যৌন হয়রানির প্রতিকার চেয়ে সম্প্রতি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বিক্ষোভ করেন
যৌন হয়রানির প্রতিকার চেয়ে সম্প্রতি  ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বিক্ষোভ করেন

মতামত

যৌন হয়রানি রোধে কেন পৃথক আইন জরুরি

যৌন হয়রানি নিয়ে গত কয়েক বছরে অনেক কথা বলা হলেও এখনো যৌন হয়রানি আসলে কী, সে ধারণা অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়। ভুক্তভোগী থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও অনেক সময় শুধুমাত্র শারীরিকভাবে কেউ লাঞ্ছনার শিকার হলে বা হয়রানির মাত্রা খুব গুরুতর হলেই মনে করেন যে ভুক্তভোগীরা প্রতিকার চাইতে পারে। যৌন হয়রানি প্রতিরোধ করতে এর ধারণাটি স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।

জাতিসংঘসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের আইনে বর্তমানে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এ অপরাধকে, তার একটা সোজাসুজি বাংলা দাঁড়াবে—এমন সব অনাকাঙ্ক্ষিত শারীরিক, মৌখিক, অমৌখিক বা অন্য কোনো যৌন প্রকৃতিবিশিষ্ট বা লিঙ্গভিত্তিক আচরণ, যা কোনো ব্যক্তির জন্য অনিরাপদমূলক, হুমকিস্বরূপ, অস্বস্তিকর, অপরাধমূলক, বিব্রতকর অথবা অপমানজনক বলে যুক্তিসংগতভাবে প্রতীয়মান হয়। যৌন হয়রানিমূলক আচরণের মূল উপাদানটি হলো, যে ব্যক্তির প্রতি এই আচরণ করা হয়েছে, তার কাছে আচরণটি অনাকাঙ্ক্ষিত বা অনভিপ্রেত। 

এ সংজ্ঞা এখনো বাংলাদেশের প্রচলিত কোনো আইনে কিন্তু অন্তর্ভুক্ত হয়নি। একটিমাত্র আইন, যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক, তা হলো ২০০৯ সালের উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনা, যেখানে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে কিছু প্রতিরোধমূলক ও প্রতিকারমূলক বিষয়ে আদালত নির্দেশনা জারি করেছেন।

২০০৯ সালের এই নির্দেশে কিন্তু বাংলাদেশের আইনি কাঠামোয় কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিষয়ে যে কোনো আইন নেই, তারও উল্লেখ রয়েছে। সেই সূত্রে আদালত নতুন আইন প্রণয়নের বিষয়টিতে জোর দিয়েছেন এবং নতুন আইন না আসা পর্যন্ত এই নির্দেশনাই আইন হিসেবে বাধ্যতামূলক হবে বলা হয়েছে। 

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০০৯ সাল থেকে এখন এই ২০২৪ সালে এসেও যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কোনো আইন পাস হয়নি। প্রচলিত আইনগুলোতেও যৌন হয়রানিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি।

শুধু ২০২২ সালে শ্রম আইনের বিধিমালায় একটি সংশোধনের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার আদলে একটি নতুন বিধি যুক্ত হয়েছে। কিন্তু তাতেও আদালতের নির্দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো বাদ দিয়ে একটি সারসংক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে শুধু। 

২০০৯ সালের নির্দেশনাটি একমাত্র আইনি ভিত্তি হলেও যৌন হয়রানির সংজ্ঞাটি কিন্তু নির্দেশনাটিতে পুরোপুরি স্পষ্ট নয়—মূলত সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে যৌন হয়রানিমূলক কাজের কিছু উদাহরণ দেওয়ার মাধ্যমে।

বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও বাদ পড়েছে, যেমন কখন একটি অভিযোগ কমিটির মেয়াদ শেষ হবে বা অভিযোগের তদন্তগুলো কারা করবে ইত্যাদি। এতে একটি প্রতিষ্ঠানের যদি নিজস্ব যৌন হয়রানি-সংক্রান্ত নীতিমালা না থাকে, তবে শুধু উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে অভিযোগের সুষ্ঠু নিষ্পত্তি করা দুরূহ হয়ে পড়ে। 

এ কারণে বিশ্বের অনেক দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠানের কর্মরত অন্য ব্যক্তিদের কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশেষ নীতিমালা বা এথিক্যাল কোড প্রযোজ্য হয়। বিষয়টি কী করে সন্নিবেশিত করা যায় আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব নীতিমালায়, তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শুধু কমিটি গঠিত থাকলেই হবে না, কমিটি আদৌ কার্যকর কি না, তার নিয়মিত মূল্যায়ন ও তদারকিও প্রয়োজন। একই সঙ্গে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কী কী প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে আর সেসব ব্যবস্থা কতটুকু কার্যকর, তা-ও খতিয়ে দেখতে হবে।

যেমন ২০০৯ সালের নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের ব্যাপারে প্রতিবছর ওরিয়েন্টেশন ক্লাস নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যার বাস্তবায়ন দেখা যায় না। আবার একটি প্রতিষ্ঠান যদি তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তবে শুধু একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান করে কার্যকর প্রতিকার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

যৌন হয়রানি রোধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব কী হবে এবং দায়িত্বে অবহেলার ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, আইনে তারও সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে, যা ২০০৯ সালের নির্দেশনায় অনুপস্থিত। 

২০০৯ সালের নির্দেশনায় প্রতিষ্ঠানের পরিধি আর শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেমনই হোক না কেন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি করেই কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে।

এতে পাবলিক বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যেখানে একটি বিভাগেই শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন বিভাগ বা অনুষদের কার্যক্রম পৃথক ভবনে পরিচালিত হয়, সেখানে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মাত্র একটি কেন্দ্রীয় অভিযোগ কমিটি থাকলে তা ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে অভিযোগ জানাতে নিরুৎসাহিত করবে। আবার বড় প্রতিষ্ঠানে একটিমাত্র কমিটি থাকলে অভিযোগ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াও জটিল এবং সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়াতে পারে কমিটির সদস্যদের জন্য। 

যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ কমিটিকে কার্যকর করতে হলে অভিযোগকারীকে ভবিষ্যতে প্রতিশোধমূলক কোনো আচরণ বা নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা দেওয়ার বিধান রাখাও গুরুত্বপূর্ণ, যেটি ২০০৯ সালের নির্দেশনায় প্রতিফলিত হয়নি। এ ছাড়া কোনো অভিযোগ আনা হলে অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যা উচ্চ আদালতের নির্দেশেও গুরুত্ব পেয়েছে।

তবে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নীতিমালায় স্পষ্ট না করা থাকলে, অভিযোগের পক্ষদ্বয়ের গোপনীয়তা নিশ্চিত করার বিষয়টিও উপেক্ষিত থেকে যেতে পারে। এ কারণে নতুন কোনো আইন প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার আলোকে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে বিস্তারিত বিধানসংবলিত নিজস্ব নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। একই সঙ্গে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাটি যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় পর্যায়ে কার্যকর তত্ত্বাবধানের আনুষ্ঠানিক কাঠামো নির্ধারণ করা জরুরি। 

পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক এবং অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্কের বিষয়ে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি নিজস্ব নৈতিক নীতিমালা বা কোড অব কন্ডাক্ট থাকা প্রয়োজন।

স্বাভাবিকভাবেই একজন শিক্ষক যেহেতু একজন শিক্ষার্থীর কাছে একটি নির্ভরতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার স্থানে থাকেন, তাই কোনো নীতিমালার বাধ্যবাধকতার অনুপস্থিতিতে সে অবস্থানের অপব্যবহার করার সুযোগ রয়ে যায়। আবার এমন কোনো সম্পর্ক সাধারণভাবে অন্য শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক বা অন্যায্য আচরণের সুযোগ তৈরি করতে পারে। 

এ কারণে বিশ্বের অনেক দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠানের কর্মরত অন্য ব্যক্তিদের কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশেষ নীতিমালা বা এথিক্যাল কোড প্রযোজ্য হয়। বিষয়টি কী করে সন্নিবেশিত করা যায় আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব নীতিমালায়, তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।

অনেক বছর ধরে শিক্ষা ও কর্মপ্রতিষ্ঠানে ২০০৯ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী যৌন হয়রানি রোধে একটি পৃথক আইনের দাবি জানাচ্ছে অনেকগুলো মানবাধিকার সংগঠন। এত বছরে কেন এ রকম একটি আইন প্রণয়ন করা যাচ্ছে না, বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের অবস্থান সাধারণের কাছে স্পষ্ট করা প্রয়োজন। 

আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় নারী ও কন্যাশিশুর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি তাতে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হয়রানিমূলক আচরণের প্রতিকার আর প্রতিরোধের দুর্বল কাঠামো- এই বাস্তবতার নিরিখে খুব দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

তাসলিমা ইয়াসমীন সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়