২০০৭ সালে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ও ইসরায়েলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সিমোন পেরেস—এই দুজনকে একসঙ্গে নিয়ে একটি প্রাইভেট কারে আমার ওঠার সুযোগ হয়েছিল। সে বছর তাঁরা আঙ্কারায় ঐতিহাসিক সফরে এসেছিলেন। তাঁদের দুজনকে নিয়ে আমি তুরস্কের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির দিকে যাচ্ছিলাম।
তুর্কি পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে এই দুই নেতা একই সঙ্গে শান্তির পক্ষে কথা বলেছিলেন। তাঁদের ভাষণে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কথাও তাঁরা বলেছিলেন। এর দুই বছর পরই তুরস্ক ফিলিস্তিনে একটি প্রকল্প চালু করার ঘোষণা দেয়। ‘ইন্ডাস্ট্রি ফর পিস প্রজেক্ট’ নামের ওই প্রকল্পের আওতায় তুরস্ক গাজা ভূখণ্ডে ‘এরেস ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ নামের একটি শিল্প এলাকা গড়ে তোলার কাজে উদ্যোগী হয়েছিল।
এ প্রকল্পের বিষয়ে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের প্রেসিডেন্টের সম্মতি থাকায় আমি আশাবাদী হয়েছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম, ফিলিস্তিনিদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে ওই অঞ্চলে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, ওই বছর ইসরায়েল গাজায় ভূমি, সমুদ্র ও আকাশসীমায় সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করায় সেই স্বপ্ন নস্যাৎ হয়ে যায়। সেই ঘটনার ১৬ বছর পর ইসরায়েলে হামাসের হামলা এবং তার জেরে ইসরায়েলের অসম প্রতিক্রিয়ায় আমি আরও একবার সেই টেকসই শান্তি উদ্যোগ নস্যাৎ হওয়ার বেদনায় মুষড়ে পড়েছি।
৭ অক্টোবর ছিল ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সম্পর্কের একটি বড় ধরনের বাঁকবদল। এ ঘটনার জেরে বর্তমানে সেখানে যা চলছে, তা অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। বর্তমানে গাজায় যা চলছে, তার জেরে অবশ্যই আমাদের নিজেদের জিজ্ঞেস করতে হবে—আমরা কি আন্তর্জাতিক আইনভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা চালিয়ে নেওয়ায় এবং পারস্পরিক অধিকার ও মানবাধিকার সংরক্ষণে আসলেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ?
ইসরায়েলের সীমানায় ঢুকে হামাস সদস্যদের ইসরাইলি বেসামরিক লোকজনকে হত্যা করা এবং ইসরায়েলের নাগরিকদের অপহরণ করে নিয়ে আসা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ঠিক একইভাবেই প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার যে অসম প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে গাজায় নির্বিচারে বোমা হামলা চালাচ্ছে এবং মানবিক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে, সেটিও কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না।
ইসরায়েলের এ অভিযান গোটা আরব অঞ্চলে পারস্পরিক ঘৃণা ও বিভক্তি ছড়াবে। আর এ সহিংসতায় যারা সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হবে, তারা হচ্ছে সাধারণ বেসামরিক মানুষ।
আজকে গাজায় যে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে, সেটি মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে কখনোই গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়নি এবং সেখানে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা দিনকে দিন বেড়েছে।
ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরায়েলের লাগাতার দখল অভিযান, আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব অমান্য করা, আন্তর্জাতিক আইন ও মূল্যবোধকে অস্বীকার করে যাওয়া এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন নিরবচ্ছিন্নভাবে লঙ্ঘন করে যাওয়া আজকের এ পরিস্থিতি তৈরি করার পেছনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বলে আমি মনে করছি। এর বাইরে গাজা ভূখণ্ডে দীর্ঘদিন ধরে ২৩ লাখ ফিলিস্তিনি বাসিন্দাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্বের পাশাপাশি আরব বিশ্ব চুপ করে থাকায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এতে ফিলিস্তিনের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ১৯৯৯ সালে ‘অ্যাসেম্বলি অব দ্য কাউন্সিল অব ইউরোপ’ গাজা ভূখণ্ডের অবস্থা পর্যবেক্ষণে একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পাঠিয়েছিল। তুরস্কের একজন পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে আমি সেই মিশনে গিয়েছিলাম। তখন আমি নিজের চোখে গাজার নারী ও শিশুদের সীমাহীন দুর্দশা ও অসহায়ত্ব দেখে এসেছি।
গাজা পরিদর্শন শেষ করে আমরা যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলাম, তাতে আমরা ফিলিস্তিনি জনগণের করুণ অবস্থা তুলে ধরেছিলাম। এরপর তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে যখন ফিলিস্তিন সফর করেছি, তখন সেখানকার মানুষের অবস্থা আরও শোচনীয় পর্যায়ে চলে গিয়েছিল।
গত পাঁচ দশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি টেকসই শান্তিপ্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল নামের দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে তাদের সহাবস্থান নিশ্চিত করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্ব সর্বতোভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সেই ব্যর্থতার কারণেই আজকে সমগ্র ফিলিস্তিন অঞ্চলে মানবিক পরিস্থিতি শোচনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। আজকে গাজায় ফিলিস্তিনি শিশুরা ইসরায়েলি বোমায় নিহত হওয়ার আশঙ্কায় আগেভাগে মা–বাবাকে বিদায় জানিয়ে চিঠি লিখে পকেটে রেখে দিচ্ছে। এটি আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সমগ্র বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইসরায়েল যে কৌশলে গাজায় অভিযান চালাচ্ছে, সেটা অবশ্যই আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইনকে লঙ্ঘন করছে। সাধারণ গাজাবাসীকে বিদ্যুৎ, পানি, খাবার, জরুরি ওষুধ পাওয়ার সব সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে। হাসপাতাল, মসজিদ, গির্জা, স্কুল, শরণার্থীশিবিরের মতো জায়গা লক্ষ্য করে বোমা ফেলা হচ্ছে। এটি জেনেভা কনভেনশন ও তার সম্পূরক প্রটোকলগুলোর সম্পূর্ণ বিরোধী। গাজায় ইসরায়েলের এই অসম হামলা নিঃসন্দেহে যুদ্ধাপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয় এবং ইতিহাস এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।
ইসরায়েল তার এ অভিযানের ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়েছে। আজকে যেসব দেশ ইসরায়েলকে গাজায় হামলা চালানোর ব্যাপারে সমর্থন দিচ্ছে, তাদের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত, ‘আমরা যদি ফিলিস্তিনিদের ভৌগোলিক সার্বভৌমত্বকে স্বীকার না করি, তাহলে আমরা কীভাবে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের পক্ষে কথা বলতে পারি?’
আমি সেই আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোকে প্রশ্ন করতে চাই, আপনারা যদি নিজেরাই আন্তর্জাতিক আইনকে সম্মান না করেন, তাহলে কীভাবে সেই আন্তর্জাতিক আইন বিশ্বাসযোগ্য থাকবে বলে আশা করেন?
পশ্চিমাদের এই দ্বিমুখী নীতি ও আইনের শাসনভিত্তিক বৈশ্বিক ব্যবস্থার নামে নির্বাচিত ক্ষেত্রে আইনের শাসন ফলানো বিশ্বে কর্তৃত্ববাদী সরকারের উত্থান ঘটাচ্ছে এবং উগ্রপন্থী বিভিন্ন আন্দোলনকে উসকে দিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে অবশ্যই তাদের সরে আসতে হবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত
● আবদুল্লাহ গুল তুরস্কের সাবেক প্রেসিডেন্ট