একটি বিড়াল, কারাগার নাকি মায়ার গল্প

কেবল তারে আটকে আছে বিড়াল ছানা। পাশের ছাদে উৎসুক মানুষ। কীভাবে বিড়ালটিকে বাঁচানো যায়, সেই চিন্তা সবার চোখেমুখে
ছবি: ফারুক ওয়াসিফ

দোতলা বাড়িটার ছাদে, চারপাশের জানালায়, বারান্দায় নারী ও শিশুরা আঁতকে-ওঠা মন নিয়ে ভাবছে, ইশ্‌শ যদি পড়ে যায় বাচ্চাটা? ব্যথা পাবে! কতটা ব্যথা? মরে যাবে না তো? কারও কোনো বুদ্ধি আসছিল না হয়তো। হয়তো সবাই চাইছিল কেউ কিছু করুক। চেয়ে চেয়ে এটা দেখা যায় না।  

ভয় পেলে মানুষ জমে যায়, বিড়ালছানাও প্রথমে তা-ই করে। কিন্তু বাঘের জাত, ভয় পেলে কামড়েও দিতে পারে। কিন্তু হালকা খয়েরি ছোপঅলা সাদা বিড়ালছানাটির কিছুই করার উপায় নেই। দোতলা সমান উচ্চতায় কেবল টিভির মোটা কালো তারে আটকে ছিল তিন-চার মাস বয়সী সাদা বিড়ালশিশুটি।

বিড়ালটি ঝুলে আছে যে তারে, নিজে নড়লে সেটাও দোলে। তাই প্রাণপণে আঁকড়ে আছে ওইটুকু অবলম্বন।

সে ঝুলে আছে যে তারে, নিজে নড়লে সেটাও দোলে। তাই প্রাণপণে আঁকড়ে আছে ওইটুকু অবলম্বন। ভয় পেয়ে কী আর করবে। মাঝেমধ্যে মানুষের শিশুর মতো মায়াবী গলায় ম্যা ম্যা করে ডাকছিল। মা তার কোথাও ছিল না আশপাশে। যদিও–বা থাকত, ওই মার্জার-জননীরই–বা কী করার থাকত? সেও ম্যা ম্যা করত মাটি থেকে। তার শিশুটিও সেই ডাকের করুণ প্রতিধ্বনি তুলে ভারী করে দিত পরিবেশ।

কিন্তু সব জায়গায়, সব মহল্লায়, সড়কের সব ভিড়ে কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা কারও জন্য অপেক্ষা করেন না। তাঁরা এগিয়ে আসেন। ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করেন, ঝাঁপিয়ে পড়েন বিধ্বস্ত রানা প্লাজায়, আহত বা অসুস্থ মানুষকে নিয়ে ছোটেন হাসপাতালে। এবং এখানেও একজন ছিলেন। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, নাম তাঁর আশা!

কেউ জানালা দিয়ে লম্বা বাঁশ এগিয়ে দিয়েছে, কেউ মাটি থেকে বিড়াল-পর্যন্তও লাগিয়েছে বাঁশের বাতা—যাতে বিড়ালটা সেটা বেয়ে নেমে আসতে পারে।

আশা একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবী। কাজ শেষে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের থেকে নামা সরু রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। মোহাম্মদিয়া হাউজিংয়ের পেছনের খালের পুল পেরিয়ে একটু গেলেই যে মোড়, সেখানে তখন জটলা বেঁধেছে। লোকে কেবল তারে আটকে থাকা বিড়ালশিশুটাকে নামতে বলছে, আহা–উহু করছে। সে এক পরিস্থিতি। সরু রাস্তার মোড়ে গাড়ি-রিকশা আটকে গেছে। চলাচল প্রায় বন্ধ। কেউ জানালা দিয়ে লম্বা বাঁশ এগিয়ে দিয়েছে, কেউ মাটি থেকে বিড়াল-পর্যন্তও লাগিয়েছে বাঁশের বাতা—যাতে বিড়ালটা সেটা বেয়ে নেমে আসতে পারে। কিন্তু ভয়ে জমে থাকা বিড়ালছানাটি কারুকেই ভরসা করছে না। আশা নামের মেয়েটি তাঁর আইনজীবীর কালো কোটটি খুলে আরেক পথচারীকে সঙ্গে নিয়ে মেলে ধরেছেন। তাতেও কাজ হচ্ছিল না। দোতলা বাড়ি থেকে এক নারী বড় কাঁথা ফেলে দিলেন। উঁহু, বিড়াল লাফ দেয় না।

ইতিমধ্যে আসরের নামাজ শেষ করে পাশের বায়তুল তাকওয়া নামের ছোট্ট মসজিদ থেকে কয়েকজন মুসল্লি এলেন। ভিড়ের চুম্বকীয় আকর্ষণে তাঁরাও আটকে গেলেন। বুদ্ধি করে তাঁদেরই একজন মসজিদের বড় মই নিয়ে এলেন। সেটা দিয়ে উঠে গেলেন পায়জামা–পাঞ্জাবি পরা একজন। ওদিকে বাঁশ দিয়ে ধীরে ধীরে ঠেলা দিতে দিতেই কাণ্ড ঘটে গেল। বিড়ালছানাটা ঠিক আশা ও অন্যদের কাঁথার প্রান্তে এসে পড়ল! তারপর দৌড়।

কিন্তু যাবে কই। আমি ধরে ফেললাম, তাকে তুলে দিলাম আশার কোলে। বাড়িতে আমারও একটি বিড়াল আছে। আশা বললেন, তিনিও বিড়াল পোষেন। চলে আসার সময়ও দেখি, সাদা পোশাক পরা মুখঢাকা মেয়েটি তখনো কোলের মধ্যে নিয়ে আদর করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে। কারণ, তিনি জানেন মৃত্যুর ভয় সহজে কাটে না, সে মানুষই হোক বা প্রাণীই হোক।

বিড়ালছানাটা ঠিক আশা ও অন্যদের কাঁথার প্রান্তে এসে পড়ল! তারপর দৌড়।

২.

আজকের গল্পটা শুধু বিড়ালেরই। ৬৮ জন মানুষ ডুবে মারা গেল পঞ্চগড়ে। রাষ্ট্রের হেলদোল নেই। রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী একটি মহিলা কলেজে দখলদারির জঘন্য কার্যকলাপ দেখে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। গুলিতে আন্দোলনকারীদের মৃত্যু নিয়েও কথা বলা বারণ। কারণ, মানুষ ভীত। ভয় পেলে মানুষও প্রথমে থমকে যায়। তারপর ফিরতে চেষ্টা করে তার আসল স্বভাবে। আশার কথা, এত অনাচার সয়েও এখনো সেই স্বভাবে মানবিকতা আছে, ভালোবাসা আছে। ভালোবাসা থাকলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। ছোট্ট বিড়ালছানার পর এক ছোট্ট শিশুর গল্প দিয়ে শেষ করি।

ঘটনাটা লিখেছিলেন উরুগুয়ের বিখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক এদুয়ার্দো গালিয়ানো। গল্পটা অনুবাদ করে দিচ্ছি:

উরুগুয়ের রাজনৈতিক বন্দীদের অনুমতি ছাড়া কথা বলা, শিস দেওয়া, হাসা, তাড়াতাড়ি হাঁটা অথবা একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানানো বারণ। এমনকি প্রসূতি নারী, প্রেমিক জুটি, প্রজাপতি, নক্ষত্র ও পাখি আঁকা কিংবা সেসবের ছবি উপহার পাওয়াও ছিল নিষিদ্ধ।

এক রোববার, ‘আদর্শবাদী হওয়ার’ দায়ে বন্দী ও নির্যাতিত স্কুলশিক্ষক দিদাসকো পেরেজের কাছে তাঁর পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে মাইলা দেখা করতে এল। বাবার জন্য সে পাখির ছবি এঁকে এনেছিল। জেলের দরজাতেই রক্ষীরা ছবিগুলো নষ্ট করে দেয়।

পরের রোববার মেয়েটি আবারও আসে। এবার মাইলা এনেছে তার আঁকা গাছের ছবি। তো গাছ আঁকা যেহেতু নিষিদ্ধ না, সেহেতু ছবিগুলো কারাগারে ঢুকতে পারল।

দিদাসকো মেয়ের আঁকার খুবই তারিফ করে জানতে চাইল, ‘তোমার গাছের পাতার ভেতর থেকে উঁকিঝুঁকি দেওয়া ছোট ছোট রঙিন গোল্লাগুলো কী, মা? এগুলো কি কমলালেবু? কী ফল এগুলো?’

মেয়ে তার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলে ‘হিশশশশ!’ তারপর বাপের কানে ফিসফিস করে বলে: ‘বোকা তুমি! দেখছ না এগুলো হলো চোখ? ওগুলো তোমার কাছে লুকিয়ে পাঠানো আমার পাখিদের চোখ।’

মানুষ শুধু রক্ত-মাংস দিয়েই তৈরি নয়, মানুষ মায়া দিয়েও তৈরি।

  • ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক। ই–মেইল: faruk.wasif@prothomalo.com