অভিমত

যুক্তরাষ্ট্র-ভারত: সামরিক জোট না করেও তারা সামরিক মিত্র

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হোয়াইট হাউসে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়
ছবি: এএফপি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উত্থান হচ্ছেই। হোয়াইট হাউসে রাষ্ট্রীয় নৈশভোজ ও কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে দেওয়া বিরল দ্বিতীয় ভাষণসংবলিত তাঁর বিজয়দীপ্ত ওয়াশিংটন সফরকে গত সিকি শতকের ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের নতুন অধ্যায় বলা যেতে পারে।

তবে মোদির ওয়াশিংটন সফরের আগে থেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জৈব প্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ফাইভ-জি ও সাইবার নিরাপত্তার মতো প্রযুক্তি খাতগুলোয় দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতাকে উৎসাহিত করা ক্রিটিক্যাল অ্যান্ড ইমার্জিং টেকনোলজিস (সেটস) বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত বেশ কিছু অগ্রগতি অর্জন করেছে। মার্কিন সেমিকন্ডাক্টর প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান মাইক্রোন টেকনোলজি সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, তারা ভারতে একটি নতুন চিপ অ্যাসেম্বলিং (চিপ সংযোজন) ও প্রযুক্তিযন্ত্র পরীক্ষার কারখানা গড়তে ৮২ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করেছে।

এর বাইরে মোদির শেষ ওয়াশিংটন সফরের বেশ আগেই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত বেশ কয়েকটি প্রতিরক্ষা চুক্তিও করেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ভারতের ৩০টি এমকিউ-৯বি প্রিডেটর সশস্ত্র ড্রোন কেনার চুক্তি রয়েছে। তা ছাড়া ভারতীয় বিমানবাহিনীর জন্য এফ ৪১৪ যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন তৈরির বিষয়ে মার্কিন কোম্পানি জেনারেল ইলেকট্রিকের সঙ্গে ভারতের চুক্তি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক মৈত্রী নেই, এমন কোনো দেশের সঙ্গে এর আগে কখনোই যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের চুক্তি করেনি। ফলে এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা অংশীদারির গভীরতা বোঝা যায়।

এই দুই দেশের মধ্যে আজ যে রূপান্তরধর্মী পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, সেটি খুবই লক্ষণীয় বিষয়। শীতল যুদ্ধের পুরোটা সময় বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্র এবং বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র মূলত বিচ্ছিন্নই ছিল। আমেরিকা প্রথম দিকে ভারতের বিষয়ে যে কতটা উদাসীন ছিল, তা চেস্টার বোলসকে ভারতের রাষ্ট্রদূত করে পাঠানোর সময় তাঁর উদ্দেশে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের একটি কথা থেকে পরিষ্কার হয়। ট্রুম্যান বোলসকে বলেছিলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম ভারত গরিব মানুষে ঠাসা এমন এক দেশ, যেখানে রাস্তায় গরু ইতস্তত হেঁটে বেড়ায়, যত্রতত্র ডাকিনী-যোগিনী ঘুরে বেড়ায়; লোকজন গরম কয়লার মধ্যে বসে থাকে আর গঙ্গায় ঝাঁপাঝাঁপি করে। কেউ যে দেশটিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবতে পারে, তা আমার বুঝেই আসেনি।’

সমাজতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া শাসকদের সঙ্গে জোট গঠনকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানের ইসলামপন্থী একনায়কদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। অন্যদিকে ভারতের জোটনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী গণতান্ত্রিক সরকার ধর্মনিরপেক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। শীতল যুদ্ধের সময় জোটনিরপেক্ষতাকে যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবে নিচ্ছিল না। নিরপেক্ষ থাকাটাকেও যুক্তরাষ্ট্র বিরোধিতা হিসেবে মনে করছিল।

এ প্রসঙ্গে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোয়েট আইজেন হাওয়ারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডুলেসের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘ভালো ও খারাপের মাঝখানে নিরপেক্ষ থাকাটাও খারাপ’। তবে পরবর্তী সময়ে শীতল যুদ্ধের সমাপ্তি, ভারতের পররাষ্ট্রনীতির পুনর্বিন্যাস এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে দেশটির যুক্ত হওয়া ওয়াশিংটন-দিল্লি সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়েছিল। যদিও ১৯৯৮ সালে ভারতের একটি পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা দেশটিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞার মুখে ফেলেছিল।

ভারত তার স্বাধীন ভঙ্গি বজায় রেখেই সম্প্রতি হিরোশিমায় অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলনে যোগ দিয়েছে। সে সম্মেলনে বাইডেন ও মোদি ছাড়া কোয়াডের বাকি সদস্য দেশ জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি আলবানসে উপস্থিত ছিলেন। ওই সম্মেলনে চার নেতাই একটি মুক্ত, উন্মুক্ত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিকের প্রতি তাঁদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ভারত সফর ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে একটি বড় বাঁকবদলের সূচনা করে। পরে জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসন ২০০৫ সালে ভারতের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করে এবং ২০০৮ সালে বেসামরিক পরমাণু সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী চুক্তি করে। বারাক ওবামা এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প উভয়ের আমলেই দুই দেশের সম্পর্কে ইতিবাচক প্রবণতা জারি ছিল। বর্তমানে জো বাইডেনের সময় সেই সম্পর্কের উষ্ণতা শীর্ষে পৌঁছেছে বলে মনে হচ্ছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জোটনিরপেক্ষ হিসেবে নিজের কৌশল নির্ধারণের এখতিয়ার নিজের কাছে রাখার বিষয়ে ভারতের যে উত্তর-ঔপনিবেশিক মোহ আছে, সেটাকে মেনে নিয়ে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহী। যেখানে হিন্দু জাতীয়তাবাদী মোদি তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ পূর্বসূরি মনমোহন সিংয়ের উল্টো পথে হাঁটছেন, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টি ও ডেমোক্রেটিক পার্টি উভয় দলের সরকার ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক এগিয়ে নিয়েছেন। এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের উভয় দলের পরপর পাঁচজন প্রেসিডেন্ট এবং ভারতের তিনজন প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের সম্পর্ক গভীর করার বিষয়কে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে নিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের এই অবস্থান পরিবর্তনে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বাধীন চীন সরকারের ভূরাজনৈতিক অবস্থান ও নীতিও আংশিক কাজ করেছে। সি চিন পিংয়ের পূর্বসূরিরা চীনের ‘শান্তিপূর্ণ উত্থানে’ বিশ্বাসী থাকার যে নীতি নিয়েছিলেন, তা থেকে তিনি সরে এসেছেন। যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টতই চীনকে তার প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখছে এবং চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে এ অঞ্চলে মিত্র খুঁজছে।

ঐতিহ্যগতভাবেই ভারত কোনো একটি পক্ষের পাশে দাঁড়ানো থেকে বিরত থেকে এসেছে। কিন্তু বারবার হিমালয় সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয় সীমানায় চীনের ঢুকে পড়া এবং ২০২০ সালের জুনে ওই সীমান্তে ২০ ভারতীয় জওয়ানকে হত্যা করা ভারতের জন্য নিরপেক্ষ হয়ে থাকা অসম্ভব করে তুলেছে।

ভারত তার স্বাধীন ভঙ্গি বজায় রেখেই সম্প্রতি হিরোশিমায় অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলনে যোগ দিয়েছে। সে সম্মেলনে বাইডেন ও মোদি ছাড়া কোয়াডের বাকি সদস্য দেশ জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি আলবানসে উপস্থিত ছিলেন। ওই সম্মেলনে চার নেতাই একটি মুক্ত, উন্মুক্ত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিকের প্রতি তাঁদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

চীনের কাছে বার্তাটি ছিল স্পষ্ট। যদিও ভারত মনে করে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের জোটসঙ্গী নয়, বরং অংশীদারমাত্র; তথাপি ভারত কমিউনিস্ট চীনের সঙ্গে তার ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে গণতান্ত্রিক পশ্চিমের সঙ্গে নিজেকে উত্তরোত্তর সম্পৃক্ত করেছে। তবে চীনের চোখ দিয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে দেখলে তা একটি বড় ভুল হবে। কারণ, গণতন্ত্র, একটি সাধারণ ভাষা এবং উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার স্পৃহার দিক থেকে আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে অনেক বেশি মিল রয়েছে। হেনরি কিসিঞ্জার যেমন একবার বলেছিলেন, দুই দেশের মধ্যে ‘ঐতিহ্যগত ও মৌলিক অর্থে স্বার্থের কোনো দ্বন্দ্ব নেই’।

ওয়াশিংটন-দিল্লি সম্পর্ক গভীর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় আমেরিকানদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা, যা ইতিমধ্যে ৪০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ভারতীয় আমেরিকানরা অসম মাত্রায় ধনী। শ্বেতাঙ্গসহ যেকোনো মার্কিন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে তাঁদের গড় আয় সর্বোচ্চ।

এ ছাড়া তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমানভাবে একটি প্রভাবশালী ভোটিং ব্লক হয়ে উঠছেন। রাজনৈতিক তহবিল সংগ্রহে এবং কংগ্রেস ও সরকারি অফিসে তাঁদের বিশিষ্ট ভূমিকা একটি তথাকথিত ‘সামোসা ককাসের’ জন্ম দিয়েছে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে দুই গভর্নর এবং কংগ্রেসের সাত সদস্য ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের মা একজন ভারতীয় এবং জাতিসংঘে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালির (যিনি এখন প্রেসিডেন্ট পদে লড়তে যাচ্ছেন) মা-বাবা দুজনই পাঞ্জাবি শিখ। যদিও এই প্রভাবশালী ভারতীয় আমেরিকানদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ভিন্নতা আছে, তথাপি অনেক ভারতীয় আমেরিকান এখন ভারতসম্পর্কিত ইস্যুতে ক্রমবর্ধমানভাবে স্পষ্টবাদী হয়ে উঠছেন। প্রতিবছর দেড় লাখের বেশি ভারতীয় শিক্ষার্থীর যুক্তরাষ্ট্রে আগমন এই গতিশীলতায় অবদান রাখছে।

যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পরিষেবায় প্রায় ৮০০ কোটি ডলার প্রতিবছর যুক্ত হচ্ছে। এর ফলে এসব অভিবাসীর নতুন ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তার নিরবচ্ছিন্নভাবে ভারতীয়দের আধিপত্য নিশ্চিত করছে।

ইহুদি আমেরিকানরা যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল নীতি গঠনে ভূমিকা রেখে থাকেন, দীর্ঘ মেয়াদে এই সব ভারতীয় আমেরিকানও যুক্তরাষ্ট্রের ভারত নীতি গঠনে প্রভাব খাটাতে পারবেন। একসময় প্রায়ই বলা হতো যে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের জোটসঙ্গী, কিন্তু বন্ধু নয়। অন্যদিকে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু, কিন্তু জোটসঙ্গী নয়। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় পাকিস্তান এখন যুক্তরাষ্ট্রের কম গুরুত্বপূর্ণ জোটসঙ্গী হয়ে পড়েছে।

নিজের কৌশলগত স্বকীয়তা ধরে রাখার চেষ্টায় ভারত এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক মৈত্রীর কোনো গাঁটছড়া বাঁধেনি, তবে বন্ধুত্ব জোরালো করেছে। অনেক সংশয়বাদী বলে থাকেন, এই দুটি দেশের মধ্যে মূল্যবোধের দিক থেকে যতটা মৈত্রী আছে, তার চেয়ে বেশি মৈত্রী আছে স্বার্থগত কারণে। তাঁরাও স্বীকার করবেন, এসব স্বার্থ ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার নিশ্চয়তা দেয়। সেই সহযোগিতা কতটা ঘনিষ্ঠ হয়েছে, মোদির সফর ছিল তার আরও একটি বড় ইঙ্গিত।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • শশী থারুর ভারতের কংগ্রেস পার্টির এমপি ও দেশটির সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব