ব্যাংক খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির একীভবন হতে যাচ্ছে কি

দেশের ব্যাংক খাত সংস্কারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল কিছু ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত আটটি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, এগুলো হলো—বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা ব্যাংক, সিটি ব্যাংকের সঙ্গে বেসিক ব্যাংক, রাষ্ট্রায়ত্ত কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড বা বিডিবিএল। (এবার সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে বেসিক ব্যাংক, ৮ এপ্রিল ২০২৪, প্রথম আলো)

প্রশ্ন হলো, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দিলেই কি ব্যাংক খাতের সমস্যার সমাধান হবে? দেশের ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণে, যার মধ্যে রয়েছে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কর্তৃক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া; সরাসরি জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ লুণ্ঠন; ব্যাংকমালিক হয়ে লুটপাট, অর্থাৎ স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগে ব্যাংক উদ্যোক্তা হয়ে জনগণের হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন; ব্যাংকের টাকা লুটে ব্যাংকমালিক এবং পরবর্তী সময়ে আরও লুটপাট; রাজনৈতিক মদদে নিয়োগপ্রাপ্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এমডি বা পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক বিভিন্ন সুবিধার বিনিময়ে ব্যাংকঋণ ও লুটপাট; ব্যাংক লুটে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা, যেমন অনিয়ম–দুর্নীতির প্রশ্রয় প্রদান, লুণ্ঠনের হোতাদের বিচার না করা, খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার না করা, উদারভাবে ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা প্রদান, বছর বছর জনগণের করের অর্থ লুটপাটের শিকার ব্যাংকগুলোতে ঢালা ইত্যাদি।

দেশের ব্যাংকিং খাত দুর্বল হওয়ার এই কারণগুলো সমাধান না করে এবং এর জন্য দায়ী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিচার না করে ব্যাংক একীভূত করার মধ্য দিয়ে কি অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যাংককেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হবে না? কথিত ভালো ব্যাংকগুলো আসলে কতটা ভালো, সেটা নিয়েও তো প্রশ্ন রয়েছে।

ডিসেম্বর ২০২৩ শেষে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের বিতরণ করা ৩১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা, অর্থাৎ খেলাপির ঋণের হার ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আর মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১৩ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। এ সময়ে সোনালী ব্যাংকের ৯৩ হাজার ৯৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। (এবার সোনালী ও কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে বিডিবিএল ও রাকাব, প্রথম আলো, ৪ এপ্রিল ২০২৪)

নিজেরাই খেলাপি ঋণে জর্জরিত এই ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আরও দুর্বল ব্যাংক জুড়ে দিলে ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি কি আরও খারাপ হবে না? সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ব্যাংক-কোম্পানির একত্রীকরণের জন্য অনুসরণীয় নীতিমালা’ জারি করেছে। এই নীতিমালায় যেভাবে ব্যাংক একীভূতকরণের কথা বলা হয়েছে, তার ফলে এই আশঙ্কা আরও প্রবল হয়েছে।

প্রথমত, নীতিমালায় দুর্বল ব্যাংকের সংকটের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচার করার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেই। শুধু তা–ই নয়, ব্যাংক খাতের সংকটের জন্য অন্যতম দায়ী যে মালিক-পরিচালকেরা, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় তাঁদের আবার অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের পরিচালক পদে নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে ‘স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যাংক-কোম্পানির একত্রীকরণ সম্পর্কিত নীতিমালা’র ধারা ৮(৩)–এ বলা হয়েছে, ৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর, হস্তান্তরকারী ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারগণ তাদের শেয়ারধারণের আনুপাতিক হারে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও উপযুক্ততা থাকা সাপেক্ষে, পর্ষদে পরিচালক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।

ধারা ৮(৪)–এ বলা হয়েছে, একীভূত ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ উক্ত বিলুপ্ত কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পদের কোনো কর্মকর্তাকে যদি উপযুক্ত মনে করে, তাহলে নতুন করে চুক্তি ভিত্তিতে উপযুক্ত কোনো পদে নিয়োগ প্রদান করতে পারবে। এসব বিধানের মাধ্যমে যাদের কারণে ব্যাংক দুর্বল হয়েছে, তাদেরকে দায়মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বলা হচ্ছে, একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট বা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি এই খেলাপি ঋণ কিনে নেবে। প্রশ্ন হলো, এই সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির মালিকানা কার হবে? অর্থাৎ কার অর্থে এই খেলাপি ঋণগুলো কিনে নেওয়া হবে?

দ্বিতীয়ত, নীতিমালার ৯ ধারা অনুসারে, ‘জনস্বার্থে ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে’ বাংলাদেশ ব্যাংক অধিগ্রহণকারী ব্যাংককে নানা ধরনের নীতি সহায়তা প্রদান করবে, যার মধ্যে রয়েছে ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ, সিআরআর (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও), এসএলআর(স্ট্যাটুটরি লিকুইডিটি রেশিও), এলসিআর (লিকুইডিটি কাভারেজ রেশিও), এনএসএফআর(নেট স্টেবল ফান্ডিং রেশিও) ইত্যাদি সংরক্ষণে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট অংশ অব্যাহতি প্রদান; হস্তান্তরকারী কোম্পানির পুঞ্জীভূত লোকসানকে ‘গুডউইল’–এ রূপান্তরপূর্বক তা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে হস্তান্তর গ্রহীতা ব্যাংকের আয় থেকে সমন্বয়/পরিশোধের সুযোগ প্রদান; অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তারল্য সুবিধা প্রদান; বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ব্যাংকের দীর্ঘ মেয়াদি বন্ড ক্রয়ের মাধ্যমে নগদ সহায়তা প্রদান; মূলধন বৃদ্ধির জন্য শেয়ার ইস্যু, পারপেচুয়াল বন্ড এবং সাব–অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যুকরণে সহায়তা প্রদান ইত্যাদি। কাজেই দেখা যাচ্ছে, একীভবনের মাধ্যমে অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের মালিক-পরিচালকদের নানাভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। অন্যদিকে একীভূত হওয়া ব্যাংকের মালিক-পরিচালকদেরও দায়মুক্তি পেয়ে পাঁচ বছর পর আবার পরিচালনা পর্ষদে ফেরার সুযোগ থাকছে। কাজেই ব্যাংক একীভবনের ফলে প্রাপ্য সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য উভয় পক্ষের মধ্যে নির্দিষ্ট সময় পর হস্তান্তরকারী ব্যাংকের মালিকপক্ষকে ব্যাংক পরিচালনায় সুযোগ দেওয়ার গোপন সমঝোতা যে হবে না, তার কী নিশ্চয়তা?

তৃতীয়ত, একীভূতকরণের নীতিমালায় ব্যাংক একীভূতকরণের ফলে ‘দুর্বল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ও অন্যান্য আর্থিক দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা মোকাবিলা করার ঝুঁকি’ থাকার কথা স্বীকার করা হলেও একীভবনের পর সেই ঝুঁকি কীভাবে নিরসন করা হবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই।

নীতিমালার ধারা ৮(৫)–এ শুধু বলা হয়েছে, ‘হস্তান্তরকারী ব্যাংক/ফাইন্যান্স কোম্পানি হতে অধিগৃহীত ঋণসমূহ যাতে খেলাপি না হয়ে যায়, এবং ঋণগুলোর তদারকি ও খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য পৃথক ইউনিট/বিভাগ গঠনপূর্বক প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠিত হওয়ার পর ঋণ/বিনিয়োগের বিপরীতে গৃহীত সহায়ক জামানতসহ উক্ত খেলাপি ঋণ/বিনিয়োগ বিক্রয় করা যাবে।’

প্রশ্ন হলো, একটি বেসরকারি ব্যাংকের মালিকপক্ষ কোন যুক্তিতে অন্য একটি বেসরকারি ব্যাংকের বিপুল খেলাপি ঋণের দায় নিতে চাইবেন? আর কোন কারণে সরকারি–বেসরকারি ব্যাংক যদি অন্য ব্যাংকের ঋণের দায় গ্রহণ করেও তাতে ‘খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য পৃথক ইউনিট’ গঠন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? সোনালী বা কৃষি ব্যাংক তো তাদের নিজস্ব খেলাপি ঋণই যথাযথভাবে আদায় করতে পারছে না, তাহলে বিডিবিএল বা রাকাবের খেলাপি ঋণ কীভাবে আদায় করবে?

বলা হচ্ছে, একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট বা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি এই খেলাপি ঋণ কিনে নেবে। প্রশ্ন হলো, এই সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির মালিকানা কার হবে? অর্থাৎ কার অর্থে এই খেলাপি ঋণগুলো কিনে নেওয়া হবে?

এই অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি যদি সরকারি মালিকানায় গঠিত হয় (অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি আইন, ২০২০–এর খসড়ার ৪ ধারায় শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় গঠনের কথাই বলা হয়েছে), তাহলে তার অর্থ দাঁড়াবে, জনগণের অর্থে খেলাপি ঋণ কিনে নিয়ে একদিকে ঋণখেলাপিদের দায়মুক্তি প্রদান, অন্যদিকে অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের সুবিধা করে দেওয়া। সরকারি কোম্পানি জনগণের অর্থে খেলাপি ঋণ কিনে নিলে সেটা আর আদায় করতে পারবে না, যেমন আদায় করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ।

দেশে এর আগে আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভবনের যে ঘটনা ঘটেছে, তার ফলাফলও ইতিবাচক হয়নি। খেলাপি ঋণে জর্জরিত দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি) ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থাকে (বিএসআরএস) ২০০৯ সালের নভেম্বরে একীভূত করে গঠন করা হয়েছিল বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) পিএলসি। (বিডিবিএল গঠন, bdbl.com.bd) কিন্তু তাতে খেলাপি ঋণের সমস্যার সমাধান হয়নি, পুরোনো খেলাপি ঋণের পাশাপাশি ব্যাংকটির নতুন করে দেওয়া ঋণও খেলাপি হয়ে গেছে।

প্রথম আলোর সংবাদ অনুসারে, ডিসেম্বর ২০২৩ শেষে বিডিবিএলের ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ৯৮২ কোটি টাকা, অর্থাৎ ঋণের ৪২ শতাংশই খেলাপি। ব্যাংকটিতে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যবেক্ষক নিয়োগ করার পরও এর কোনো উন্নতি ঘটেনি। (একীভূত হয়েছিল ১৪ বছর আগে, এখনো ধুঁকছে ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক; প্রথম আলো, ১৮ মার্চ ২০২৪)

এ রকম একটা অবস্থায় ব্যাংক খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতির মূল কারণগুলো দূর না করে নীতিনির্ধারকদের জবাবদিহির ব্যবস্থা না করে এবং দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচার না করে ব্যাংক একীভূত করা হলে অনিয়ম ও দুর্নীতিরও একীভবন ঘটার আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে।

  • কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক