প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরে প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তি নিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে আলোচনা হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও রাহীদ এজাজ
প্রথম আলো: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফর সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? দুই দেশের গণমাধ্যমেই নেতিবাচক মন্তব্য এসেছে।
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী: আমি মনে করি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফর ধারাবাহিকতার অংশ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। তারই ফিরতি সফর এটি। ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের নেতাদের সফর বিনিময় চলছে। তাই প্রতিটি সফর ব্যালান্সশিট ধরে হিসাব করা উচিত নয়। গণমাধ্যম অনেক মন্তব্য করে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সবার আছে। আমি এসব মন্তব্যকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি না। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দিল্লি গেলেন। দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হলো, যৌথ বিবৃতি প্রকাশ পেল। এটাও তো অগ্রগতি। একটা সফরে সবকিছু হয়ে যাবে, তা ভাবা ঠিক নয়।
বাংলাদেশের প্রধান দাবি ছিল তিস্তা নদীর পানিবণ্টন ও সীমান্তে গুলি করে মানুষ হত্যা বন্ধ করা। এ ক্ষেত্রে তো কোনো অগ্রগতি দেখছি না?
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী: শুধু একটা ইস্যুর সমাধান না হওয়ার অর্থ সফর নিষ্ফল হয়ে যাওয়া নয়। যাঁরা এ রকম কথাবার্তা বলেন, তাঁরা একপেশে দৃষ্টি পোষণ করেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা দুই পক্ষেরই থাকে। সবটা পূরণ করতে দীর্ঘ সময় লাগে। একটা একটা করে এগোতে হয়। মনে রাখতে হবে, পানির বিষয়টি দুই দেশের জন্যই অত্যন্ত সংবেদনশীল। যৌথ ইশতেহারে সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। যদিও দুই পক্ষেরই প্রয়োজন সীমান্তের অপরাধী চক্রকে দমন করা, যাতে চোরাচালান, মাদক ও নকল ভারতীয় মুদ্রা, মানব পাচার ইত্যাদি বন্ধ হয়। এই অপরাধী চক্রই সমস্যার মূলে।
আমরা লক্ষ করছি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে আগে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বেশ উত্তপ্ত ছিল। এখন ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি উত্তপ্ত হচ্ছে। কারণ ব্যাখ্যা করবেন কি?
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী: এটাও ভারতের রাজনীতির অংশ। বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের দ্বন্দ্বের কারণেই এটা হয়েছে। আমি বলব, তিস্তার পানি চুক্তি এই দ্বন্দ্বের ফাঁদে পড়েছে। তবে তিস্তার সমস্যার সমাধান না হলেও অন্যান্য নদীর পানিবণ্টনের চেষ্টা চালাতে হবে। আমার ধারণা, ২০১১ সালে তৎকালীন মনমোহন সিংয়ের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তার বিষয়টি ঠিকমতো হ্যান্ডেল করতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, কেন্দ্র তাঁদের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে আলোচনাই করেনি। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গকে আস্থায় নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। পশ্চিমবঙ্গ মনে করে, তিস্তায় পানিবণ্টনের যে ফর্মুলা দেওয়া হয়েছিল, তাতে রাজ্যের মানুষের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে আস্থায় নিয়েই কিন্তু গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি করা হয়েছিল। কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে দূরত্ব ছিল বলেই সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে ভালো অগ্রগতি হয়েছে। ঝাড়খন্ড থেকে বিশেষ ট্রান্সমিশন লাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছে। আগামী বছর ১৬ ডিসেম্বর চালু হওয়ার কথা। আগে থেকে বাংলাদেশ ভারত থেকে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পেয়ে আসছে। রামপাল প্ল্যান্ট চালু হলে বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে আরও ১৩২০ মেগাওয়াট যুক্ত হবে। এখনকার কূটনীতির অর্থই হলো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি যাওয়ার আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন অতীতের ধারাবাহিকতায়। কিন্তু এবার দেখা হয়নি। মমতার অভিযোগ, কেন্দ্রের কারণেই দেখা হয়নি। আপনার মন্তব্য কী?
