পার্বত্য ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের বন্যা কী বার্তা দিল

পাহাড় উজাড়, নদীর সর্বনাশ ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফল এই ভয়াবহ বন্যা
পাহাড় উজাড়, নদীর সর্বনাশ ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফল এই ভয়াবহ বন্যা

সেনাছাউনি অরক্ষিত থাকলে শত্রুপক্ষ কোনো না কোনো সময় অতর্কিত হামলা চালাবেই এবং কিছু বোঝার আগে সবকিছু তছনছ করে দেবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে, বিশেষ করে বান্দরবান শহর ও গোটা দক্ষিণ চট্টগ্রামে তেমনই ঘটনা ঘটেছে। অতর্কিত বা আকস্মিক বন্যা যেভাবে সেখানে এলাকার পর এলাকা গ্রাস করে নিয়েছে, তাতে হতবিহ্বল করে দেয়।

সরকারি হিসাব বলছে, কয়েক দিনের বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের ১০ লাখ মানুষ। পত্রিকান্তরে বন্যায় ও পাহাড়ধসে মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে অর্ধশতাধিক। সাঙ্গু নদের সাতকানিয়া ও আনোয়ারা অংশে ভেসে এসেছে কয়েকটি লাশ।

অনেক বছর ধরে দেশে খুলনা, বরিশাল ও সিলেট অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখতে আমরা অভ্যস্ত। সম্প্রতি মোখা ঘূর্ণিঝড় এসে সেই বাস্তবতায় কিছুটা হলেও আঘাত হানে। এর কয়েক মাস পর চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেখা গেল এই বন্যা।

দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলা নিজের জন্মভূমি হওয়ায় সারা জীবন দেখে এসেছি, প্রতিবছর বর্ষাকালে সাঙ্গু নদ ও ডলুখাল উপচে পড়ে আশপাশের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়। খেতখামার, পুকুর ও গ্রামীণ কিছু সড়ক কিছুদিন পানিতে ডুবে থাকে। এবারই প্রথম এ রকম ভয়াবহ বন্যার অভিজ্ঞতা হলো সাতকানিয়ার মানুষের। ঘরের চাল পর্যন্ত ডুবে যাবে, তা তাদের কল্পনার বাইরে ছিল।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সবচেয়ে বড় ব্যস্ততম এলাকা কেরানিহাট যেভাবে ডুবেছে, তা কল্পনাতীত। এই কেরানিহাট দিয়েই বান্দরবান যাওয়ার পথ। পানিবন্দী বিশাল মোড়টির ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে।

এক–দেড় দশক ধরে যেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ-প্রকৃতির ওপর অনাচার চলছে, তা কোনোভাবেই অস্বীকার করার সুযোগ নেই। পাহাড় কেটে কেটে যে পরিমাণ সড়ক করা হয়েছে, তার সৌন্দর্য আমাদের বিমোহিত করলেও, তার ফল তো ভোগ করতেই হবে। গভীর বন-জঙ্গল সাফ করে গাছ কাটা ও পাহাড়ি ছড়াগুলো পাথরশূন্য করার যে ধুম পড়েছে, তা কি সবার জানা নয়?

গতকাল প্রথম আলোর উপজেলা প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানলাম, এখনো সাতকানিয়ার ৩০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে। কেরানিহাট এলাকায় পানি নেমে গেলেও সেখানকার চার হাজারের বেশি দোকানের ৮০ শতাংশই এখনো খোলেনি। পৌর এলাকার বাসিন্দা ৯০ বছর বয়সী শশাঙ্ক পালের বক্তব্য, তাঁর বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এমন পানি তিনি দেখেননি।

দুঃখজনক হচ্ছে বন্যাকবলিত লাখ লাখ মানুষ পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা পাননি। সবচেয়ে বেশি কষ্ট খাবার পানির। সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া এলাকার তেমুহনীর বাসিন্দারা বলছেন, অল্প বিস্কুট–মুড়ি ছাড়া কিছুই পাননি তাঁরা। এ নিয়ে জেলার সংসদ সদস্যরা সমালোচনার মুখে পড়েছেন।     

আবহাওয়াবিদ, বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় মানুষজন থেকে এ বন্যার তিনটি কারণ পাচ্ছি আমরা—অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম জেলায় গত ২৮ বছরেও এমন বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু সেই বৃষ্টির পানি যেভাবে পাহাড়ি ঢল তৈরি করল, তাতে আমাদের শঙ্কিত হতেই হয়। বান্দরবান শহর যেভাবে ডুবে গেছে, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্যই ঠেকেছে দেশের মানুষের কাছে।

এক–দেড় দশক ধরে যেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ-প্রকৃতির ওপর অনাচার চলছে, তা কোনোভাবেই অস্বীকার করার সুযোগ নেই। পাহাড় কেটে কেটে যে পরিমাণ সড়ক করা হয়েছে, তার সৌন্দর্য আমাদের বিমোহিত করলেও, তার ফল তো ভোগ করতেই হবে।

গভীর বন-জঙ্গল সাফ করে গাছ কাটা ও পাহাড়ি ছড়াগুলো পাথরশূন্য করার যে ধুম পড়েছে, তা কি সবার জানা নয়? কোন আলাদিনের চেরাগের জাদুতে পার্বত্য এলাকার সড়কে সড়কে অসংখ্য চেকপোস্ট পেরিয়ে সেসব গাছ ও পাথর পাচার হয়ে যায়?

পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন বাহারি ফল চাষের অন্যতম ভান্ডার হয়ে উঠেছে, দেশের সবচেয়ে সুমিষ্ট আম আম্রপালির উৎপাদন নিয়ে জয়জয়কার দেখি আমরা। পার্বত্য চট্টগ্রামে ফল ও তামাক চাষের কারণে কীভাবে পাহাড়গুলো উজাড় হয়ে যাচ্ছে, তা উঠে এসেছে প্রথম আলোর সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অলক পালের এক সাক্ষাৎকারে।

তিনি বলছেন, গাছ কাটার ফলে পাহাড়ের মাটির ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে। পাহাড়ি মাটি আর বালু এসে ভরাট করে দিচ্ছে এ অঞ্চলের বড় তিনটি নদী শঙ্খ বা সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালীকে। নানা কারণে নদী ও নদীর পাশে যে অত্যাচার চালানো হয়েছে, তার মাশুল দিতে হচ্ছে এখন। মানবসৃষ্ট কারণ হিসেবে তিনি সড়ককেন্দ্রিক অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়নকেও দায়ী করছেন। গুরুত্ব দিয়েছেন।

গত বছর সিলেট ও সুনামগঞ্জে ভয়াবহ বন্যার কারণ প্রসঙ্গেও একই বিষয়গুলো উঠে এসেছিল। ভারতের মেঘালয়ে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে বাণিজ্যিক বন কিংবা চাষাবাদ করার জন্য বন পরিষ্কার করার প্রভাব পড়েছে আমাদের সিলেট অঞ্চলে। পাহাড়ি ভূমি ক্ষয় হওয়া মাটি এসে জমা হচ্ছে সিলেট বিভাগের নদ-নদী ও হাওয়ার এলাকায়। এতে নদ-নদীগুলোর নাব্যতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে।

বন্যায় রেললাইনের নিচ থেকে পাথর ও মাটি সরে গিয়ে আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে রেললাইন। কেঁওচিয়া, সাতকানিয়া

এ বন্যায় আলোচনা তৈরি হয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার নতুন রেললাইন প্রকল্প নিয়েও। দক্ষিণ চট্টগ্রামের অনেক মানুষই মনে করছে, রেললাইনের উঁচু বাঁধের কারণে পানি চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং সেই পানিতে আশপাশের এলাকাগুলো তলিয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও রেললাইন নিয়ে ব্যাপকভাবে প্রতিক্রিয়া আমরা দেখি।

খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, সাতকানিয়ার কেঁওচিয়ার বেশির ভাগ মানুষও এমন ধারণা করছেন। কারণ, বান্দরবানের পাহাড়ি ঢলের পানি ওই এলাকা দিয়েই সাতকানিয়ায় প্রবেশ করে নদ–নদী হয়ে সাগরে গিয়ে পড়ে। কিন্তু রেললাইনে পর্যাপ্ত বক্স কালভার্ট না থাকায় সেই পানি নামতে আটকে গেছে। রেললাইনের দুপাশে পানির উচ্চতার মধ্যেও ছিল তফাত।

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ঢেমুশিয়া ইউনিয়নে ত্রাণ কার্যক্রম চালানো কমিউনিটি রেসকিউ স্টেশনের কর্মীদের সঙ্গে কথা হলো। সব বাড়িঘরের চুলা ডুবে যাওয়ায় তাঁরা সেখানে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে রান্না করা খাবার বিতরণ করেছেন। তাঁদের মাধ্যমে এক গ্রামবাসীর সঙ্গে মুঠোফোনে আলাপ হলো। তিনিও রেললাইনের কারণে পানি নেমে যেতে দেরি হচ্ছে বলে জানালেন। সেই সঙ্গে এ–ও জানালেন, মাছ চাষের কারণে স্লুইসগেটগুলো খুলে দেওয়া হচ্ছে না। স্থানীয় সংসদ সদস্যের প্রভাবে সেটি করা হচ্ছে। এতে তাঁরা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। 

রেললাইনের কারণে বন্যার ব্যাপকতাই বাড়েনি, সেই বন্যায় রেললাইনেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে রেললাইন নিয়ে মানুষের অভিযোগের বিষয়ে অলক পাল বলছেন, ‘যাচাই-বাছাই বা কোনো ধরনের স্টাডি ছাড়া এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। তবে আমাদের এখানে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয় বা ইচ্ছাকৃতভাবে নজর দেওয়া হয় না।’

পরিবেশ প্রশ্নে বাংলাদেশের উন্নয়ন মডেল একেবারেই ভঙ্গুর, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্পে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সমকাল–এ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘পরিবেশ রক্ষা গণতন্ত্র রক্ষার মতোই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেমন মানুষের মতামত গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি পরিবেশ রক্ষায়ও মানুষের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়নের নামে পরিবেশবিরোধী সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। ৫০ বছর আগে আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু প্রাকৃতিক স্বাধীনতা এখনো আসেনি।’  

প্রকৃতির এই সর্বনাশকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে এখন। সে অনুসারে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও পদক্ষেপ না নিলে পার্বত্য ও দক্ষিণ চট্টগ্রামকে সামনে আরও ভয়াবহ বন্যা গ্রাস করবে, এমনটিই আমাদের দেখতে হবে। 

রাফসান গালিবপ্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী