গদ্যকার্টুন

বায়ুদূষণকবলিত নিউইয়র্কবাসী ঢাকার ভিসা চায় যদি!

নিউইয়র্ক এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর। আইকিউ এয়ারের তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে, বায়ুদূষণ সূচক নিউইয়র্কে এখন ২০০-এর ওপরে, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচিত। নিউইয়র্কের অনেক স্কুল তাদের আউটডোর কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। ঢাকা লড়াই করছে। এখনো দ্বিতীয়। দূষণ ২০০-এর নিচে। [বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ২১ মিনিটে]

নিউইয়র্কের বাতাসের এ বেহালের কারণ কানাডার কুইবেকে ১০টার মতো দাবানল। সেই দাবানলের ধোঁয়া-ছাই আসছে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে কী হবে? নিউইয়র্কবাসী কি শরণার্থী হবে? আমরা, বাংলাদেশিরা, মানবতার উজ্জ্বল উদাহরণ, মেহমানদারিতে অনুপম।

সে ক্ষেত্রে আমেরিকানরা কি বাংলাদেশে আসবে? এত কষ্ট করে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে এই দেশে যদি তারা আসে, তাদের এই কষ্টের ফল তারা পাবে! পাবে পদ্মার ইলিশ, ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট থেকে উৎপাদিত কাচ্চি বিরিয়ানি। আমের মৌসুমে বগুড়ার দই দিয়ে আমরা ম্যাঙ্গো-লাচ্ছি বানিয়ে দিতে পারব। লাচ্ছি খাচ্ছি, আরাম পাচ্ছি। আর বিউটির শরবত তো আছেই।

কিন্তু সব আমেরিকানের জন্য বাংলাদেশের দরজা উন্মুক্ত করে দেওয়া ঠিক হবে না।

বাংলাদেশকে অবশ্যই নতুন ভিসা নীতি গ্রহণ করতে হবে, ঘোষণা করতে হবে। আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে এখনো বিতর্ক শেষ হয়নি। হিলারি ক্লিনটন যেবার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি হেরেছিলেন আদালতের নির্দেশে। সবাই জানেন, বেশি ভোট পেয়েও প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি হিলারি। আর ট্রাম্পের কথা কী বলব! তাঁকে তো জিতিয়েছেন রাশিয়ানরা। রাশিয়ানদের এই ডিজিটাল ভোট ছিনতাই নিয়ে কথা হয়, তবে পুরোটা হয় না, আমেরিকানরা লজ্জায় সে কথা মুখ ফুটে বলতে পারেন না। আর ট্রাম্প হেরে যাওয়ার পর কী করেছেন? ২০২০ সালের ভোটে হেরে যাওয়ার পর তিনি ক্যাপিটল দখল করার ডাক দেন। মানুষ মারা যায়। ট্রাম্প চক্র ভোটের ফল পাল্টে দেওয়ার জন্য সাংবিধানিক ক্যু করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন।

তাহলে ঢাকার উচিত বাংলাদেশে ইমিগ্রেশনপ্রত্যাশী আমেরিকানদের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করা। এতে অবশ্যই প্রার্থীদের অতীত কর্মকাণ্ড খুঁটিয়ে দেখার বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে। যেসব আমেরিকান ভোট কারচুপির সঙ্গে যুক্ত থাকবেন, বাংলাদেশ তাঁদের ভিসা দেবে না। দিতে পারে না। ট্রাম্প তাঁর আমলে সিএনএনের এক সাংবাদিকের হোয়াইট হাউসে ঢোকা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। মামলা-মোকদ্দমার পর তাঁর ‘পাস’ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। জিম অ্যাকোস্টা নামের ওই সাংবাদিক ২০১৯ সালে বই লিখেছেন, ‘দ্য এনিমি অব দ্য পিপল: আ ডেঞ্জারাস টাইম টু টেল দ্য ট্রুথ ইন আমেরিকা’। এ রকম যাঁরা গণশত্রু আছেন আমেরিকায়, যাঁরা আমেরিকায় সত্য প্রকাশে বাধা দেন, তাঁদেরও আমরা ভিসা দিতে পারি না। এ ছাড়া যাঁরা কালো মানুষদের গলা টিপে ধরেন, তাঁদের শ্বাস নিতে দেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে ‘ভিসা নয়’, নীতি প্রয়োগ করতে হবে। স্কুলে যাঁরা অকারণ গুলি করেন এবং এই গুলি বন্ধে যাঁরা ব্যবস্থা নিতে দেন না, তাঁদের বিরুদ্ধেও বাংলাদেশকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।

বাংলাদেশের মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, ভিআইপিদের অনেকের কলিজা আমেরিকা-কানাডার গাছের মগডালে বেঁধে রাখা। অনেকেই নামে-বেনামে বাড়ি কিনে রেখেছেন উত্তর আমেরিকায়, অনেকের ছেলেমেয়েরা সেখানে লেখাপড়া করছে, অনেকের বউ-বাচ্চারা সেখানে স্থায়ী আবাস গেড়ে রেখেছেন। অনেকের সাদা সাদা কালা কালা টাকা সেসব দেশে পাচার করে রাখা হয়েছে নানা রকম ফন্দিফিকির করে।

এটা অবশ্যই আমেরিকার নতুন ভিসা নীতির প্রতিশোধ নয়। আমেরিকানরা আমাদের কী গণতন্ত্র শেখাবেন? তাঁরা কি আসলেই অন্য কোনো দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিয়ে চিন্তিত? তাহলে তাঁরা কী করে পৃথিবীর অনির্বাচিত রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাহীন দেশগুলোর সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে দহরম-মহরম চালিয়ে যাচ্ছেন? তাঁরা নিজেরাই কি স্বীকার করেননি যে ইরাকে আসলে উইপন অব মাস ডেস্ট্রাকশন ছিল না, যে অজুহাতে তাঁরা ইরাক আক্রমণ করেছিলেন।

কাজেই বাংলাদেশের অবশ্যই উচিত আমেরিকার বিষয়ে কঠোর নতুন ভিসা নীতি গ্রহণ করা।

একটা বাস্তব সমস্যা অবশ্য আছে।

নিউইয়র্ক শহরে বা ওয়াশিংটন ডিসিতে বা ডেট্রয়েট শহরে যে ছাইভস্মের ঘনঘটা, তা আজ আছে, সাত দিন পর থাকবে না। কানাডার দাবানলগুলো নিভে গেলেই ওদের আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, তখন ‘নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’ বিরাজ করবে। আর আমেরিকানদের যদি স্থানান্তরিত হতেই হয়, তাহলে বিশাল আমেরিকার যোজন যোজন মাইল ফাঁকা পড়ে আছে, সেখানেই তাঁরা সরে যেতে পারবেন। তাঁরা এত কষ্ট করে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসতে চাইবেন না। আমরা যতই তাঁদের বসার জন্য পিঁড়ে আর খাওয়ার জন্য চিড়ে নিয়ে বসে থাকি না কেন।

কিন্তু উল্টো ছবিটা বড়ই নির্মম। বাংলাদেশের মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, ভিআইপিদের অনেকের কলিজা আমেরিকা-কানাডার গাছের মগডালে বেঁধে রাখা। অনেকেই নামে-বেনামে বাড়ি কিনে রেখেছেন উত্তর আমেরিকায়, অনেকের ছেলেমেয়েরা সেখানে লেখাপড়া করছে, অনেকের বউ-বাচ্চারা সেখানে স্থায়ী আবাস গেড়ে রেখেছেন। অনেকের সাদা সাদা কালা কালা টাকা সেসব দেশে পাচার করে রাখা হয়েছে নানা রকম ফন্দিফিকির করে।