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী: এটা নিয়েও রাজনীতি হচ্ছে। তাঁকে কে বারণ করেছে দিল্লি যেতে। তাঁকে তো কেউ বাধা দেয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন এক সময়ে দিল্লি সফর করলেন, যখন দুই দেশের রাজনীতিতে নির্বাচনী হাওয়া বইছে। সে ক্ষেত্রে এই সফরের আলাদা রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল বলে মনে করেন? রাজনৈতিক বিষয়ে নিশ্চয়ই দুই শীর্ষ নেতার কথাবার্তা হয়েছে।
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী: অনেকেই এ ধরনের কথাবার্তা বলেন। আমি তো প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের সঙ্গে নির্বাচনের কোনো যোগসূত্র দেখি না। ভারতের নির্বাচনে আমরা ভোট দেব, বাংলাদেশের নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ ভোট দেবে। হ্যাঁ, তবে দুই দেশের সরকারেরই প্রত্যাশা থাকতে পারে প্রতিবেশী দেশে যারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, সংযুক্তি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে এগিয়ে নেবে, তাদের সঙ্গে কাজ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করবে। বাংলাদেশ ও ভারতের বর্তমান বার্ষিক বাণিজ্য ১৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। যোগাযোগ উন্নত হলে আরও বাড়বে। এগুলোকে কীভাবে আরও এগিয়ে নেওয়া যায়, এটাই দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় থাকার কথা।
একটা সাধারণ ধারণা আছে যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত যা চায়, তা দ্রুত বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু বাংলাদেশ যা চায়, তা সহজে বাস্তবায়িত হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারেই না।
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী: এটা ভুল ধারণা। আমরাও তালিকা দিতে পারি, এটা এটা ভারতের চাওয়া ছিল, হয়নি। কিন্তু আমরা সেটা করি না। এ ধরনের নেতিবাচক কথাবার্তায় কোনো লাভ হয় না। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে হবে প্রগতিশীল ও বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।
বাংলাদেশের ওপর দিয়ে মেঘালয়ের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব এসেছে ভারত থেকে। এটা তো নতুন প্রস্তাব।
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী: পশ্চিমবঙ্গ থেকে মেঘালয়ে সড়কপথকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার সুযোগ আছে বলে মনে করি না। দুই দেশের মধ্যে সড়ক, রেলওয়ে ও নদীপথে যোগাযোগ তো আছেই। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য যাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার বাংলাদেশের পণ্য ভারতের ওপর দিয়ে নেপাল ও ভুটানে যাচ্ছে। দুই দেশের স্বার্থেই এই সংযুক্তি। জরিপ করে যে পথ দুই দেশের জনগণের জন্য অধিক লাভবান মনে হবে, সেই পথই ব্যবহার করা হবে।
ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড—এই ত্রিদেশীয় সড়কে বাংলাদেশ যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল ২০১৬ সালে, সেটা এগোল না কেন?
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী: এটা এগোয়নি তার কারণ, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। আর ত্রিদেশীয় সড়কে বাংলাদেশের যুক্ত হতে হলে আখাউড়ার সঙ্গে ভারতের সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। সেটার কাজ চলছে।
খবরে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী দিল্লি থেকে ফিরে আসার পরই ভারত চালের ওপর রপ্তানি শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা কি ভুল বার্তা দিচ্ছে না?
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী: চালের শুল্ক বাড়ানোর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সফরের কোনো সম্পর্ক নেই। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী চালের সংকট দেখা দিয়েছে। কেবল বাংলাদেশ নয়, অনেক দেশই ভারত থেকে চাল কিনছে। এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ মজুত ঠিক রাখতে ভারত রপ্তানি শুল্ক বাড়িয়েছে। এতে চালের রপ্তানিপ্রবাহ কিছুটা কমবে। তবে আমি মনে করি, চাল নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হতে পারে, যাতে বাংলাদেশকে ওই বাড়তি শুল্ক দিতে না হয়।
বাংলাদেশ চার বছরের বেশি সময় ধরে ১০ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বহন করছে। তাদের দেশে প্রত্যাবর্তনে ভারত কিছু করছে না কেন, যেখানে মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে।
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী: চীনের সঙ্গেও মিয়ানমারের সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো। ভারতের সমস্যা আছে। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী মিয়ানমারে আছে এবং সেখান থেকে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে। তাদের ঠেকাতে মিয়ানমার সরকারের সহযোগিতা দরকার। অন্যদিকে চীন মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে যেতে চাইছে। পাকিস্তানের গদর বন্দরও তারা ব্যবহার করছে। তাই ভারত মিয়ানমারকে খুব বেশি চাপ দিতে পারবে না। তবে ভারত চায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফিরিয়ে নিক। এ জন্য সেখানে ঘরবাড়ি তৈরি করে দেওয়া ও আর্থিক সহায়তারও প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মিয়ানমারে সামরিক জান্তা ক্ষমতায় আছে, যারা আন্তর্জাতিক চাপ বা জনমতকে মোটেই তোয়াক্কা করে না।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী: আপনাদেরও ধন্যবাদ।