিশ দেখেও না, খুঁজেও পায় না। আর মধ্যরাতে গ্রেপ্তার হয়ে যান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা ও হাজারো কর্মী।
এভাবেই ১০ ডিসেম্বরের জনসভার আগেই চাপে পড়ে গেছে সরকার। ঢাকা এখন অবরুদ্ধ শহর। রাজধানীতে ঢোকার সব পথে পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারদের পাহারা। মোড়ে মোড়ে ক্ষমতাসীনদের চৌকি বসেছে। কিন্তু আড়াই কোটি জনসংখ্যার একটি মহানগরকে কি এভাবে দম আটকে রাখা যাবে? জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, যুক্তরাষ্ট্র সরকার এসব চরম ‘অ্যাকশনের’ সমালোচনা করছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিএনপি যে মনোযোগ পাচ্ছে, তা নয়াপল্টনের সম্ভাব্য বিশাল জনসভা দিয়েও পেত কি না সন্দেহ। রাজনীতির খেলায় তাহলে কে এগিয়ে গেল? সর্বশেষ ‘রাজনীতির জেন্টলম্যান’ হিসেবে খ্যাত মির্জা ফখরুলকে মধ্যরাতে গ্রেপ্তার করে কী অর্জন করল সরকার? যে ভারী পাথর পাহাড়ের ঢাল দিয়ে একবার গড়াতে শুরু করেছে, তাকে কি এভাবে মাঝপথে থামানো যাবে? থামাতে হলে হত্যা–নির্যাতনের সুনামি বইয়ে দিতে হবে। রক্ত আরও রক্ত ডেকে আনবে। এমন মরিয়াপনা কি আখেরে কারও জন্য ভালো হবে?
অভিধানে মরিয়া শব্দের অর্থ হলো হতাশ হয়ে বিপদ মোকাবিলায় যে মারতেও প্রস্তুত। ১৩ বছর ধরে একচেটিয়া ক্ষমতা উপভোগ করা ক্ষমতাসীন দল কেন নিজেকে বিপন্ন ভাবছে? কীভাবে তারা শান্তিপূর্ণ সব পথ নষ্ট করে ফেলল? উন্নয়নের গল্পে আর কাজ হচ্ছে না? চেতনার বাণীর ধার ভোঁতা হয়ে গেছে? মিত্ররা দূরে সরে যাচ্ছে? মানুষের জমায়েত দেখলেই ভয় বাড়ছে? ভয় থেকে আসছে এই মরিয়াপনা? তাই নিরুপায় হয়ে রাজপথে ও ঘরে দুখানেই বলপ্রয়োগ করতে হচ্ছে? তারপরও কি কাজ হচ্ছে? পরিবহনমালিকদের দিয়ে সরকারি অবরোধের পরও বিএনপির কোনো বিভাগীয় সমাবেশ কি ব্যর্থ হয়েছে? হয়নি। অর্থাৎ বলপ্রয়োগের পুরোনো তরিকা তেমন কাজ করছে না।
যখন শাসকেরা আর আগের কায়দায় শাসন চালাতে পারে না পরিবর্তন তখন জরুরি হয়ে পড়ে। তবে এটাই যথেষ্ট নয়। যারা শাসিত, তাদের পক্ষেও যখন আগের মতো মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে ওঠে, তখন কিছু ঘটতে পারে। এসব শর্তের যোগফল হলো একটি শব্দ ‘নিরুপায়তা’। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবঞ্চিতেরা যখন যার যার মতো করে নিরুপায়বোধ করে, তখন রদবদলের সম্ভাবনা তৈরি হলেও হতে পারে। তবে তৃতীয় একটা ফ্যাক্টরকে বাদ দিলে ক্ষমতার ক্যালকুলাস কিছুতেই মিলবে না। সেটাই হলো সমীকরণের গুরুত্বপূর্ণ ‘এক্স ফ্যাক্টর’ বা অজানা রাশি। সেই ফ্যাক্টর কখনোবা জনগণ, কখনোবা কোনো গভীর শক্তি। তাদের পুরোদমে জাহির হওয়া না–হওয়াই এখন দেখার ব্যাপার।
দেয়ালে পিঠ ঠেকলে নাকি মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের মানুষের এত দিন পিছু হটত ঠিকই কিন্তু দেয়ালটা পিছলে সরে যেত। খেটে খাওয়ার হাজার রকমের বুদ্ধি, প্রবাসে ভাগ্য ফেরানোর আশা, ক্ষুদ্রঋণ, গ্রাম ছেড়ে শহরে উদ্বাস্তু হওয়া—এ রকম অনেক উপায় হাতড়ানোর কাতরানো জীবন কোনোমতে চালিয়ে নিত। কিন্তু অবিশ্বাস্য লুটপাটের অর্থনীতি এবার সত্যিই মানুষের পিঠ দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরেছে। দরিদ্র নিঃস্ব হয়েছে, মধ্যবিত্তের ইস্তিরি করা জামায় দেখা যাচ্ছে অভাবের ময়লা দাগ। শহরে শহরে নতুন নতুন হাত–পাতা মানুষের আনাগোনা। মানুষের পক্ষে এভাবে যে আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বিএনপির জনসভাগুলোতে নিচুতলার মানুষের পতঙ্গের মতো ছুটে যাওয়া এসবের একটা আলামত। অর্থনৈতিক সংকট ঢাকতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরম করে তোলা যদি কোনো কৌশল হয়ে থাকে, তবে তা বুমেরাং হতে বাধ্য। পেটে যদি না সয়, পিঠেও তখন কিছু আর সইবে না।
বিএনপিকে না হয় ঘরে–বাইরে দাবড়ানো যাবে, কিন্তু অর্থনীতির সংকট এতে আরও বাড়বে বৈ কমবে না। অনিশ্চয়তার ভয়ে চুপসে যাবে বাজার, উৎপাদন, স্বাভাবিক লেনদেন। যাঁরা কোনো সংকটের জন্য দায়ী হন, সাধারণত সেই সংকটের সমাধান তাঁদের হাত দিয়ে করা যায় না। যে হাত সংকট তৈরিতে জড়িত, নিজের সেই হাতকে কি কেউ শাস্তি দিয়ে সমাধান আনতে পারে? আমড়াগাছে কি কখনো আম ফলবে? একইভাবে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করার মাধ্যমে যে রাজনৈতিক সংকট সরকারি মদদে তৈরি করা হয়েছে, সেই সরকারের হাত দিয়ে কি এর রাজনৈতিক সমাধান আসা সম্ভব?
সুতরাং গণতান্ত্রিক সব পথে চলতে যখন তাঁরা নিরুপায়, তখন ২০১৪ সালের মতো বলপ্রয়োগই তাঁদের একমাত্র উপায়। কিন্তু মার্কিন ‘স্যাংশন’ এবং আরও আরও স্যাংশনের ভয় বলপ্রয়োগের পথটাকে সরু করে এনেছে। চওড়া হাতে বিরোধীদের শায়েস্তা করা এখন কেবল ইচ্ছার ব্যাপার না, তাকদের ব্যাপার না, পরিস্থিতিরও ব্যাপার। একচেটিয়া শাসন ডেকে আনে একচেটিয়া বিরোধিতা। পুলিশ প্রহরায় ক্ষমতাচর্চা দলের সঙ্গে সমর্থকদের দূরত্ব তৈরি করে। দলের গণতান্ত্রিক ধমনি শুকিয়ে যায়। রাজনীতি যখন সম্পদ লুটপাটের ক্রিমিনাল তৎপরতা, তখন জননেতাদের জায়গা নিয়ে নেন টাকা কামাতে আসা ‘নয়া–নেতা’। এই নয়া–নেতারা গায়ের জোর আর কানেকশন দিয়ে আধা–অপরাধমূলক পদ্ধতিতে ক্ষমতা অর্জন করেন। তারপর সেই ক্ষমতাকে রাতারাতি টাকা কামানোয় বিনিয়োগ করেন। সেই টাকা দিয়ে পুষতে থাকেন অনুগত মাস্তান বাহিনী। দলের ভবিষ্যৎ এরা চিন্তা করে না, তাদের মূল আকর্ষণ ধনী হওয়ার বর্তমান। পুলিশও কেবল তাৎক্ষণিক হুকুমের চিন্তা করে, পরিণতির কথা ভাবার প্রশিক্ষণ তাদের নেই।
এ রকম অবস্থাতেই রাজনৈতিক কর্মসূচির জায়গা নেয় হেলমেট, চাপাতি, শটগানের মহড়া, সোয়াট–র্যাব–পুলিশের সাঁজোয়া যান। এমনকি দলের ভেতরের কোন্দলও খুনোখুনি ছাড়া মেটে না। প্রতিটি পদ প্রতিটি সংসদীয় আসনের জন্য একাধিক নেতার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলতে থাকে। আওয়ামী লীগের মধ্যকার পদবঞ্চিত কিংবা বিক্ষুব্ধরা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, দলটির সব ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডিই তার প্রমাণ রেখে গেছে। শুধু পুলিশ আর পেটোয়া গোষ্ঠী দিয়ে নিজেদের এ দুর্বলতা কীভাবে বা কত দিন ঢেকে রাখা যাবে?
এত এত নিরুপায়তা নিয়ে কী করবে আওয়ামী লীগ? অর্থনীতি খারাপ, বিরোধীরা জোরদার, আন্তর্জাতিক চাপ অভূতপূর্ব। এই তিন বিষয়ে সমাধানের কোনো প্রস্তাব বা কোনো রূপরেখা তাঁরা হাজির করেননি। হাজির করেছেন ‘হাত ভেঙে’ দেওয়ার, ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি।
বিরোধীদের হাজারো সমস্যা, কিন্তু আওয়ামী লীগের চাইতে তারা কম নিরুপায়। বিরোধীদের হারার উপায় আছে, ক্ষমতাসীনদের তো সেই উপায়টাও নেই। মঞ্চের হাঁকডাক যা–ই হোক, সেটা আমাদের রাজনীতির নাটুকে ঐতিহ্য। কিন্তু নাটকের বাইরে বাস্তবে সমঝোতার প্রয়োজন আওয়ামী লীগেরই বেশি। হারানোর ভয়টা তাদেরই বেশি, যেহেতু তারাই ক্ষমতাসীন। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে, কিন্তু বলপ্রয়োগের নেশায় যাদের পেয়েছে, তারা বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলে।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক
faruk.wasif@prothomalo.com