তাঁদের বউ-বাচ্চারা সব বিশাল বিশাল ম্যানশনে থাকেন, দামি দামি গাড়ি চালান, কিন্তু তাঁদের কোনো কাজ করতে দেখা যায় না। ফলে, একটা যে আশা ছিল, ভিসা না নিলে কী হয়, আমেরিকায় না গেলে আমাদের বয়েই গেল, বাস্তবে সে আশার গুড়ে বালি। ভিসা না পেলে অনেকেরই বেকায়দা হয়। বিশেষ করে পরিবারের নিকটজনদেরও ভিসা দেওয়া হবে না শুনে পিঠের বেজায়গায় বড় অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে, যেখানে হাত পৌঁছাচ্ছে না।

আরেকটা সমস্যা আছে। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি। বাংলাদেশ আমদানি করে কম, রপ্তানি করে বেশি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছিল ৬৭০ কোটি ডলারের পণ্য। আর বাংলাদেশ আমদানি করেছিল ২৩০ কোটি ডলারের পণ্য। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ রেমিট্যান্সও পায়। বাংলাদেশিরা এই অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৩০৪ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘খেললাম খেললাম, না খেললাম চলে এলাম’ বলে ফেলার মতো বাস্তবতা আমাদের নেই।

এখন আমাদের ডলারের বড় প্রয়োজন। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসে বসে টাকা নিচ্ছে, কারণ তেল বা কয়লা কেনার মতো ডলার আমাদের হাতে নেই। ২০২২ সালের ১৫ অক্টোবর জনকণ্ঠ লিখেছিল: ‘অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতায় এখন ক্যাপাসিটি চার্জের খড়্গ চেপেছে ভোক্তাদের ঘাড়ে। বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা, তার প্রায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম দেশ।

ফলে চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে সরকারকে। গত ১২ বছরে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর পেছনে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ প্রায় ৮৬ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা দিতে হয়েছে সরকারকে। মূলত চাহিদা ও উৎপাদনের ভুল পরিকল্পনার কারণেই বাংলাদেশকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্চা দিতে হচ্ছে।’ রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, সে-সংক্রান্ত নানা নিষেধাজ্ঞা, বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের আক্রা বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও অসহনীয় করে তুলেছে।

তো এখন যে লোডশেডিংকে আমরা জাদুঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, সেই লোডশেডিং জাদুঘরের দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে পড়েছে কালো রোমশ থাবা নিয়ে, হামলা করছে জনপদে জনপদে। বিদ্যুৎ না থাকা মানে পানির সংকট। কলকারখানায় উৎপাদন কমে যাওয়া। তার কুফল আবার পড়বে অর্থনীতিতে।

এ থেকে বের হওয়ার পথ কী? নিশ্চয়ই নীতিনির্ধারকদের মাথায় কোনো পরিকল্পনা আছে। আমরা যারা রম্যরচনা লিখি, তাদের কাছে আছে ‘বাংলা পদ্ধতি’। পাচার হওয়া টাকাগুলো ফিরিয়ে আনার জন্য একটু ‘ডোজ’ বাড়িয়ে দিলেই তো হয়!

হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে নিয়ে যাঁরা পালিয়ে গেছেন, নামে-বেনামে যাঁরা ওভার ইনভয়েসিং করে, আন্ডার ইনভয়েসিং করে বাংলার সম্পদ পাঠিয়ে দিয়েছেন আমেরিকা, কানাডা, পানামা, দুবাই, সুইস ব্যাংকে, তাঁদের টিকিটি ধরে কাছাটায় টান মারুন।

কিন্তু আদার ব্যাপারীর খবরে তো আর জাহাজ ভেড়ানো যাবে না।

একমাত্র ভরসা হলো, সামনে নির্বাচন। সরকারকে যে করেই হোক, মানুষের দুঃখ-দুর্দশার দিকে নজর দিতে হবে, পরিস্থিতি সামলাতে হবে, মানুষের কষ্ট দূর করতে হবে।

আমি চির-আশাবাদী মানুষ, বাংলাদেশের মানুষের কাছে ম্যাজিক আছে, আমরা এবারও জয় লাভ করবই।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক